Friday, July 2, 2021

এক স্কুল মাষ্টারের গল্প https://ift.tt/eA8V8J

শহীদুল হক বাদল
মরহুম আব্দুল আজিজ শাহ্- আমার বাবা। মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। ঘরের দেয়ালে ঠাঙানো তাঁর হাস্যোজ্জ্বল ছবিটির উপর চোখ পড়লেই যেন জলরঙের ঢেউ খেলে যায় পুরনোদিনের ধূসর সব স্মৃতিগুলোয়। তিনি আমাদের দাদা-দাদিসহ পরিবারের প্রায় বার-তেরজন সদস্যের যাবতীয় ব্যয়ভার একাই বহন করেছিলেনও বহুকাল। কোনোরুপ হতাশা বা ক্লান্তিবোধে তাকে পরাস্ত হতেও দেখিনি কোনোদিনই সেভাবে। অসীম সাহসী সেই মানুষটি আজ আর ইহজগতে নেই। মনে পড়ে তবুও, বাবার অসংখ্য ফেলে আসা বিস্মৃত স্মৃতিও।
(২)
বয়সে আমার বেশ ছোটই, এক বোন প্রায়ই সে সুন্দর একটি খেলনার জন্য কান্নাকাটিও করতো। সেই বোনের জন্য খেলনা কেনার দিন আমিও বাবার সঙ্গে মোহনগঞ্জ বাজারে ’লক্ষী ষ্টোরে’ গিয়েছিলাম সেদিন। সম্ভবত, আমার পছন্দকরা সেই খেলনাটির দাম ছিল-প্রায় দু’শত টাকা। এতোটা দাম শুনেই চিন্তিত চেহারায় বাবা’র একরকম বিমর্ষতাও ফুটে ওঠে তৎক্ষণাৎ। অতঃপর, বিশ-ত্রিশ টাকা দামেরই একটি ঝুনঝুনি খেলনা কেনা হলো বোনের জন্য। বাবা তাঁর সামর্থ্যের অপারগতা গোপন করতেই হয়তোবা সিগ্রেট ধরিয়ে ঘন-ঘন ধোঁয়া ছাড়ছেন বাতাসে। আমি এতোসব নাবুঝেই বোকার মতেই বাবাকে তখন প্রশ্ন করিও- ’আমাদের বেশী টাকা-পয়সা নেইনা বাবা। এই দামী খেলনাগুলো তবে কারা কেনে’?
ঐকথা শুনে বাবাও উদাস নয়নে আকাশেপানে তাকিয়ে আমার মাথায় হাত শুধু স্নেহের বুলালেন। তখন বাবার বাম হাতটি আমিও বেশ শক্তভাবেই আঁকড়ে ধরে তাকে সাহস যোগাই হয়তোবা।
(৩)
বোঝে ওঠার বয়স থেকেই, বাবাকে আমরা সবাই অসম্ভব একজন রসবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবেই জেনে আসছিও। এলাকাজুড়েই তাঁর বেশ সুনাম ও সুখ্যাতিও ছিলো। একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি খেলাধুলা ও স্কাউটিং কার্যক্রম পরিচালনাও করেছেন দীর্ঘকাল সময়। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরাও বাবাকে অসম্ভব শ্রদ্ধাভরেই ভালবাসতো। বিশেষ করে, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত ছাত্রছাত্রীরা বাবাকে খুব বেশীই পছন্দ করতো বলেই জানি। কারণ, ওরা অনেকেই পড়াশুনায় কিছুটা বেখেয়ালী হয়ে থাকে বিধায়, বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণের জন্য শেষভরসা হিসেবে ওরা বাবাকেই আঁকড়ে ধরতো আশার প্রদীপ হিসেবেই। কয়েকটা বিষয়ে ফেল করা সেইসব ছাত্রছাত্রীদের পরবর্তী ক্লাশে উত্তির্নের জন্য বাবাকে প্রধান শিক্ষক বা স্কুল কমিটির নিকট সুপারিশ জানাতে চিনে-জোঁকের মতোই লেগে থাকতেও দেখেছি। বাবার সেই অসীম মমত্ববোধ হয়তোবা আজও তাঁর ছাত্রছাত্রীদের সবাইকে কিছুটা হলেও মনের ভেতরে নাড়া দেয়। তাছাড়াও, আমাদেরই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক যেমন- শামছুল হক স্যার, সামছুল হুদা স্যার-(টি.টি স্যার), কুতুবউদ্দিন স্যার, ব্রজেন্দ্র স্যার, মোস্তফা স্যার, আজিজ স্যার, আব্দুল হেকিম স্যার, আলী উসমান স্যার, ওহাব স্যারসহ আরো অনেকেরই স্মৃতীকথা আমাদের মনের গভীরে আজও ধ্রুবতারার মতেই জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে আলোকিত করেই চোখের মণিকোঠায়।
(৪)
ক্লাস শেষ করেই পরিচিত অনেক দোকানপাঠসহ বাবার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডাঃ সুনীল বাবুর ফার্মেসীতেই বেশীসময় ধরে জমিয়ে আড্ডা দেয়ার পর ব্যাগভর্তি বাজার-সওদা নিয়ে প্রায়ই বেশ রাত করেও বাবা বাড়িতে ফিরতেন। ঐদিন আমার মা হ্যারিকেন হাতে পুকুরদ্বারে বাবার জন্য অপেক্ষায় থাকতেন অধীর হয়ে। বেশী রাত করে বাড়িতে ফেরার বাবার এই অভ্যাসের জন্য মাও এমনি এমনি রাগ দেখিয়েই বাবাকে বলতেন- ’কী গো শিরীনের বাপ, আপনার কী কোনোই কান্ডজ্ঞানও নাই? এই রাইতের বেলায় ক্যান আধপঁচা এতোগুলো মাছ নিয়া আইছেন। এগুলো এখন কে কূঁটাবাছা করবোও শুনি?
মা আমার মুখে যাই বলুক, তিনি সেই মাছগুলো কেটে বেশ যতœ করেই বিভিন্ন পদের তরকারী রান্না করে গরম গরম বাবাকে খেতে দিতেন। আমাদের সব ভাইবোনেরা বিছানায় শুঁয়ে শুঁয়ে ঝাল কাঁচামরিচ হাতে আধপঁচা মাছের মুড়িঘণ্টও লেবুর রস দিয়ে বাবাকে তৃপ্তি সহকারেই খেতে দেখতাম। আশাবাদী সেই মানুষটি ভালবাসার সব মায়াটানকে ছিন্ন করেই সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে গেলেন হঠাৎ করেই।
জানিও, আমার মাও একজন অসম্ভব সাহসী মহিলা। প্রকৃতির ডাকে রাতে বাবা যখনই ঘরের বাইরে বের হতেন, কুপি বাতি হাতে মাকে তখন অদূরেই দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখেছি। সেসময় দু’জনে ফিস্ফিস্ শব্দে সংসারিক কুটিনাটি বিষয়াদি নিয়ে কী যেন কথা হতো। বাবার কী জ্বীন-ভূঁতে-পেতœীর কোনো ভয় ছিল? নাকি অদৃশ্য এক ভালবাসার টানেই মাকে তিনি সঙ্গে ডেকে নিতেন।
(৫)
বাবার মৃত্যুর পরপরই আমার মাও জানি কেমন উদাসীন ও অসহায় হয়ে পড়লেন। সরকারী বাসা পেয়ে একদিন মাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম আমিও। কিছুদিন নাযেতেই বাড়িতে যাওয়ার জন্য মা বেশ অস্থির হয়ে উঠলেন। আমাকে বললেন- ’এই শহরের বাসায় পক্ষীর মতো তোরা কেমনে থাকিস যে বাবা? আশে-পাশের বাসার সব বাচ্চা-বাচ্চা বউরাও ছাদে উইঠ্যা খালি সিনেমা আর বঙ্গ-বাজারে মার্কেটিং-এর খোশগল্প করে ওরা। বৃদ্ধবয়সী মুরুব্বী মানুষজন তো একটাও দেখি নাই রে এখানে কেউ। পান-সুপারি মুখে দিয়াও যে সুখ-দুঃখের দু’একটা কথা বলুম, তেমন কেউই তো নাই। মায়ের মুখে একথা শুনে আমি কেবলই মৃদু হাসি। তারপর তিনি আবার বললেন- এতো নিরিবিলি আমার ভাল লাগে না রে বাবা। সামনের শুক্রবারে কাউকে দিয়ে আমারে তুমি গ্রামের বাড়িতেই পাঠিয়ে দিও। তখন মায়ের অস্থিরতা দেখে আমিও তাঁকে আশ্বস্ত করি, বোকার মতো ম্লান হেসে হেসেই।
এল.পি.আর তথা অবসর চলাকালীন সময়ে বাবার শরীরে এক মরণব্যাধি ক্যানসার ধরা পড়ে। প্রথমে তিনি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতলে প্রচন্ত পেটব্যথা নিয়েই ভর্তি হন। অতঃপর, ঢাকায় পিজি হাসপতালে তাঁর ক্যানসারের চিকিৎসা চলতে থাকে। অবশেষে সেখানকার ডাক্তারগণও একদিন হতাশার বাণী শুনালেন। সবার পরামর্শেই শেষঅব্দি বাবাকে গ্রামের বাড়িতেই নিয়ে যাওয়া স্থির হলো। মনের শান্তনা ও শেষ ভরসায়- পাহাড়ি এক তান্ত্রিক কবিরাজকে এনেও বাবার চিকিতসা করানো হয়। কবিরাজ মশাই মাটির পাতিলে ধূঁপ জ্বালিয়ে তন্ত্র-মন্ত্র পড়ে, জ্বিন-সাধনার দ্বারা লতাপাতা জাতীয় বনৌষধি কীসব যেন নিয়ে এলেন। রাত প্রায় বারটায়, ঘোর-অন্ধকারে জ্বিনের ভৌতিককণ্ঠে বাবার আশু রোগমুক্তির আশার বাণী আমরা শুনতে পেলাম। এইসবের প্রতি আমার কোনো বিশ্বাস না থাকলেও, আপনজনদের ক্ষীণ আশার প্রদীপটা নিভিয়ে দিইবা কীভাবে?
(৬)
কিছুদিন পর, এক মধ্যরাতের থেকেই বাবাকে বেশ অস্থির মনে হলো। এতো কিছু করেও তাঁর শেষ রক্ষা আর হলো না। ’বাবা মারা গেছে’ সেদিন শেষরাতে আমাদের বড় আপার এমনই চিৎকার শোনে সবারই ক্লান্তির ঘুম ভেঙে গেল। আমাদের ছোট ভাইবোনেরা কাঁচা ঘুম ভেঙে ভয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে খাটের উপর জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলো।
অতঃপর, বাবার মৃত্যুর চল্লিশা উপলক্ষ্যে এক মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করা হলো। নিকটাত্মীয়রা দাওয়াতি মেহমানের মতোই খাওয়ার পর্ব শেষ করেই যথারীতি নিজ বাড়িতে চলে গেলেন। সেই ভয়াল এক দুর্দিনে আমার অসুস্থ মা এই সংসারের হাল ধরে পক্ষীমাতার ন্যায় আমাদেরকে আদর-সোহাগ দিয়ে একাই আগলে রাখলেন।
ঐ দুঃসময়ের স্মৃতি আজ মনে হলে, শিউরে উঠি নিজের মনের অজান্তেই। তবুও, মনের কষ্টটাকে গোপন রেখেই, সুখের আলো-ছায়াকে স্পর্শ করার জন্য শত আবেগে আপ্লুতও হই এবং সবাইকে হাসিমুখেই বলি-
“আমরা ভালোই তো আছি…

The post এক স্কুল মাষ্টারের গল্প appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3hof3RS

No comments:

Post a Comment