বৈশি^ক আতংকের নাম করোনাভাইরাস। বিশে^র তাবৎ মানুষ করোনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে। কিভাবে করোনাকে পরাজিত করা যাবে তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের ভাবনার অন্ত নেই। তারা বলেছেন টিকা আবিস্কার করে করোনাকে ধরাশায়ী করা হবে।
চীনের উহান প্রদেশে করোনার জন্ম ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ^ব্যাপী। ধনী গরিব সব দেশেই হানা দিয়েছে করোনা। তবে সেই উহান কিন্তু করোনামুক্ত। সেখানকার মানুষের মাঝে ফিরে এসেছে প্রাণচাঞ্চল্য। তা সত্ত্বেও তারা শীত মওসুমে করোনার দ্বিতীয় থাবা নিয়ে চিন্তিত। ইউরোপের কয়েকটি দেশে করোনার থাবায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। তারাও আতংকিত শীত মওসুমে করোনার সম্ভাব্য তান্ডব নিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রে এখনও দৈনিক অগনিত মানুষের প্রাণ ঝরে যাচ্ছে করোনায়। আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতও করোনা সংক্রমণের পাল্লায় পড়ে প্রতিনিয়ত প্রাণহানির হিসাব গুনছে। বাংলাদেশে প্রথম করোনা সনাক্ত হয় চলতি বছর ৮ মার্চ। দেশে করোনা সংক্রমণ চলমান রয়েছে। এ পর্যন্ত দেশে মারা গেছেন সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি মানুষ। তবে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি অন্য দেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম।
সরকার অতি দ্রুত করোনা ইনজেকশন এনে এই মহামারি প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ৫ জানুয়ারী পর্যন্ত দেশে আক্রান্তে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজার ৯২০ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৭ হাজার ৬৭০ জন হয়েছে। মহামারি করোনার এই আতংকের সাথে এবার যুক্ত হয়েছে ডেঙ্গু। এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে করোনা ও ডেঙ্গু এই দুই মহামারিকে রুখতে হবে আমাদের।
বাংলাদেশে করোনার হানা ধরা পড়ে এ বছরের মার্চে। এর পর থেকে টানা আটমাস ধরে করোনা মোকাবেলা করছে মানুষ। করোনাকালে দেশের অভ্যন্তরীন ব্যবসা বানিজ্যে ধ্বস নেমেছে। আন্তর্জাতিক বানিজ্য আমদানি রফতানি খাতও ভঙ্গুর অবস্থার মুখোমুখি। দেশের সব শিল্পখাতও এখন দারিদ্রক্লিষ্ট অবস্থার মধ্যে পড়েছে। দেশের কৃষি ও মৎস্য উৎপাদনও ক্ষতির মুখে পড়েছে।
আমাদের রপ্তানি বানিজ্যের তিনটি প্রধান খাত চিংড়ি কাঁকড়া ও পোশাক সামগ্রী বিদেশে রপ্তানি না হওয়ায় অর্থনীতি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সরকার ক্ষতির মুখে পড়েছে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশে কর্মরত বিভিন্ন স্তরের মানুষও পড়েছে বিপাকে। রেমিট্যান্সে দেখা দিয়েছে আশংকাজনক নি¤œগামিতা।
দেশের স্কুল কলেজ মাদ্রাসা ও বিশ^বিদ্যালয়গুলিতে থেমে গেছে শিক্ষার্থীদের সরব পদচারণা। সেখানে তাদের কলকাকলি আর কানে বাজে না। গৃহবন্দী হিসেবে তারা বাড়িতে লেখাপড়া করছেন বলা হলেও তা যথেষ্ট ফলদায়ক নয়। তারা লেখাপড়া ছেড়ে অন্যদিকে মনোনিবেশ করে দিন দিন শিক্ষা বহির্ভূত হয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অনিয়মে।
অনলাইনে লেখাপড়া করায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা তাদের চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলছে। উচ্চতর শ্রেণিতে উঠতে তারা পরিক্ষা দিতে প্রস্তুত থাকলেও বাস্তবতার কারণে তাদেরকে শিক্ষাঙ্গণে আসা এক রকম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে তারা তাদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত। একই সাথে অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে ভাবনার মধ্যে পড়েছেন।
করোনা ভাইরাসের কারণে সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিও হয়ে পড়েছে ম্লান। রাজনৈতিক দলগুলিও পারছেনা কোনো জনসভা করতে। গণতান্ত্রিক কর্মসূচি দিতেও ভয় পাচ্ছে তারা। সামজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে তারা এসব কর্মসূচি সংকুচিত করে এনেছে। খেলার মাঠগুলিও হয়ে পড়ছে প্রাণহীন।
যে মাঠে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে খেলোয়াড়রা দর্শকদের আনন্দ বেদনার খোরাক যোগাতে তাও বন্ধ হয়ে গেছে। মাঠগুলি এখন প্রাণহীন এক উদোম মাঠে পরিনত হয়েছে। বিনোদন মঞ্চগুলিও এখন জনমানবশূন্য।
গণপরিবহনে মানুষের চলাচল কমে গেছে। ফলে পরিবহন খাতও হয়ে পড়েছে করোনাবন্দী। হোটেল রেস্তরাঁয়ও দেখা দিয়েছে কাস্টমার সংকট। এই খাতও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বিবাহসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠান এখন আর আনন্দের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।
করোনা ভাইরাসের দাপটে দেশের স্বাস্থ্য সেবাও সংকটের মুখে। ডাক্তার ও রোগীদের করোনাভীতি এই সংকটের কারণ। বিশেষ করে যারা বিদেশে চিকিৎসা নিতে চান তারাও রোগযন্ত্রণা নিয়ে গৃহবন্দী হয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সংখ্যা কমে যাওয়ায় বিদেশ গমনও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। দেশের ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে ল্যান্ড বর্ডার যাতায়াতও বন্ধ রয়েছে। সন্মুখসারির যোদ্ধাদের মধ্যে দেশেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে শতাধিক চিকিৎসক। এছাড়া পুলিশ, স্বাস্থ্যকর্মী, সাংবাদিকও মারা গেছেন কয়েক শত।
করোনার কারণে স্বজনদের সাথে শারীরিক সাক্ষাত আত্মীয়তা ও লোক লৌকিকতায় ধ্বস নেমেছে। কেউ কারও বাড়িতে আসা যাওয়া করছেন না। এর ফলে তাদের মধ্যে ক্রমেই সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক দুরত্বের।
দেশের সব জেলা শহরে করোনা শনাক্তের ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনের ব্যবস্থাও অপ্রতুল। দেশের জেলা শহরের হাসপাতালগুলিতে পিসিআর ল্যাব প্রতিষ্ঠার দাবিতে নানা কর্মসূচি চলছে। এদিকে করোনা শনাক্তের নামে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে কিছু সংখ্যক অসাধু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে। তারা নমুনা পরিক্ষা করে অথবা না করেই করোনা পজিটিভ অথবা নিগেটিভ লিখে জনগনের সাথে প্রতারণা করেছে।
এমন কয়েকটি ঘটনা চিহ্ণিত করে সরকার বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার ও কিছু সংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে। এমনকি তাদের প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে সরকার।
আশার কথা সরকার করোনাকালিন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা দিয়েছে। এতে মানুষ সন্তুষ্ট হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষকে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি তাদের শুকনো ও রান্না করা খাবারেরও ব্যবস্থা করেছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
করোনার কারণে শিক্ষায় সেশন জটের সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি চাকুরি প্রত্যাশীদের বয়স ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি খাতগুলিতে চাকুরির সুযোগও হ্রাস পেয়েছে। ফলে সদ্য লেখাপড়া শেষ করা ছাত্রছাত্রীরা বিপাকে পড়ে হতাশায় হাবুডুবু খাচ্ছে। তারা তাদের ভবিষ্যত কর্মজীবন নিয়ে শংকিত।
এদিকে করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মানুষের মুখে উঠেছে মাস্ক। তারা নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছেন। হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে করোনা মোকাবেলায় সচেষ্ট হয়েছেন। মানুষ বহুলাংশে স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠেছে। তারা তাদের শিশুদেরও স্বাস্থ্যবিধি শিক্ষা দিচ্ছেন।
সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি ও করোনা সতর্কতার প্রচার দিয়ে যাচ্ছে। যারা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না এবং জনসমক্ষে চলাফেরার সময় মাস্ক ব্যবহার করছেন না তাদেরকে আটক করে ভ্রাম্যমান আদালতে জেল জরিমানা করা শুরু হয়েছে।
করোনায় ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের মিডিয়া জগত। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলি করোনার ধাক্কা সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। এমন অবস্থায় অনেকেই চাকুরি হারাচ্ছেন। করোনার ভয়াবহতায় দেশে গার্মেন্টস শিল্পগুলি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
করোনা সংক্রমণ রোধে সরকার ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর’ নীতিতে বিশ^াসী। এজন্য করোনা শনাক্তদের যথাযথ চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি এই ভয়ংকর মহামারি প্রতিরোধে টিকার অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিষেধক টিকা হাতে পেলেই সরকার জরুরি ভিত্তিতে তা প্রয়োগের ব্যবস্থা নেবে বলে আগেই জানিয়েছে।
বাইশ লাখ জনগোষ্ঠীর সাতক্ষীরা জেলায় করোনা হানা দিয়েছে ২৭ জুলাই বেশ আগেই। করোনা শনাক্তকরণ এবং রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন ডাক্তাররা। তারা রাতদিন পরিশ্রম করেছেন। রোগীদের আইসোলেশন ব্যবস্থা, কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা সবই করেছেন তারা। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তাররা তাদের খাওয়া ঘুম ছেড়ে দিয়ে রোগীদের সেবায় দিনরাত ব্যস্ত থেকেছেন।
করোনা মোকাবেলায় সরকারি সংস্থার পাশাপাশি বেরকারি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন যে যার সাধ্যমত কাজ করেছেন ও করছেন। কেউ খাবার নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে অসহায় মানুষের পাশে। আবার কেউ স্বাস্থ্য সামগ্রী নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে স্বাস্থ্য সচেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা: হুসাইন সাফায়েত বলেন, করোনা মোকাবেলায় সাতক্ষীরার সাধারণ মানুষের নানাভাবে সহযোগিতা পেয়েছেন। যে কারণে সম্ভব হয়েছে সাতক্ষীরায় করোনা ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায়। বেসরকারি সংস্থার উত্তরণ শ্যামনগর, তালা, কলারোয়াসহ জেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সররারাহ করেছে অক্সিজেন সিলেন্ডারসহ নানা স্বাস্থ্য সামগ্রী।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের তত্ববধায়ক ডা: রফিকুল ইসলাম জানান, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে করোনা নির্ধারিত হাসপতাল করায় নানা সীমাবন্ধতার মধ্যেও ভালো সেবা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। করোনা চিকিৎসার মূল উপাদান অক্সিজেন সরবরাহ ছিল চাহিদা মতো।
কিন্তু রোগীর শরীরে অক্সিজেন দ্রুত দেওয়ার জন্য ছিল না মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হাই ফ্লো নেজেল ক্যানুলা। কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও সামাজিক সংগঠন হাই ফ্লো নেজেল ক্যানুলা সরবরাহ করে করোনা মোকাবেলা এগিয়ে এসে অন্যান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি উত্তরণ সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার, নেবুনাইজার মেসিন ও ওষুধসহ নানা সামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা করেছে। সহযোগিতা করেছেন জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনও। মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা: কাজী আরিফ আহমেদ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মানস কুমার মন্ডল রাতদিন ২৪ ঘন্টা সেবা দিয়ে চলেছেন।
তাদের সেহযোগিতা করেছেন হাসপাতালের অন্যান্য চিকিৎসক, নার্সসহ কর্মচারীরা। সবার সার্বিক প্রচেষ্টায়া অন্ধকারের শত্রুর বিরু্েধ লড়াই করে সাতক্ষীরায় করোনা মৃত্যুর হার কমানো গেছে অনেকাংশে। দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছেন করোনায় আক্রান্ত ও করোনা উপসর্গ নিয়ে আক্রান্ত রোগীরা ।
করোনার এই ভয়াবহতার পরও জীবন থেমে থাকেনা। মানুষ এই অনুবীজ মহামারির বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এই লড়াইয়ে মানুষ একদিন নিশ্চিত জয়লাভ করবে। যেমনটি পোলিও মুক্ত হওয়া সম্ভব হয়েছে। কলেরা বসন্ত টাইফয়েড মুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। দেশে প্রায় শূন্যের কোঠায় মা ও শিশু মৃত্যুর হার। তাই করোনা মহামারিও একদিন পদদলিত হয়ে পড়বে একথা অবিশ^াস করার কোনো কারণ নেই।
ততদিনের অপেক্ষায় বাংলাদেশ। এর পরেই সবাই আবার হাসবে খেলবে, আবারও ফিরে আসবে প্রাণস্পন্দন। ধ্বনিত হবে মুক্ত প্রাণের প্রতিধ্বনি।
লেখক: কল্যাণ ব্যানার্জি, প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা। banerjeepalo@gmail.com
The post একদিন পদদলিত হবেই করোনা appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3pRqHao
No comments:
Post a Comment