আবু রাইহান
গান জিনিসটা কেবল শোনার বিষয় নয়! এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হৃদয় ও মন দিয়ে উপলব্ধির বিষয়টিও! রবীন্দ্র ও নজরুল সংগীত গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলে তবে বিষয়টি উপলব্ধ হয়! আমাদের কাছে বর্ষার গান শুধু গান হয়ে থাকে না।আকাশ ঝেঁপে মুষলধারে বৃষ্টি নামলে আমাদের মন নস্টালজিক হয়ে ওঠে! স্মৃতিতে ভেসে ওঠে ফেলে আসা জীবনের ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনার সব অনুভূতি! আমাদের মনকে বিষণ্ন এবং উদাসীন করে!হঠাৎ করে আমরা হারিয়ে যাই মন কেমন করা অদ্ভুত এক ভাবনার গভীরে! প্রকৃতির ছয়টি ঋতুর মধ্যে বর্ষাই ছিল রবীন্দ্রনাথের সর্বাধিক প্রিয়। কবির কল্পনাকে সবচেয়ে বেশি আবিষ্ট করে রেখেছিল বর্ষা ঋতু।
‘বহু যুগের ও পার হতে আষাঢ় এল আমার মনে,
কোন সে কবির ছন্দ বাজে ঝরো ঝরো বরিষনে।
যে মিলনের মালাগুলি ধুলায় মিশে হল ধূলি
গন্ধ তারি ভেসে আসে আজি সজল সমীরণে।
সে দিন এমনি মেঘের ঘটা রেবানদীর তীরে,
এমনি বারি ঝরেছিল শ্যামলশৈলশিরে।
মালবিকা অনিমিখে চেয়ে ছিল পথের দিকে,
সেই চাহনি এল ভেসে কালো মেঘের ছায়ার সনে ।’
এ গানটিতে কবি কেবল কালিদাস আর তাঁর “মেঘদূতের” সমকালীন বর্ষণমুখর আষাঢ়ের রমণীয় পরিপার্শ্বের মনোরম ভাষাচিত্রই তুলে ধরেননি, একই সঙ্গে জড়িত বিরহ-মিলনের ভাবাবেগ যে তাঁর মুগ্ধ মনেও সঞ্চারিত হয়েছে এবং বহু যুগ পূর্বের বিরহী ও বিরহিনীর উদ্বেগী প্রতীক্ষার রোমাঞ্চিত অনুভূতির আবেদন তাঁর যুগেও এতটুকুও কমেনি-এই পরিতৃপ্তিটুকুও ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘আজি শ্রাবণ ঘন- গহন- মোহে
গোপন তব চরণ ফেলে
নিশার মতো নীরব ওহে
সবার দিঠি এড়ায়ে এলে।
প্রভাত আজি মুদেছে আঁখি,
বাতাস বৃথা যেতেছে ডাকি,
নিলাজ নীল আকাশ ঢাকি
নিবিড় মেঘ কে দিল মেলে।
কূজনহীন কাননভূমি,
দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে,
একেলা কোন পথিক তুমি
পথিকহীন পথের ‘পরে।
হে একা সখা, হে প্রিয়তম,
রয়েছে খোলা এ ঘর মম,
সমুখ দিয়ে স্বপনসম
যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে।’
এই গানটিতে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে শ্রাবণকে দেখেছেন, সেই শ্রাবণ কিছুটা স্বরূপে প্রকাশিত হয়েছে। ‘গীতাঞ্জলি’র এই গানটি মাধুর্যময় ঈশ্বরতত্ত্বের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হলেও সেই ঈশ্বর তথা সখা ও প্রিয়তমের সম্মুখ উপস্থিতির জন্যে বর্ষা প্রকৃতির এক অপূর্ব স্নিগ্ধ প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে এতে।কল্পনায় সুন্দরের ও প্রেমিকের অভিসার প্রত্যক্ষ করা হয়েছে।
‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা,
নিশীথযামিনী রে।
কুঞ্জপথে সখি, কৈসে যাওব
অবলা কামিনী রে।
উন্মদ পবনে যমুনা তর্জিত
ঘন ঘন গর্জিত মেহ।
দমকত বিদ্যুত,পথতরু লুণ্ঠিত,
থরহর কম্পিত দেহ।
ঘন ঘন রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম
বরখত নীরদপুঞ্জ।
শাল-পিয়ালে তাল-
তমালে নিবিড় তিমিরময় কুঞ্জ।’
এখানে প্রমত্ত বর্ষার উদ্দাম রূপ নেই, বর্ষণস্তম্ভিত মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, আর শ্রাবণের এক মোহসঞ্চারী গহন গভীর স্তব্ধতা, কবির ভাষায় নিশার মতো নীরব। এই পরিবেশ সবার অলক্ষ্যে যাত্রা পথিকের।
‘আবার শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে,
মেঘ-আঁচলে নিলে ঘিরে!
সূর্য হারায়, হারায় তারা
আঁধারে পথ হয়-যে হারা,
ঢেউ দিয়েছে নদীর নীরে!
সকল আকাশ, সকল ধরা
বর্ষণেরই-বাণী-ভরা।
ঝরো ঝরো ধারায় মাতি
বাজে আমার আঁধার রাতি,
বাজে আমার শিরে শিরে!’
এ গানটিতেও আমরা দেখি রবীন্দ্র উপলব্ধ মাধুর্যময় ঈশ্বরতত্ত্ব অন্তর্লীন হয়ে আছে। তবে গানটির চিত্রময় বাণী আগাগোড়া বর্ষার রূপময়তায় আচ্ছন্ন। মনে হয় প্রতি বছরের মতো বর্ষা ঋতুই বুঝি শ্রাবণ হয়ে ফিরে এসেছে। সেই শ্রাবণ বর্ষনে আপ্লুত হয়ে থাকার আনন্দই যেন সমগ্র গানটির উপভোগ্য রস। দিনের সূর্য আর রাতের তারাকে মেঘ আঁচলে ঘিরে নিয়ে পথ অন্ধকার করে নদীতে ঢেউ তুলে শ্রাবণরূপে নেমে এলো চিরকালে বর্ষা, আর তাতেই আকাশ ও পৃথিবী ভরে গেল বর্ষণের বাণীতে। অবিরল বৃষ্টিধারায় অন্ধকার রাত হলো বর্ষণগীত ঝংকৃত।
‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদরদিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতেই কেন মন লাগে না।
এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে উ
£ান্ত মেঘে মন চায়
মন চায় ঐ বলাকার পথখানি নিতে চিনে।
মেঘমল্লারে সারা দিনমান
বাজে ঝরনার গান।
মন হারাবার আজি বেলা, পথ ভুলিবার খেলা- মন চায়
মন চায় হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে।’
বর্ষণের মাদকতা নিয়ে বাঙালি কবির নান্দনিক আবেগ চিরন্তনের ঘরে পৌঁছায়। পরিবেশের গুণে মনের ভুবনটা তখন পালটে যায়।মেঘ-মাখা বৃষ্টি ঝরানো আকাশের দিকে তাকালেই মন উদাস হয়ে যায়! বৃষ্টি পতনের দৃশ্য কবির মতো আমাদের মনকেও রোমান্টিক এবং বিরহী করে তোলে! শ্রাবণরাতের বিরামহীন বৃষ্টিধারা বিষ্ণনতার সুগভীর প্রকাশ ঘটায়।
ঋতু বৈচিত্রে রবীন্দ্রনাথ গানগুলিকে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এ ষড়ঋতু অনুযায়ীই ভাগ করে গীতবিতানে গ্রন্থিত করেছেন।সংখ্যার দিক থেকে বর্ষার গান সবচেয়ে বেশী! কাজী নজরুল ইসলামের গানের সংখ্যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের চেয়ে বেশী। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতেই গীতবিতানে গানগুলোকে পর্যায় বা পর্বে ভাগ করে রেখে গেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের সে সৌভাগ্য হয়নি। তাছাড়া ব্যক্তি জীবনের ছন্নছাড়া অবস্থা তাঁর রচনা বিশেষকরে গানগুলোর বেলাতেও দেখা যায়।গানের সংখ্যা বিচারে রবীন্দ্রনাথের মতো কাজী নজরুল ইসলামের গানেও বর্ষার গানের আধিক্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানের চেয়ে নজরুলের বর্ষার গানে ভারতীয় ঐতিহ্যের দেখা বেশী বেশী করে মেলে। নজরুল কালীদাসের মেঘদূত থেকে বিভিন্ন ইমেজ তাঁর গানে নিয়েছেন, যেমন নিয়েছেন রাধা-কৃষ্ণের কাজুরী কিংবা ঝুলনের আংগিক।
১.‘যাও মেঘদূত, দিও প্রিয়ার হাতে
আমার বিরহলিপি লেখা কেয়া পাতে
আমার প্রিয়ার দিরঘ নিশাসে
থির হয়ে আছে মেঘ যে দেশেরই আকাশে
আমার প্রিয়ার স্লান মুখ হেরি
ওঠে না চাঁদ আর যে দেশে রাতে
পাইবে যে দেশে কুন্তল-সুরভি বকুল ফুলে
আমার প্রিয়া কাঁদে এলায়ে কেশ সেই মেঘনা কুলে
স্বর্ণলতার সম যার ক্ষীণ করে
বারে বারে কঙ্কণ-চুড়ি খুলে পড়ে
মুকুল-বাসে যথা বরষার ফুলদল
বেদনায় মূর্চ্ছিয়া আছে আঙিনাতে।।’
২.‘শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এল না
বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না।
ধানী রং ঘাগরি, মেঘ-রং ওড়না
পরিতে আমারে মাগো, অনুরোধ ক’রো না
কাজরির কাজল মেঘ পথ পেল খুঁজিয়া
সে কি ফেরার পথ পেল না মা, পেল না।
আমার বিদেশিরে খুঁজিতে অনুক্ষণ
বুনো হাঁসের পাখার মত উড়– উড়– করে মন।
অথৈ জলে মাগো, মাঠ-ঘাট থৈ থৈ
আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই?
কদম–কেশর বলে, ‘কোথা তোর কিশোর’,
চম্পাডালে ঝুলে শূন্য দোলনা।’
৩.‘সখী বাঁধলো সখী বাঁধলো বাঁধলো ঝুলনিয়া
নামিল মেঘলা, মোর বাদরিয়া,
চলো কদম-তমালতলে গাহি কাজরিয়া
চলো লো গোরী শ্যামলীয়া।
বাদল-পরীরা নাচে গগন-আঙিনায়
শোনো ঝমাঝম বৃষ্টির নুপুর পায়ে,
এ হিয়া মেঘ হেরিয়া, ওঠে মাতিয়া।
মেঘ-বেণীতে বেঁধে বিজলী জরিন-ফিতা
গাহিব দুলে দুলে শাওন গীতি-কবিতা,
শুনিব বঁধুর বাঁশি বনহরিণী চকিতা
দয়িত বুকে হব, বাদল রাতের দয়িতা,
পরো মেঘনীল শাড়ি ধানী-রঙ চুনরিয়া
কাজলে মাজি লহ, আঁখিয়া।’
৪.‘পরদেশী মেঘ যাওরে ফিরে
বলিও আমার পরদেশীরে।।
সেদেশে যবে বাদল ঝড়ে
কাঁদেনা কি প্রান একেলা ঘরে
বিরহ ব্যাথা নাহি কি সেথা
বাজেনা বাঁশী নদীর তীরে।
বাদল রাতে ডাকিলে পিয়া
ডাকিলে পিয়া পিয়া পাপিয়া
বেদনায় ভরে ওঠে নাকি রে কাহার হিয়া।
ফোটে যবে ফুল ওঠে যবে চাঁদ
জাগেনা সেথা কি প্রানে কোন সাধ
দেয়না কেহ গুরু গঞ্জনা
সে দেশে বুঝি কুলবতি রে।’
৫.‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে।
ভুলিও স্মৃতি মম, নিশীথ স্বপন সম
ভুলিও স্মৃতি মম, নিশীথ স্বপন সম
আঁচলের গাঁথা মালা ফেলিও পথ পরে।
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে।
ঝুরিবে পুবালি বায় গহন দূর বনে
রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে
বিরহি কুহু কেকা গাহিবে নীপশাখে
যমুনা নদী পাড়ে শুনিবে কে যেন ডাকে
বিজলী দ্বীপশিখা খুজিবে তোমায় প্রিয়া
দুহাতে ঢেকো আঁখি যদিগো জলে ভরে।
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে।’
গানগুলিতে শুধু কথায় ইমেজের ব্যবহার নয়, নজরুল সুরেও কীর্তনসহ অনেক দেশীয় রাগ-রাগিনীর ব্যবহার করেছেন।নজরুলের গানে বর্ষা এসেছে একেবারে দেশজ কথা ও সুরের মূর্চ্ছণা নিয়ে। বিরহ ও বিরহী মন বর্ষায় কেমন উতলা হয়ে ওঠে, নর-নারীর মনের মতো বদলে যায় প্রকৃতির রূপও।সবার জীবনে বর্ষা আসে।যাপিত জীবন আমরা যখন হাঁপিয়ে উঠি তখন বর্ষা আসে শীতল, সজীব পরশ নিয়ে।কদম ফুল ফোটে, ভালোবাসার অনুরাগে। দিগন্ত জুড়ে ধ্রুপদী সংগীতের সুর ভেসে আসে।
‘বাইরে বৃষ্টি হলে ভেতর কাদা হয় না,
ভেতরের কাদা আবহমান,
প্রিয় বৃষ্টির আশায় অপেক্ষমান
ভেতরে আসলে তেমন করে
কোনোদিনই বৃষ্টি হয় না
অথচ অনন্ত আকাশ জুড়ে এই পৃথিবীর
কোথাও না কোথাও অহরহ বৃষ্টি পড়ে!’
The post পরদেশী মেঘ যেও না ফিরে appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3ApG7ZN
No comments:
Post a Comment