রাইসুল হক
হাইকু অতি সাধারণ একটা কাব্যসাহিত্য বা অনু কবিতা!বর্তমান যুগে তা বিশ্ব- সমাদৃত। এই কবিতাকে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম কবিতা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাইকু চর্চা হলেও এর মূল উৎপত্তিস্থান জাপান। অন্য সব কবিতার থেকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকের এ কবিতায় বেশ কিছু বিষয় উপলব্ধি করা যায়।
দর্শনকলার গভীরে ডুব দিয়ে, সাঁতরিয়ে তুলে ধরা বৈচিত্রের প্রস্ফুটিত রূপ, সুনির্দিষ্ট নিয়মের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে মনের বহিঃপ্রকাশ করার নামই হলো হাইকু।
এই কাব্যের মধ্যে যে একটা অনুশাসনের আর্ট নির্ভর করে সেটা পর্যবেক্ষণ করতে পারলেই অনুধাবন করা সম্ভব।
পৃথিবীর সব কিছুর একটা গতি বিধায়ক অনুসারে অনুকরণ হয়ে আসছে যেটা আমরা অস্বীকার করতে পারি না!তাই বলে তো আর অনুশাসনে সীমাবদ্ধ নয়।
অনুশাসনের মধ্যে থেকেও বিস্তর প্রভাব প্রকাশ করা খুবই সহজ এবং তা সম্ভব! তেমন ধারণা হাইকুর মধ্যে, হাইকু বিশেষজ্ঞদের চিন্তা চেতনায় বিদ্যমান।
মেরে ফেলার উদ্দেশে কাউকে আঘাত করতে হলে উপযুক্ত স্থানে একটা ঘুষিই যথেষ্ট! সচেষ্ট ভাবে মারতে পারলেই তার প্রাণনাশ করা সম্বব। ছোট্ট একটা পারমাণু বোমা একটা দেশ একটা জাতিকে যদি ধ্বংস করতে সক্ষম! তাহলে প্রকৃত একটা হাইকু লিখতে পারলেই, হাইকু কবি হিসাবে সুখ্যাতি অর্জন করা খুবই সহজ সাফল্যের বিষয়! হাইকু বিশেষজ্ঞদের একান্ত এবং সুনিশ্চিত অভিমত। মাৎচুঅ বাসো প্রকৃতি নিয়ে তার চৈতন্যময় দর্শনে তিনি ঠিকিই উপলব্ধি করেছিলেন! আধুনিকতা ও কৃত্রিমতার কাছে প্রাকৃতিক বৈচিত্র যাতে হুমকির সম্মুুখীন না হয়ে পড়ে সে জন্য প্রকৃতিকে সাহিত্য-শিল্পের
মাধ্যমে ফুটিয়ে প্রকৃতিস্থ মনোভাব মানুষের মাঝে সর্বস্তরে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করা তার অন্যতম কারণ ও উপুর্যপরি বলে মনে করেন।
এমনি অনুশাসনের মধ্যেও বাংলা সাহিত্য সাবলীল ভাবে চর্চা হয়ে আসছে যুগযুগ ধরে!যেমন কাব্যের ক্ষেত্রে সনেট, লিমেরিক, ছড়া,গীতি কাব্য ইত্যাদি! গানের ক্ষেত্রে পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, রাগ,উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত,আধুনিক ইত্যাদি প্রত্যেকটার পৃথক পৃথক ছন্দ শব্দের গাঁথুনি রূপ, সুরের বৈচিত্র উপস্থাপন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশের বিধানে চলমান।
হাইকুর ক্ষেত্রে তারও একটা সুনির্দিষ্ট গতিধারা বিধায়ক বটে।
হাইকুর উৎপত্তি স্থান জাপান এবং তাদের কবি, সাহিতিক ইতিহাসবিদরা বিশ্ব সমাদৃত করার জন্য সহজ সরল পথ দেখিয়েছেন। রেঙ্গা, তানকা,ওয়াকা,হক্কু দীর্ঘদিনের সাহিত্য চর্চার পÐিতদের নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনায় সর্বশেষ সিদ্ধান্তে উপনীত একটা সুনির্দিষ্ট ছক মাত্র তারা বহিঃপ্রকাশ করেছেন!
মাৎচুঅ বাসোর হক্কু নামে। মাৎচুঅ বাসোর এই হক্কু নামকে আবার পরিবর্তন এনে মাসাওকা সিকি হাইকু নামে, নাম হাইকু প্রচলন করেন।
একে আবার ইনেনাগা সাবুরো বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইতিহাস রচয়িতা তার ‘হিস্ট্ররি অফ জাপানিস কালচার’-গ্রন্থে হাইকু লেখার নিয়মকে তিনি অল্প কিছু কথায় সহজ সরল ভাবে বুঝিয়েছেন।
হাইকুতে ১৭টি অক্ষরের সিলেবল থাকে ও তিন লাইনে বিভক্ত এবং ঋতু বৈচিত্র সমৃদ্ধ।
আমরা জানি যে, সিলেবল মানে জিহŸার গতি না বদলিয়ে একবারে উচ্চারণ সক্ষম শব্দ বা শব্দাংশ, এক স্বর বিশিষ্ট শব্দ বা শব্দাংশ! যা বাংলা ভাষায় যুক্তাক্ষরের মধ্যে পড়ে না। বিশ্ব সমাদৃত করার লক্ষ্যে তিনি এই সিলেবলের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন।
প্রকৃত নিয়ম মেনে হাইকু লিখতে হলে ৫/৭/৫ সিলেবল,তিন লাইনে সীমাবদ্ধ,প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ঋতু সম্পর্ক বজায় রেখে লেখার মান নির্ণয় করার নামই হলো হাইকু।
জাপান চার ঋতুর দেশ হয়েও যদি হাইকুতে ঋতুর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে পারে,তাহলে আমরা ছয় ঋতুর দেশ হয়ে আমরা কেন পারব না? নিশ্চয় পারবো।
যেহেতু হাইকুতে অন্ত্যমিলের বা ছন্দ মিলের কথা বলা হয়নি আবার অন্ত্যমিল বা ছন্দ মিল রাখা যাবে না এমন কথাও বলা হয়নি! তবে সিলেবলের কথা যেখানে একান্ত ভাবে বলা হয়েছে সে ক্ষেত্রে অক্ষর বৃত্ত মাত্রা,স্বর বা শব্দাংশ মেনে লেখা অতি শ্রেয়। এখানে আমার লেখা দুইটি হাইকু অন্ত্যমিল ও অন্ত্যমিল-ছাড়া তুলে ধরা হলো!
*(১) পালের গোঠ
বুনো মহিষ দেখি
ফোঁফায় ঠোঁট।
*(২) প্রৌঢ় বয়সে
পূর্নিমা চাঁদ দেখি
যুবতী প্রেম।
প্রকৃত নিয়মকে সবল রেখে অগ্রসর হলে
কখনো যাত্রা বিফল হবে না এবং বিতর্কের ঊর্দ্ধে থেকে এ চর্চায় সাফল্যদায়ক নিশ্চয়।
যেমন বলা চলে, মুল ধারার বাইরে এসে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটে জয় লাভ করা সম্ভব কিন্ত রাজনীতিতে টিকে থাকা একটা দুরূহ ব্যাপার,এমন কি নেতৃত্ব ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে, মাঝ পথে হাবুডুবু খেয়ে ব্যর্থতার শিকার হতে হয়।
অনেকেই আছেন মূল ধারার বাইরে গিয়ে স্বচিন্তা ধারাকে যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন! এটা কেন হবে?, কি জন্য ও টার প্রয়োজন? এমন করলে আরো ভালো হয় ইত্যাদি? সে যুক্তির শেষ নেই। আসলে এটা যেমন কম্বলের লোম বাছতে বাছতে শেষমেষ মূল কম্বলের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না’,তেমন করাটা সমচিত হবে কি? নিশ্চয় হাইকুর মূল নীতি গঠনের কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়ায় ‘আঙ্গুর ফল না-খেতে পারায় টক’। সে-যে এই অনু কাব্য হাইকু চর্চার গভীরতায় প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন সে-টা স্বীকার না-করে যুক্তিহীন, যুক্তি দ্যাখান খুবিই শক্তভাবে! কেন সিলেবল নামতে হবে? কেন ঋতুরই বা প্রশ্ন থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি? এমন গÐির মধ্যে থেকে সাহিত্য চর্চা করা বৃথা? যা একান্তই অযৌক্তিক বিতর্কিত।
এখন! বলাই বাহুল্য যুক্তিবিদরা যদি নতুন ধারার আবিস্কার করতে চান তাহলে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে অভিনব ছক-এর প্রস্তুত করতে তো আর বাধা নেই।
বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষ সব সময় কর্ণ শ্রুতিমধুরতায় অভ্যস্ত সে কারণে শ্রুতিমধুর ধারাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বাংলায় হাইকু চর্চা দেখা যায় বেশি। এখানে হাইকুর মূল ধারার কোনো খর্ব হয় না।
মানুষের মুখে মুখে খুবিই জনপ্রিয় অনেক খনার বচন আছে যা সর্বত্র গ্রহণযোগ্য, যেমন
অভদ্র বর্ষা কাল-/৭
হরিণি চাটে-/৫
বাঘের গাল-/৫=১৭
সিলেবল হলেও হাইকু বলে পরিচিতি ঘটেনি! তার মূল কারণ হল এখানে তিন লাইনে ৫/৭/৫ না হয়ে, হয়েছে ৭/৫/৫ যেটা হাইকুর মূল ধারার বাইরে।
আরও এমনি একটা লেখা:
আংগুল ফুলে মোটা হয়-১০
কলা গাছ হয় না-৭ =১৭
এখানেও ১৭ সিলেবল হলেও হাইকু বলে পরিচিতি ঘটেনি! এ-দুু’টো লেখাতে আমার মনে হয় মূল ধারার বিশৃঙ্খলার কারণে।
এই লেখা দু’টিতে ঋতু বৈচিত্রের ঘাটতি নেই, সিলেবলেও সংঙ্গতিপূর্ণ! এখানেই বোঝা যায় লাইন ভাঙার বিষয়টা কেমন গুরুত্ববহন করে এবং তা মূলধারা ভূমিকার তাৎপর্য কতটা মূল্যে প্রবাহিত।
যদিও জাপানে দুই বা এক লাইনের কোনো কোনো কবি হাইকু লেখেন! সেটা শুধু জাপানিজ হিরেগানা বা আনজির ক্ষেত্রে চলে।
বিষয়টা এমনি হয়ে দাঁড়ায়! যে রোগে ঘোড়া মরে, আসুন আমরা ঘোড়া না-মেরে রোগ জীবাণুকে মারি। মূল গঠনকে বজায় রেখে, সুচিন্তিত প্রতিভাকে বিকশিত করি!যার গ্রহণযোগ্য সর্বস্তরেই প্রাপ্তি। হাইকুর শর্তে শর্ত মেনে চর্চা একান্তই শ্রেয়।
হাইকু রাজ্যের মহারাজ হাইকু কবি মাৎচুঅ বাসোর গবেষণা অতি সু²
ছিল, তা আজ এ চর্চার কবিরা পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে অনুভবে ভাবিত, একান্ত নব্য সাহিত্য কৌশলের রূপ রেখা চিত্রকে একটা ক্ষুদ্র কবিতা রূপ দেওয়ার বিষয়টা অতিচমকপ্রদ করে তুলেছেন, যা আধুনিক প্রজন্মে এসেও তাকে স্মরণ ও বরণে সাধুবাদ জানায় এবং এ চর্চার ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে থাকবে। এই জনপ্রিয় হাইকু লেখার জন্য বৈচিত্রকে নিপাট স্বচৈতন্য ভাষায় যে কোনো প্রাকৃতিক চিত্র নদী-নালা খাল বিল ফুল ফল পশু পাখি কীট পতঙ্গ ইত্যাদি, প্রাকৃতির দর্শন ততখানিক কীভাবে উপলদ্ধি করা হয়েছিল তা,তার উদাহরণে আমরা কেমন ফলবান হতে পারি বা আসা করতে পারি, এমন কি আগামী প্রজন্মকে কি ইঙ্গিত করলে জাতি সমাজ উপকৃত হবে।
হাইকুতে অনেক কিছু উহ্য থাকে যা বুঝে নিতে হয়। এর অনেক সময় বাংলা ভাষায় পূর্ণ ব্যাকরণ সমৃদ্ধ নাও হতে পারে।শব্দের খেলার মধ্যে হাইকু লেখা যে গূঢ় রহস্য, সেই রহস্য যে উদ্ঘাটন করতে পারবে, তার কাছে হাইকু লেখা খুবই সহজ সাফল্য হবে নিশ্চয়!
এর জন্য ব্যতিক্রম সাধনায় সাধক হতে পারলেই ভক্তের অভাব হবে না।এ জন্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তিনি ঠিকই অনুভব করেছিলেন, এ কবিতা গান গাওয়ার কবিতা নয়,এ কবিতা অনুভবের কবিতা। কবিগুরু তার ভাবদশায় বিচক্ষণতার কথা প্রকাশ করেছেন অকপটে। এ কারণে হাইকু কবিতা আলোচনা করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়! পাঠক তার ইচ্ছা মতো অনুভবে ব্যাখা করেন! তাই বলে তো আর হাইকু আলোচনা সাহিত্য যে পিছিয়ে আছে এমনটা নয়!বরঞ্চ ইতিমধ্যে বাংলা সাহিত্যে বেশ লক্ষনীয় হয়েছে, হাইকু চর্চা ও তার উপরে স্ন্দুর শৈলী গঠনমূলক সুদীর্ঘ আলোচনা।
এ কবিতায় ইদানিং কর্ণ শ্রæতিগত স্বর শব্দ চয়ন হাইকুগুলো শিশুদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে, নতুনত্বের সুন্দর ছন্দ ও অন্তমিল গঠন শৈলীর কারণে।
এখন শুধুই অপেক্ষা মাত্র পাঠ্য পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত স্থান দখল করে নিতে পারলেই ‘হাইকু সাহিত্য আন্দোলন’ সার্থক এবং সফল হবে।
এখন বিষয়টা হলো হাইকু লেখকদের হাইকুর মতো হাইকু লেখা চাই!
মোটা সুতোয় চিকন জাল বুনতে পারলেই কিস্তিমাত।
প্রকৃত পক্ষে যে তার জীবন দশায় একটি হাইকু লিখতে পেরেছে সে-হাইকু কবি, যে দু’টি হাইকু লিখেছেন সে হাইকুর কারিগর আর যে তিনটি হাইকু লিখেছেন সে হাইকুর স¤্রাট!
মাৎচুঅ বাসো ও হাইকু বিশেষজ্ঞদের রাজকীয় এমন অভিমত প্রকাশ করে গেছেন। অতএব এখানে বোঝা যায় একটা হাইকুর গুরুত্ব কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে! আর কেমন হাইকু রচনা করতে পারলে এমন উপাধি পাওয়া যাবে। হাইকুর উপকরণ ও কবির দর্শনকে মনোনিবেশ আর একাগ্র সাধনার প্রতি ফলনই একজন হাইকু কবির মূল পরিচয়। এই দর্শন ক্ষুদ্র-কাব্যের রূপ ব্যাখা যেমন কয়েক সেকেন্ড স্বপ্নে সারা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার মতো।বিধায় হাইকু রচনাটাতেও পাঠকের মন আকৃষ্ট করে তুলতে পারলেই একে একাত্তর! সাধনায় সিদ্ধি।
The post প্রবন্ধ: হাইকুর গুরুত্ব appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/2YrPrOc
No comments:
Post a Comment