বৈশ্বিক গজব-আজাব করোনাভাইরাস দূর্যোগ, ধনী দেশ থেকে ধেয়ে আসা আহজারীর বিপরিতে উন্নয়নশীল দেশ আমাদের বুক ধরপর কি কম? দেশে পুষ্টিহীন দরিদ্র জনগোষ্টি ধুকে ধুকে পরপারে সিকি-আধা-বারো-ষোলআনা মরার মিছিল কি কমছে? এই ধন সম্পদ এবং মানব সম্পদ বৈষ্যম্যের মিছিল থামাতে হলে দীর্ঘমেয়দী দেশজ সম্পদ চিন্তা চেতনাপ্রসূত বঙ্গবন্ধু নীতি আদর্শের স্বপ্ন বাস্তবায়নই হবে আমাদের পথ ও পাথেয়। তাই আমাদের সামষ্টিক উন্নয়নের বটমলাইন ধরেই এগুতে হবে। বটমলাইন হলো আল্লাহ প্রদত্ত মা। প্রতিটি দিনই মাকে সম্মান জানানোর দিন হলেও আজ একটি আনুষ্ঠানিক দিন ‘বিশ্ব মা দিবস’।
১৯০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আনা জারভিস মায়ের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য সচেতনতার কাজকে পরবর্তীতে তাঁর মেয়ে আনা মারিয়া মায়ের কাজকে স্মরণীয় করে রাখেন। সেখান থেকে ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এভাবেই শুরু হয় বিশ্ব মা দিবসের যাত্রা। শুধু স্বাস্থ্য সচেতনতা নয় বরং সার্বিক উন্নয়ন ও সামগ্রিক কল্যাণে পরিকল্পিত কাঠামোর মাধ্যমে মাতৃত্বকে কেন্দ্র করে দেশজ ধারণায় বাংলাদেশে মা দিবসের আজ ১৫ বছর। শবতর্ষ পরে ২০০৫ সালের বিশ্ব মা দিবসে বেসরকারি সংগঠন ‘র্ডপ’ বাস্তবায়ন কার্যকারিতার মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপন করে। উদ্যোগ নেয়া হয় মাত্র একশত জন দরিদ্র মাকে চিহ্নিত করে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদানের। ভাতা প্রদানের ফলশ্রুতি সফলতায় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে দেন-দরবার ও আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার ২০০৭-০৮ অর্থ বছরে দেশে গরীব মাদের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান কার্যক্রম মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চালু করে। বঙ্গবন্ধু কণ্যা, মা কূলের স্বপ্ন রানী, গরীব দরদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাতার মেয়াদকাল দুই বছর থেকে তিন বছর ও ভাতার পরিমান ৫শ থেকে ৮শ টাকায় পর্যায়ক্রমে উন্নিত করেন। বর্তমানে দেশে ৭ লাখ ৭০ হাজার মা এই ভাতা পাচ্ছেন। সকলের একাত্ততার কর্মযোগে এক বিশাল দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারি মাতৃত্বকালীন ভাতা একটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। সাতটি শর্ত সাপেক্ষে ভাতা প্রদানের ফলে মাতৃমৃত্যু, বাল্যবিবাহ, তালাক ও যৌতুক রোধ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, জন্ম নিবন্ধন, পুষ্টিকর খাদ্য, শিশুকে বুকের দুধ পান ও বিবাহ নিবন্ধন কার্যকর হচ্ছে।
দরিদ্র মায়ের মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রাপ্তির তিন বছর সমাপ্ত হলে এই মা-বাবা, শিশুর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, কর্মসংস্থানসহ মৌলিক চাহিদা ও অধিকারের ভবিষ্যৎ জীবন যাপনে টেকসইতার উত্তর কি? এ প্রশ্নের উত্তরের নামই হলো মাতৃত্বকালীন ভাতা কেন্দ্রীক ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’। ‘স্বপ্ন’ হলো যা ঝড়পরধষ অংংরংঃধহপব চৎড়মৎধস ভড়ৎ ঘড়হ-অংংবঃবৎং- ঝঅচঘঅ. স্বপ্ন প্যাকেজ সামষ্টিক উন্নয়ন বটমলাইনিং মাতৃত্বকালীন ভাতাপ্রাপ্ত মারাই হলো এর কেন্দ্র বিন্দু- মূল প্রজন্ম শক্তি। স্পেনের মহামান্য রানী সোফিয়ার পৃষ্টপোষকতায় তার সরকারের আয়েসিদ এর অর্থায়নে র্ডপ প্রথম ২০০৯-১২ সালে দেশের পাঁচটি নির্বাচিত উপজেলায় ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ কার্যক্রম প্রায় এক হাজার মা’কে নিয়ে বাস্তবায়ন করে। যার উদ্দেশ্য ও সফলতা সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
বঙ্গবন্ধু কণ্য শেখ হাসিনা সরকার ২০১৫-১৭ সালে মুজিবনগর-টুঙ্গীপাড়া-চাটখিলসহ দেশের ১০টি উপজেলায় সাত শত মা’কে নিয়ে স্বপ্ন প্যাকেজ কার্যক্রম পাইলট আকারে বাস্তবায়ন করে। র্ডপ বাস্তবায়ন সহযোগী ছিল। স্বপ্ন প্যাকেজে আছে- ১. স্বাস্থ্য-পুষ্টি ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ কার্ড, ২. শিক্ষা সংস্কৃতি ও বিনোদন কার্ড, ৩. কম-বেশী ৩০ হাজার টাকা মূল্যে স্বাস্থ্য সম্মত একটি লেট্রিনসহ বসত ঘর, ৪. কম-বেশি ৩০ হাজার টাকার আয় রোজগারমূলক কাজের জন্য জীবিকায়ন উপকরণ/সরঞ্জাম। ৫. সঞ্চয় পরিবেশ ও প্রয়োজনে উন্নয়ন ঋণ। টেকসই উন্নয়নে ইউনিয়ন-উপজেলার সকল স্বপ্ন-মা ‘মা-সংসদ’ প্লাটফর্ম গঠন করে নিজেদের দারিদ্র জয়ের দৃষ্টান্ত স্থানীয় সরকার তথা কেন্দ্রীয় সরকার তা বিশ্বের কাছে তুলে ধরার চেষ্টাও তারা করে যাচ্ছেন। পাবলিক (স্থানীয় সরকার) পুয়র (মা) প্রাইভেট (এনজিও-র্ডপ) পার্টনারশীপ (পিপিপিপি) এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকার বিধিমালা নিরীক্ষে স্বপ্ন মারাই এর মালিকানা পান। সাম্যতা ও ন্যায্যতার সমাজ পরিবর্তনের ভীত তৈরী হয়। এ প্রেক্ষিতে সম্প্রতি স্বপ্ন মা সেরা দশ অনুষ্ঠানের সংকলণে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা বলেন, ‘সুস্থ, সবল ও মেধা সম্পন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দরিদ্র মায়েদের সন্তান ধারণকালে পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করার জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান কর্মসূচি অত্যন্ত সফল প্রমাণিত হয়েছে। মাতৃত্বকালীন ভাতাকেন্দ্রীক স্বপ্ন প্যাকেজ কর্মসূচিটি ১০টি উপজেলায় পাইলট আকারে বাস্তবায়ন করে অত্যন্ত ভালো ফল পাওয়া গিয়েছে। এই কর্মসূচি মায়েদের গৃহ, স্যানিটেশন, সুপেয় পানি ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদন ও সংস্কৃতি কার্ডের মাধ্যমে মায়েরা সচেতন হয়েছে। যার ফলে কর্মসূচি সংশ্লিষ্ট এলাকায় এসডিজি’র অন্যতম লক্ষ্যমাত্রা দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়ন অর্জন সহজ হবে।’
এসডিজির সতের এজেন্ডার এক নং এজেন্ডা ‘দারিদ্র বিমোচন’ কল্পে মাতৃত্বকালীন ভাতা এবং পরবর্তীতে স্বপ্ন প্যাকেজ কর্মসূচিই হতে পারে এর মূল ভিত্তি। দেশের এক কোটি দরিদ্র মা’কে টার্গেট করে ২০ বছর এক প্রজন্ম মেয়াদি ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ কার্যক্রম রাষ্ট্রীয়ভাবে বাস্তবায়ন করা হলে কেউ স্বাস্থ্য, পুষ্টি, স্যানিটেশান, শিক্ষা, গৃহ, কর্মসংস্থানহীন থাকবে না। ফলে দারিদ্র বিমোচনের পাশাপাশি বৈষম্য কমে আসবে এবং দুটি সন্তানের অধিক হবেনা, বাল্যবিবাহ হবেনা, জন্মনিবন্ধনহীন থাকবেনা। তৃণমূল পর্যায়ে মাটি ও মানুষ’র মালিকানা (মা) দানা বাঁধবে। সমাজ, দেশ গঠনে এ জন্য রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ করতে হবে। স্বপ্ন প্যাকেজ কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রয়োজন শুধু ‘এক মা এক লাখ টাকা’ বাজেট বরাদ্দ। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দারিদ্র্য বিমোচনে ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ কার্যক্রম প্রাথমিকভাবে ১০০ উপজেলায় বাস্তবায়ন করার জন্য প্রস্তাবনাটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ঝুলে আছে। মুজিবনগরের স্বপ্ন মা সালমা খাতুন বলেন, ‘স্বপ্ন প্যাকেজ আমার জীবন পাল্টে দিয়েছে। গাভী পালন, সেলাই কাজ ও শাক শব্জি চাষ করে এখন আমার মাসে ১০ হাজার টাকা আয় হয়। সংসারের অভাব দূর হয়েছে।’ টুঙ্গিপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সোলায়মান বিশ্বাস এ সম্পর্কে বলেন, ‘জীবনমান উন্নয়নে ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ কর্মসূচী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দারিদ্র্য বিমোচন তথা এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে আগামীতে ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ কর্মসূচী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আমি মনে করি।’
পরিশেষে বলতে চাই, দারিদ্রের উৎস বন্ধের দিকে নজর না দিলে দারিদ্র বিমোচন হবে না। ‘মাতৃত্বকালীন ভাতা’র গুণগত মান ধরে রাখতে সংখ্যা না বাড়িয়ে মেয়াদকাল ৩ বছরের স্থলে স্কুল ভর্তি পর্যন্ত ৫ বছর করা ও ভাতার পরিমাণ ৮০০ টাকার স্থলে ন্যূনতম গার্মেন্টস শ্রম মজুরিসম ৮ হাজার টাকা প্রদানের দাবী করছি। উন্নয়ন তলরেখা হলো মা। মা হলো এসডিজি’র একের ভেতর সতের। ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার প্রতিফলন। স্বল্প খরচে, সহজ ব্যবস্থাপনা, অংশগ্রহণমূলক ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ মডেল সারা দেশে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন হলেই আজকের মা দিবস উদযাপনের সার্থকতা আসবে। সফল হবে মা দিবস। লেখক: এএইচএম নোমান, প্রতিষ্ঠাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা ও স্বপ্ন প্যাকেজ প্রবর্তনকারী সংগঠন-র্ডপ
The post ১০ মে বিশ্ব মা দিবস: দারিদ্র বিমোচনে স্বপ্ন মা appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3c6n7CJ
No comments:
Post a Comment