আসাদুজ্জামান সরদার ও মিলন বিশ্বাস: ‘ঝরে যাওয়া ফুল ভেসে গেলো বানে, কিনারা নাহি পেলো স্রোতের টানে।’ বলছি-সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কথা। কবিতার মতই নোনা জলের স্রোতে ভেসে চলেছে লক্ষাধিক জীবন।
বাঁধ ভেঙে পানিতে ভাসছে পুরো এলাকা। একটু শুকনো জায়গা নেই। গরু-ছাগল রাখতে হচ্ছে ঘরের মাচানের উপর। এদিকে মাচানের উপরে চুলা পেতে কোন রকমে রান্না করে এক বেলা খাওয়া হচ্ছে। আবার কোন বেলায় শুধু পানি খেয়ে কাটিয়ে দিতে হচ্ছে বানভাসি মানুষের। আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের ২১টি গ্রামের মধ্যে ২০টি সম্পূর্ণ তলিয়ে রয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ইউনিয়নের ৩৬ হাজার মানুষ। নিজেদের থাকার জায়গা নেই সেখানে ১৮শ’ লেয়ার মুরগি (ডিমের মুরগি) নিয়ে জোয়ার-ভাটার সাথে লুকোচুরি খেলছেন আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাহুনিয়ার এলাকার অনিমা বিশ্বাস। অনিমা বিশ্বাস বলেন, ‘আমার আর শান্তি নেই। গত বছর থেকে ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’, গণজাগরনি সমিতিসহ বেশ কয়েটি সংস্থা থেকে ৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে লেয়ার (ডিম পাড়া) মুরগি চাষ শুরু করেছিলাম।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সব শেষ করে দিয়ে গেছে। ঝড়ে ঘরের চালসহ মুরগির খামার উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাতে অনেক মুরগি মারা যায়। এতো টাকার ঋণ কীভাবে শোধ করবে সেটা ভেবে আম্পানের পানি কমলে আরো কয়েকটি সংস্থা থেকে আরও কিছু টাকা ঋণ নিয়ে মুরগি পালন শুরু করেছি। কিন্তু আবারও বাঁধ ভেঙে কপোতাক্ষের নোনা জলে ভাসছে আমার মুরগির খামারগুলো। অনেক মুরগি নোনা পানি খেয়ে মারা যাচ্ছে। কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না। আঠারো শ’ মুরগি নিয়ে কোথায় যাবো। এতো মাংসের মুরগি না যে কম দামে বিক্রি করে দেব। কয়েক দিনে তিন শ’র মতো মুরগি মারা গেছে। এলাকায় জোয়ারের পানি আসলে মুরগি চালের উপর উঠিতে দিতে হচ্ছে। পানি নামলে খেতে দিচ্ছি। জোয়ার-ভাটার সাথে লুকোচুরি করা ছাড়া কোন পথ নেই। ডিম বিক্রির টাকায় পরিববারের ৫জন্য সদস্যদের সংসার চলে। তিনি আরও বলেন, দুই বছরের প্রকল্প। বলে অনেক উঁচু করে ঘর তৈরী করেছিলাম। সামনে বড় জোয়ার আসছে শুনলাম। তখন পানি আরো বৃদ্ধি পাবে। তখন কী হবে জানিনা। জোয়ারের পানিতে অনেক ডিম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মুরগির জন্য খাদ্য আনতে হয় ২০ কিলোমিটার দুর থেকে। কিন্তু সেটাও আর সম্ভব হচ্ছে না। ছয়মাস পোষার পরে ডিম দেওয়া শুরু করে। ডিম দেওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিটি মুরগির পিছনে ৬ থেকে ৭শ’ টাকা খরচ হয়। এখন বিক্রি করলে অনেক লোকশান হয়ে যাবে। না পারছি বিক্রি করতে না পারছি রেখে দিতে। তিনি আরও বলেন, পুরো এলাকা ডুবে গেছে।
আম্পানের সময় বাঁধ ভেঙে পানিতে ডুবে মরতে হয়েছিল আমাদের। তখন পানি কিছুটা কম ছিলো। কিন্তু এবার আমার ঘরের মধ্যে পর্যন্ত পানি প্রবেশ করেছে। গরু ছাগল, হাস-মুরগি এবং সাপের সাথে বসবাস করছি।

নমিতা বিশ্বাসের ছেলে পলাশ বিশ্বাস বলেন, গরু ছাগল নিজের খাটের উপরে রাখতে হচ্ছে। অনেকে নৌকায় করে ডাঙায় আত্মীয় স্বপনের বাড়িতে রেখে আসছে। আমি এমবিএ শেষ করেছি। চাকরির জন্য লেখাপড়া করছি। করোনার কারণে বাধ্য হয়ে খুলনা থেকে বাড়িতে আছি। এসে আরেক বিপদ। মুরগির ডিম বিক্রি করা টাকা দিয়ে আমাদের সংসার চলে। কিন্তু নদীর পানিতে পুরো এলাকা প্লাবিত কারো বাড়ি একটু শুকনা নেই। যে দিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। ভাটায় কিছুটা পানি কমছে। আমার জোয়ার পুরো এলাকা ডুবে যাচ্ছে। জোয়ার-ভাটার মধ্যে পানির সাথে লুকোচুরি খেলছি। আমাদের মতো এই রকম চিত্র সকলের।
কুড়িকাহুনিয়া ক্লাস ফোরের শিক্ষার্থী চঞ্চল বিশ্বাস (১১) জানায়, চারিদিকে পানি আর পানি। একটু নিচে নামতে পারছি না। খেলাধুলা করা পারছি। সব ডুবে গেছে। ঘরের মধ্যে পানি। খাট ভেসে যাচ্ছে। আম্পান থেকে আমাদের এই অবস্থা। আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই। প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়া বেড়িবাঁধ সংস্কার শেষ হতে না হতেই ফের বেড়িবাঁধ ভেঙে সব ভেসে গেছে। মানুষ নি:স্ব হয়ে পড়েছে। এখানকার মানুষ খুবই কষ্টের মধ্যে জীবন যাপন করছে। আমার একটি যাতায়াতের রাস্তা ভালো নেই। একটি মানুষ মারা গেলে তার দাফন করার মতো সৎকার করার মতো জায়গা নেই। তিনি জানান, ইউনিয়নের ২১টি গ্রামের মধ্যে ২০টি সম্পূর্ণ তলিয়ে রয়েছে। খুব দ্রুত যদি বাঁধগুলো সংস্কার করা নায় হয় তাহলে দেশের মানচিত্র থেকে প্রতাপনগর হারিয়ে যাবে। এই ইউনিয়নটি কপোতাক্ষ-খোলপেটুয়া নদীর সাথে মিশে যাবে। আমার ত্রাণ চাই না, আমরা বাঁধ চাই।
The post জোয়ার ভাটার সাথে লুকোচুরি খেলে প্রতাপনগরের মানুষ! (ভিডিও) appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/2QfTmGs
No comments:
Post a Comment