আবু রাইহান
শীতকাল খেজুর রসের মরশুম। খেজুর রসের মরশুমে খেজুর ‘রস’ সবার কাছেই খুব আকাঙ্ক্ষার একটি বিষয়। গ্রামীণ জীবনে খেজুর রস মানুষের মনে রসের সঞ্চার করে। মানুষ হয়ে ওঠে রস সন্ধানী। কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র খেজুর রসকে অবলম্বন করে ‘রস’ নামে এক অসাধারণ গল্প লিখেছেন। সে গল্পটি নিছক খেজুর রসের গল্প হয়ে ওঠেনি বরং তা মানব মনের অতি আবেগপ্রবণ জায়গায় গিয়ে আঘাত করে এবং তা পাঠে পাঠক বিহŸল হয়ে পড়েন। রবীন্দ্র উত্তর বাংলা ছোটগল্পে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জল চল্লিশের দশকের অন্যতম কথাশিল্পী নরেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯১৬-১৯৭৫)। তাঁর গল্পের বিষয় ও কাঠামোগত বিন্যাস বাংলা ছোটগল্প তো বটে, বিশ্ব ছোটগল্পের প্রতিদ্ব›দ্বী। পাঠককে নিমগ্নচিত্তে গল্পপাঠে মুগ্ধতার সাথে ধরে রাখার এক অসামান্য শিল্পশক্তির আধার তাঁর গল্প।অথচ বাংলা ছোটগল্প পরিমÐলে নরেন্দ্রনাথ মিত্র অনেকটাই অনালোচিত-অনালোকিত। সাহিত্য জীবনের প্রারম্ভে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক উত্তাপ ও তা থেকে সৃষ্ট নির্মম পরিণতি তাঁর লেখক মনের ভেতরকে নাড়িয়ে দেয়। তিনি হয়ে ওঠেন জীবনঘনিষ্ঠ কথাকোবিদ। তাঁর গল্পের মধ্যে উঠে আসতে থাকে ঘরহারা অসহায় মানুষ। জীবনে অর্জিত বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর উন্মূল এই মানুষের মানবিক মর্যাদাকে সাহিত্যে প্রতিফলিত করতে কলম ধরেন । মানব কল্যাণের দৃঢ় শপথে বলীয়ান নরেন্দ্রনাথ মিত্র রবীন্দ্রনাথকে স্বীকার করে, তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে স্ব-বৈশিষ্ট্যে কথাসাহিত্য ভুবনে হয়ে ওঠেন একক ও অনন্য কথাকার।তিনি নিজে যে জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, ঠিক সেই জীবনের নিখুঁত ছবি তিনি নির্মোহ বাস্তবতায় গল্পে তুলে ধরেছেন।নরেন্দ্রনাথ মিত্র‘চাঁদমিঞা’, ‘কাঠগোলাপ’, ‘চোর’, ‘রস’, ‘হেডমাস্টার’, ‘পালঙ্ক’, ‘ভুবন ডাক্তার’, ‘সোহাগিনী’, ‘আবরণ’, ‘সুহাসিনী তরল আলতা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য গল্পের ¯্রষ্টা । তাঁর প্রায় পাঁচ শত গল্পে অর্থনৈতিক-সামাজিক-মানসিক টানাপড়েন থাকলেও এক পর্যায়ে গল্পগুলো হয়ে উঠেছে মানব মানবীর জীবনের গল্প।
তাঁর ছোটগল্পগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা পাঠকপ্রিয় ‘রস’ গল্পটি নিয়ে নাটক, টিভি সিরিয়াল ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের‘রস’ গল্পের অবলম্বনে হিন্দি চলচ্চিত্র ‘সওদাগর’-এ বিশ্বখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন অভিনয় করেছেন। তাঁর নিজের কথা থেকেই উপলব্ধি করা যায় তিনি তাঁর নিজের দেখা ঘটনাপ্রবাহকে গল্পের আকারে রস গল্পে তুলে এনেছেন। এ গল্পে তিনি তাঁর পরিচিতদেরেকে সুপরিচিত করে তুলেছেন।তাঁর গল্পমালা -১ এর ভূমিকায় ‘রস’ গল্প সম্বন্ধে নরেন্দ্রনাথ মিত্র বলেছেন, ‘এ গল্পের যে পটভূমি তা আমার খুবই পরিচিত। পূর্ববঙ্গে আমাদের গ্রামের বাড়িতে পূর্বদিকে ছিল একটি পুকুর। সেই পুকুরের চারধারে ছিল অজ¯্র খেজুর গাছ। ছেলেবেলা থেকে দেখতাম আমাদের প্রতিবেশী কিষাণকে সে সব খেজুর গাছের মাথা চেঁছে মাটির হাঁড়ি বেঁধে রাখত। বাঁশের নল বেয়ে সেই হাঁড়িতে সারারাত ধরে ঝির ঝির করে রস পড়ত। সেই রস কড়াইতে করে, বড় বড় মাটির হাঁড়িতে করে জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করতেন আমাদের মা-জেঠীমারা। শীতের দিনে রস থেকে গুড় তৈরির এই প্রক্রিয়া মায়ের পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে রোজ দেখতাম। আমাদের চিরচেনা এই পরিবেশ থেকে ‘রস’ গল্পটি বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু রসের যে কাহিনী অংশ; মোতালেফ, মাজু খাতুন আর ফুলবানুকে নিয়ে যে হৃদয়দ্ব›দ্ব, খেজুর রসকে ঘিরে রূপাসক্তির সঙ্গে যে জীবিকার সংঘাত তা কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আসেনি। সেই কাহিনী আমি দেখিওনি, শুনিওনি। তা মনের মধ্যে যেন আপনা থেকেই বানিয়ে বানিয়ে উঠেছে।’
গল্পকার তার গ্রামে দেখা একটা সাধারণ ঘটনাকে অবলম্বন করে উঁচুদরের শিল্পোত্তীর্ণ, রস সমৃদ্ধ ‘রস’ গল্পটি রচনা করেছেন। এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আছে মোতালেফ গাছি। সে নারী বিলাসী প্রেমিক পুরুষ হলেও জীবন ও যৌবনের চাহিদা মেটানোর জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করতে সে কসুর করেনি।
তাঁর ‘রস’ গল্পের শুরুটা এমন:‘কার্তিকের মাঝামাঝি চৌধুরীদের খেজুরগাছ ঝুড়তে শুরু করল মোতালেফ। তারপর দিন-পনেরো যেতে-না-যেতেই নিকা করে নিয়ে এল পাশের বাড়ির রাজেক মৃধার বিধবা স্ত্রী মাজু খাতুনকে। পাড়াপড়শি সবাই অবাক। এই অবশ্য প্রথম সংসার নয় মোতালেফের। এর আগের বউ বছরখানেক আগে মারা গেছে। তবু পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের জোয়ান পুরুষ মোতালেফ। আর মাজু খাতুন ত্রিশে না-পৌঁছলেও তার কাছাকাছি গেছে। ছেলেপুলের ঝামেলা অবশ্য মাজু খাতুনের নেই। মেয়ে ছিল একটি, কাটিখালির সেখেদের ঘরে বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ঝামেলা যেমন নেই, তেমনি মাজু খাতুনের আছেই-বা কী? বাক্স-সিন্দুক ভরে যেন কত সোনাদানা রেখে গেছে রাজেক মৃধা, মাঠ ভরে যেন কত ক্ষেত-খামার রেখে গেছে যে তার ওয়ারিশি পাবে মাজু খাতুন। ভাগের ভাগ ভিটার পেয়েছে কাঠাখানেক, আর আছে একখানি পড়ো পড়ো শণের কুঁড়ে। এই তো বিষয়-সম্পত্তি, তারপর দেখতেই-বা এমন কী একখানা ডানা-কাটা হুরির মতো চেহারা। দজ্জাল মেয়েমানুষের আঁটসাঁট শক্ত গড়নটুকু ছাড়া কী আছে মাজু খাতুনের যা দেখে ভোলে পুরুষেরা, মন তাদের মুগ্ধ হয়।’
মাজু খাতুনকে বিয়ে করার পাড়া প্রতিবেশী মহিলারা মোটেই খুশি নয়। তারা মনে করে দজ্জাল স্বভাবের মাজু তুকতাক করে মোতালেফ গাছিকে বশ করেছে। মোতোলেফের ইচ্ছে ছিল কম বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করার, সে চেষ্টাও কিন্তু কম করেনি। কিন্তু অল্প বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করতে অনেক পয়সা কড়ি দরকার। চরকান্দার এলেম শেখের আঠার-উনিশ বছরের মেয়ে ফুলবানুকে মোতালেফ এর বেশি মনে ধরেছিল। কিন্তু ফুলবানুকে পাওয়ার জন্য তার বাবাকে অনেক টাকা দেওয়া লাগবে, তার সে কোথায় পাবে! তবুও ফুলবানুকে পাওয়ার জন্য সে কম চেষ্টা করেনি।আমরা আবার নরেন্দ্র গল্প থেকে উদ্ধৃত দিতে পারি।‘ইতোমধ্যে অবশ্য এক হাত ঘুরে এসেছে ফুলবানু। খেতে-পরতে কষ্ট দেয়, মারধর করে এসব অজুহাতে তালাক নিয়ে এসেছে কইডুবির গফুর সিকদারের কাছ থেকে। আসলে বয়স বেশি আর চেহারা সুন্দর নয় বলে গফুরকে পছন্দ হয়নি ফুলবানুর। তালাক নেয়া হলেও ‘চেকনাই ও জেল্লা’ দেহ আর রসের ঢেউ খেলা মন মোতালেফকে টেনেছে বিশেষভাবে; ‘ফরসা ছিপছিপে চেহারা’ আর ‘ঢেউ খেলানো টেরিকাটা বাবরিওয়ালা’ খেজুর রসের কারবারি মোতালেফকেও চোখে ধরেছে ফুলবানুর।’ ফুলবানুকে বউ হিসাবে পাওয়ার জন্য টাকা দিতে না পেরে মনঃক্ষুণœ হয়ে মোতালেব ফুলবানুর বাবার কাছ থেকে বাড়ি ফেরার সময় পথে জঙ্গলের ধারে মুখোমুখি হয় ফুলবানুর । ফুলবানু মোতালেফকে বলে-‘কী মেঞা, গোসা কইরা ফিরা চললা নাকি? পছন্দসই জিনিস নেবা, বাজানের গুনা, তার দাম দেবা না?ৃ শোনো, বাজানের মাইয়া টাকা চায় না, সোনাদানাও চায় না, কেবল মান রাখতে চায় মনের মাইনষের। মাইনষের ত্যাজ দেখতে চায়, বুঝছ ?’ মোতালেফ ফুলবানুকে ঘরে তোলার জন্য ব্যাকুল। জানায় : ‘শীতের কয়ডা মাস যাউক, ত্যাজও দেখাব, মানও দেখাব। কিন্তু বিবিজানের সবুর থাকবেনি দেখবার ?’
কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র তার চিরচেনা দৃশ্যপট থেকে আহরিত অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তার রস গল্পে নারীর মন ও শরীর থেকে পুরুষের রস সংগ্রহের কলাকৌশল তুলে ধরেছেন। একজন গাছিকে খেজুর গাছের শক্ত মাথা থেকে রস সংগ্রহ করতে পরিশ্রান্ত হতে হয়। নিয়মকানুন মেনে খেজুর গাছের মাথায় বাঁধা হাড়িতে সারারাত টুপটাপ শব্দ করে রস পড়ে হাড়ি রসে পূর্ণ হয়।
মোতালেফ তার কারবারের জন্য মাঝ বয়সী মাজুকে বিয়ে করলেও তার মনের মতো বউ না পেয়ে মোতালেফ কিন্তু খুশি নয়। কারণ, তার মন জুড়ে ছিল যুবতী নারী ফুলবানু। তাকে বিয়ে করার জন্য দরকার টাকা, আর সেই টাকা জোগাড় করার জন্যই খেজুর রস থেকে গুড় বানানোর জন্যই সে আপাতত মাঝবয়সী মাজুকে বিয়ে করেছে।তার প্রয়োজন ‘রসের মানুষ’ যুবতী নারী! মাঝবয়সী শাশুড়ি হয়ে-যাওয়া মাজুকে দিয়ে তার বেশিদিন চলে কি?মাজুবিবির স্বভাব-চরিত্র ভার না এই অভিযোগে তাকে তালাক দিয়ে মোতালেফ ফুলবানুকে ঘরে তুলল। রসের কারবারী মোতালেফ যৌবনবতী ফুলবানুকে বিয়ে করে ঘরে তুলে দু’দিক থেকেই লাভবান। ফুলবানুর পূণ্র্ যৌবনের রস ও খেজুর গাছের রস উপভোগ করে মোতালেফের অবস্থা রমরমা। জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য মোতালেফ মাজু বিবির সঙ্গে প্রতারণা করে ফুলবানুকে লাভ করলেও তার নতুন বউ ফুলবানুর কাছ থেকে কাম রস আহরণ করতে পারলেও দিনের আলোয় রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানানোর বিষয়ে ফুলবানুর অভিজ্ঞ না থাকায় এদিক থেকে তেমন সুবিধা পায় না ফুলবানু থেকে।এদিকে মোতালেফের কাছ থেকে তালাক পেয়ে মাজু কিন্তু নিরাশ্রয় ভাবে থাকতে পারে না, তারও একটা আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়।শেষমেশ সে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক মাঝবুড়োকে বিয়ে করে।
মাজুর মতো অনাথা মেয়েমানুষ বিপদের সময় মোতালেফের পাশে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু সুসময়ে তাকে তাড়িয়ে দেওয়ায় বিধাতা যেন মোতালেফের প্রতারণাকে মেনে নিতে পারেননি। যৌবনের তাড়নায় মোতালেফ রসে ভরা যুবতী ফুলবানুকে বিয়ে করার পর মোতালেফ গাছির ঘরে কিন্তু শান্তি যেন আসেনি। এক সময় তার খেজুর গুরে কারবার লাটে ওঠে। সৌখিন শাড়ি পরা যুবতী ফুলবানু রসের সৌয়ামীর অপেক্ষায় প্রহর গোনে সেই ফুলবানুকে দিয়ে রস থেকে বাজারে-চলা গুড় বানানো হয়ে ওঠে কী করে! এ কারণেই গুড়ের ব্যবসা, বছর ঘুরতেই লাটে ওঠে মোতালেফের। সংসারে শুরু হয় অশান্তি, যা শেষমেশ মারামারি-গালাগালিতে পৌঁছে।
এক সময় মোতালেফের মন খারাপ হয়। সে নিজের ভুল বুঝতে পারে। মাজুর জন্য যেন তার মন কাঁদে। তার মন চায় মাজুর কাছে ছুটে যেতে। তাই সে একদিন মাজুর নতুন স্বামী নাদির মিঞার বাড়িতে ছুটে যায়। সঙ্গে নেয় রসের হাঁড়ি তাকে খাওয়ানোর জন্য নয়। মাজু রস জ্বাল দিয়ে খানিকটা গুড় তৈরি করে দিক, সে গুড় অজানা হাটে অচেনা খদ্দেরের কাছে বিক্রি করে মোতালেফ তার হারানো গুড়ের সুনাম ফেরাতে চায়। অতিথি হিসেবে নাদিরের কাছে মোতালেফ সমাদর পায়, কিন্তু ক্ষোভে-লজ্জায় অপমান করতে উদ্যত হয় মাজু। তারপরও কথা থাকে। প্রকৃতির নিয়ম বড় বিচিত্র! ভেতরে ভেতরে বোধ করি মোতালেফের জন্য মাজুরও মন কাঁদে। ভালোবাসি এ কথাটি সবসময় বলার প্রয়োজন পড়ে না। না বলা কথা, চোখের ভাষায় অনেক সময় সেটা বুঝে নিতে হয়। মোতালেফ এবং মাজু খাতুনের এ ভালোবাসা যেন এক অন্য প্রান্ত স্পর্শী। এখানে কাম নেই, ক্রোধ নেই, প্রয়োজন নেই আছে শুধু দুজনের দুচোখের অভিভ্যক্তিতে ফুটে ওঠা কোনো বিস্ময়। রস নিয়ে গল্পটি লেখা হলেও শেষ পর্যন্ত মর্যাদা পেয়েছে এক রসোত্তীর্ণ গল্পের।
The post অনুচ্চারিত ভালোবাসার রস’র গল্প পৃথিবীর appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/34UXNO5
No comments:
Post a Comment