সুদয় কুমার মন্ডল
সা¤্রাজ্যবাদ, জাতিগত ভেদাভেদ, ক্ষমতালিপ্সু, বিজাতির স্বার্থ চরিতার্থ, দীর্ঘকাল ক্ষমতার মসনদে থাকার অভিলাষ, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। ধনতন্ত্রবাদের অমানবিক সংগম, উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণ-বৈষম্য, রাষ্ট্রীয় সংঘাত, অতীতের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থাকে অস্থির ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। গোটা জাতিকে একনায়কতন্ত্রের পেষণী বন্ধনীতে শৃঙ্খলিত করে রাখে। এমনি করে পৃথিবীতে রাষ্ট্র ব্যবস্থা চলতে থাকে। ‘জোর যার মল্লুক তার’-এই নীতিতে বলবান শাসকরা একে অপরের রাজ্য দখল করতে থাকে। শাসক ও শোষিতের মধ্যে গড়ে ওঠে দ্বন্দ্ব সংঘাত। উৎপীড়িত শোষিত জাতি মুক্তির নেশায় পাগল হয়ে ওঠে।
আলেকজান্ডার, সেলুকাস, নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, ইংরেজ বেনিয়া ও প্রাচ্যের অনেক ক্ষমতাধররা তখন সা¤্রাজ্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং ছোট ছোট দেশ বা দুর্বল শাসকদের বন্দি করে রাজ্য দখল করে নিত উগ্রবাদি শাসকরা তাদের আশা-আকঙ্খা, আরাম-আয়াশ স্বীয়স্বার্থে উপভোগ করতে শোষিত শ্রেণিকে দাসত্বে পরিণত করে বিলাসিতা মত্ত থাকতো। কেউ কেউ ফেসিস্ট রাষ্ট্র কায়েম করতো, নিগ্রহ নীপিড়নে জাতিকে সর্বদা অস্থির করে তুলত। প্রজা সাধারণের আশা-আকাঙ্খা, শাসক ও শোষক শ্রেণির অনুগত থেকে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য করা হতো।
অরাজকতা ও চরম নৈরাজ্যের মধ্যে গড়ে ওঠে শ্রেণি সংগ্রাম। প্রপিড়ীত মানুষের মনে জেগে ওঠে স্বাধীনতার প্রত্যাশা। মার্কসবাদ ধনতন্ত্র এবং ধর্মের মূলে কুঠারআঘাত করে শ্রেণিহীন সমাজ ব্যবস্থাকে মানুষের পরম নৈতিক আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। ভালো কাজ যেমন শ্রেণিহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমে সহায়তা করে, মন্দ কাজ ও তেমনি ধনতন্ত্র ও ধর্মকে জোরদার করে ধনিক শ্রেণির হাতে সর্বহারাদের শোষষ ও লাঞ্চনার পথ সুগম করে। মাক্সবাদীদের মতে মানুষ সমাজতন্ত্রের দীক্ষা লাভ করে মহৎ চরিত্রের অধিকারী হতে পারে। অসহায় জনগণ বিভিন্ন মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে মুক্তির লক্ষে তা গ্রহণ করে আন্দোলন গড়ে তোলে। স্বাধীনতা জাতির রক্ষা কবচ। আর এই স্বাধীনতা অর্জন করা যেমন কষ্ট রক্ষা করা তার চেয়েও কঠিন। যে জাতি স্বাধীনতার মূল্য দেয় না সে জাতি পঙ্গু, অস্তিত্ব বিকাশে অক্ষম।
প্রায় দু’শত বৎসর কাল অখন্ড ভারতবর্ষ বিট্রিশ শাসনাধীন ছিল। নিরীহ ভারতবাসীকে নানাভাবে বঞ্চিত ও ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের কৌশল, বৈষম্য, শাসক শ্রেণির নানা অনিয়মের বিগ্রদ্ধে ভারতীয় জনগণ ফুঁসে ওঠে। তারা দীর্ঘদিনের ভুমিপুত্র মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষায় ও স্বৈরাচারী ব্রিটিশ শাসকের শোষণের হাত থেকে মুক্তির লক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলে। মুক্তিকামী জনতা মুক্তিরজন্য বদ্ধপরিকর। তারা জুলুম নির্যাতনের বিগ্রদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রামের পথ বেঁচে নেয়। বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য বিনয় বাদল, দীনেশ, ক্ষুদিরাম, নেতাজী সুভাষ বসু, মাস্টার দ্যা সূর্যসেন, চারু মজুমদার, প্রীতিলতা, ওয়াদেদ্দার বহু দেশ প্রেমিকের ত্যাগ-তিক্ষায় দীর্ঘ সংগ্রামের পর বিট্রিশ শাসক কোণ ঠাঁসা হয়ে শেষ পর্যন্ত ভারত থেকে বিতাড়িত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়। বঙ্গ বিভক্ত হয়। পূর্ব বঙ্গ ও পশ্চিম বঙ্গ। পূর্ব বঙ্গ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট কায়েদে আজম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। বাঙালি জাতির পরে ক্রমান্বয়ে নেমে আসে শাসক শ্রেণির বিমাতাসুলভ আচারণ। জাতির ভাগ্যে আরেক অভিশাপ। পর্যায়ক্রমে পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। শুরু হয় নানা অনিয়ম ও বৈষম্য। বাঙালি জাতিকে তারা গোলাম বানিয়ে স্বার্থসিদ্ধ করতে নানা রকম কৌশল অবলম্বন করে। চাকরি ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় নানা রকম বৈষম্য সৃষ্টি করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী বানায় করাচি ও পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে। শোসক শ্রেণির দেশীয় জাতির প্রতি অত্যাচার ও বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ১৯৫৮ সাল থেকে আন্দোলন ও সংগ্রাম শুরু হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, তৎকালীন ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সংগ্রাম পরিষদ। ৭ মার্চ খুলনা জেলায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ঐতিহাসিক ভাষণ, ” এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম ” উত্তাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুর এই মহাকাব্যিক ভাষণ স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবহ করে তোলে। বিশ্ব স্বীকৃত এই ভাষণ বিশ্ব নন্দিত । ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা, ছাত্র সমাজের ১১ দফা, স্বৈরাচারী সরকারের আগতলা ষড়যন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়। ১৯৭০ এর গণঅভ্যুথ্থান, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ০৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করে। বঙ্গবন্ধু কোন রাজ- নৈতিক মতাদর্শের অন্ধ সমর্থক ছিলেন না। সমসাময়িক আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছিল তার রাজ – নৈতিক মানস। প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর ভাষায়-পাকিস্তানি রাজনীতি ও রাষ্ট্র নীতির অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছিল মুজিবের রাজনৈতিক দৃষ্টি, তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা।বঙ্গ বন্ধুর সহসী নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষায় প্রতিজ্ঞাপরায়ণ জাতি।
জাতীয়তাবাদের ভিক্তিতে বাঙালি জাতি বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রামের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত ও ১ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে রেখে অবর্ণনীয় নির্যাতন করেও আপষহীন নেতা জাতির মুক্তির জন্য বজ্রকঠিন, অনড়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবদান পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে খোদিত হয়ে আছে। দীর্ঘ নয় মাস পশ্চিমা শাসকদের বিগ্রদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধ করে অদম্য বাঙালি জাতি ফিরিয়ে আনে মুক্তির মন্দিরতলে স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। ২৫ শে মার্চ পাক হানাদার বাহিনী নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ ইতিহাস কলঙ্কিত নারকীয় অধ্যায়। বাঙালি নিধনযঞ্জ। ৭১- এর অগ্নিঝরা মার্চ স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান। বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় গ্রেপ্তার, স্বাধীনতার ঘোষণা অতঃপর যুদ্ধ আর যুদ্ধ।
পৃথিবীর ইতিহাসে ২৬ শে মার্চ৭১ বাঙালির মুক্তির সোপান। ‘স্বাধীনতা দিবস’ জাতির আশা-আকাঙ্খা পুরণের এক গৌরবোজ্জ¦ল অধ্যায়। বাঙালির মুক্তির সনদ। স্বাধীনতা বাঙালি জাতিকে স্বতন্ত্র সীমানায় প্রতিষ্ঠিত করে জাতিকে স্বাধিকার দিল। ভাগ্য উন্নয়নে, জাতীয় কল্যাণে, সদ্য ক্ষতিগ্রস্ত যুদ্ধ বিধস্ত দেশের ধ্বংস স্তুপের পরে অধিষ্ঠিত হল বাঙালি জাতির প্রাণ প্রতিষ্ঠান। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে চারটি স্তম্ভের মাঝে নির্মিত হল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রাণ। স্বাধীনতার মহিমায় বাঙালি জাতি চির মুক্ত চির আনন্দিত। স্বাধীনতার সুফল বাঙালি জাতিকে বিশ্বের ইতিহাসে মহান করে তুলেছে ও গৌরবজ্জল এক অধ্যায় সৃষ্টি করে চলেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ স্বনির্ভর। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে স্বল্প উন্নয়ন থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি (জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র) উপর প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক সম্প্রীতির দেশ। স্বাধীনতার সুফল বাংলাদেশের জনগণকে বিশ্ব পরিচিতির দ্বারে পৌঁছে দিয়েছে।
স্বাধীনতার পর আমাদের আমাদের কি দশা হল? ধ্বংসস্তুপের মধ্যে সম্ভ্রম ও রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেলাম।
সাড়ে সাতকোটি লোক ৫৪ হাজার স্কোয়ার মাইল। সম্পদ বলতে কোন পদার্থ আমাদের ছিল না।সমস্ত কিছু
ধ্বংস।আমরা কিন্তু চেষ্টা করলাম। একদম ফ্রি হ্যান্ড,আচ্ছা করো, আচ্ছা দল গড়ো,আচ্ছা লেখো,আচ্ছা বক্তৃতা করো,বাধা নেই ফ্রি হ্যান্ড। … কিন্তু দেখতে পেলাম কি? আমরা যখনই এই পন্থায় এগুতে শুরু করলাম, বিদেশি চক্র এদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো এবং তারা এ দেশের স্বাধীনতা বানচাল করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করলো এবং ফ্রি স্টাইল শুরু হয়ে গেল।হুড়হুড় করে বাংলাদেশে অস্ত্র আসতে আরম্ভ করল।দেশের মধ্যে ধ্বংস,একটা ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ।এছাড়া আরও দেখা গেল,যাদের আমরা এ সমস্ত ভোগ করতে দিলাম তারা রাতের অন্ধকারে মানুষ হত্যা করতে আরাম্ভ করলো। ইলেক্টেড মেম্বার অব পার্লামেন্ট, তাদের হত্যা করা হল।যারা নিঃস্বার্থ ভাবে যুদ্ধকরেছে মুক্তি বাহিনীর ছেলে,তাদের হত্যা করা হল। চরম ষড়যন্ত্র। এতঅস্ত্র উদ্ধার করি
তবু অস্ত্র শেষ হয় না। এই রাজনীতির নামে হাইজ্যাক, এই রাজনীতির নামে ডাকাতি।… রাজনীতির নামে একটা ফ্রি স্টাইল শুরু হয়ে গেল। নব্য,কিছু দিন আগে স্বাধীন প্রাপ্ত একটা দেশে এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির প্রচন্ড আক্রোশ বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিধন করলো। খুন, যখম,সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, লুটপাট নানা রকম অন্যায় অত্যাচার দেশ অশান্ত অশান্ত করে তুলছে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করছে। স্বাধীনতার অর্থ এই নয় দেশে অরাজক সৃষ্টি করা।স্বাধীনতার সুফল
পেতে হলে অশুভশক্তির মূলোৎপাটন করতে হবে। তবেই আসবে স্বাধীনতার প্রকৃত সুখ। মুক্তির মন্দির তলে স্বাধীনতা। আজকের এই দিনে কাল রাত্রির ঘৃণিত অধ্যায় সৃষ্টিকারী পরাশক্তি ও তাদের ঘৃনা ওনিন্দা জানাই,গভীর
শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি সকল শহীদদের। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর আনান্দ সকল শ্রেণী পেশার
মানুষের ঘরে পৌঁছে যাক।নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ হোক।
The post মুক্তির মন্দিরতলে স্বাধীনতা appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3tWa3bP
No comments:
Post a Comment