Friday, March 26, 2021

ছেঁড়া পাতা নীল কলম https://ift.tt/eA8V8J

খালিদা খানুম
পাতা ঝরা শুরু হয়ে গেছে। শীতের যে তীব্রতা ছিল তা কম হতে শুরু করেছে। রাতে ঠান্ডা দিনে গরম, পুগ্রলিয়ার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। বুনো ঝোপ ঝাড় শুকিয়ে গেলেও পলাশের পাতা এখনও সবুজ। পলাশের কুঁড়ি আসা শুরু। দু এক যায়গাতে ফুটতে শুরু করছে ফুল, যাদের তাড়া বেশি। আর কিছু দিনের মধ্যেই গরম বালিতে চাল দিলে যেমন ফুটফাট করে সাদা মুড়িতে ভর্তি হয়ে যায়, তেমনি করে লাল পলাশে ভর্তি হয়ে যাবে সাঁতুরি, বেরোর রাস্তা।
হোস্টেলে পড়ার সময় দেখেছিলাম— পলাশ কুঁড়ি লাগে সরস্বতী পুজো। দায়িত্বে থাকা দিদিরা আনতে দিত পলাশ কুঁড়ি। সত্যি কি আবশ্যিক? এতো পলাশ কুঁড়ি আসে কোথা থেকে? পলাশ বেঁচে থাকুক। এমন একটা সুন্দর বন বেঁচে থাকুক।
এখানে অবশ্য পলাশ কুঁড়ি বিক্রি হতে দেখিনি। সরস্বতী পুজোর দিনের চেয়ে পরের দিন বেশি পথঘাট শুনশান। আজ নাকি বাসি খাবার দিন। আজ অরন্ধন। এখানে সরস্বতী পুজো ভালোই ধুমধামে পালন হয়। লরি থামিয়ে বাচ্চা থেকে বড়রা চাঁদা আদায় করে, যেটা দুর্গাপুজোর সময় হয় না। পাড়ার গলি থেকে বড়ো রাস্তার মোড়, চাঁদা সবখানে। বক্স মাইক কোনও কিছুর কমতি নেই। ব্যস্ততম অন্নপূর্ণা গ্রোসারি অব্দি বন্ধ। সাঁতুরির কেবল মিষ্টি আর ফলের দোকান বাদে সব বন্ধ। কেমন একটা বাংলা বনধ টাইপের ব্যাপার। কিছু দিন আগে যে বাংলা বনধ হয়েছিল সেদিনও অনেক অনেক বেশি দোকান খোলা ছিল। সম্ভবত সেদিনের বনধ সফল হয়নি, কিন্তু যে বনধ সফল বলে দাবী করা হয় তার থেকেও বেশি বনধ আজ, শুনশান রাস্তাঘাট।
মানুষের মনে সবচেয়ে যা প্রভাব বিস্তারকারী তা মনে হয় ধর্ম। ধর্ম নিয়ে যত চর্চা হয় তা বুঝি আর অন্য কিছু নিয়ে হয় না। আমি জীবনে প্রথম নাস্তিক মানুষ দেখি গোলাম আম্বিয়া স্যারকে, আমার প্রাইভেট টিউটর।
-ধর্ম এসেছিল ভয় থেকে। আদিম মানুষ কিছু জানত না। তাদের অস্ত্র ছিল না। বুনো জন্তু জানোয়ারে তাড়া করত, মেরে খেতো তাদের। বন্যা আসত, ঝড় দাবানল আসত, ভুমিকম্প খরা সবকিছুর সাথে লড়াই ছিল। রাতের অন্ধকারে ভয় ছিল। সূর্য উঠলে সে ভয় দূর হত, ভাবত সূর্য আমাদের রক্ষাকারী। দেবতার নাম পেত সূর্য। আগুন আবিষ্কারের পর বুঝতে পারল আগুন কাছে থাকলে বন্য প্রাণী থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, আগুন পেল দেবতার স্থান। ঝড় থেকে বাঁচতে বগ্রণ পেল পুজো। এমনিভাবে ধর্মের উৎপত্তি।
শিবদাস ঘোষ ছিল স্যারদের ভাবগুগ্র। এসইউসিআই নামক একটি দলের নাম হয়তো পরের প্রজন্ম আর জানবে না কিন্তু যতদিন আম্বিয়া স্যারের মতো লোক থাকবে এসিউসিআই কম্বলে ছুঁচের মতো টিকে থাকবে। খুঁজে পাওয়া যাবে না কিন্তু থাকবে।
এসইউসিআই-এর একটি পার্টি অফিস ছিল হরিহরপাড়া বাজারে। এখন আছে কি নেই বলতে পারব না। দিন বদলের সাথে সাথে রঙ বদল হয়েছে অনেক। স্যাররা এখন আর হাটবারে কৌটোতে চাঁদা সংগ্রহ করেন কিনা বলতে পারব না। তবে তখন স্যার বেশ উৎসাহী কর্মী ছিলেন। চাকরি বাকরি করেননি, করার চেষ্টাও করেননি। প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন নিজের ছাত্রীকে। শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন একটা ছোটো গ্রমে। আমার অবাক লাগতো তার এই শ্বশুর বাড়িতে থাকা।
আমি কিছু বলতে পারিনি স্যারকে। কিন্তু মা বলত— আপনি শ্বশুর বাড়িতে থাকেন, খারাপ লাগে না?
স্যার বলত — না, ও বাড়িতে তো নাসরিনের ভাগ আছে। সেইখানেই থাকি। খারাপ লাগবে কেন? ওদের উপর কি আমি ডিপেন্ডেবল?
-আপনি একটা চাকরির চেষ্টা করলেন না। প্যারাটিচার নিচ্ছে স্কুলে। মা আন্তরিক ভাবে জিজ্ঞেস করতো।
-সবাই চাকরি করলে হবে? আমি এই টিউশন পড়িয়ে বেশ আছি। স্কুলে পড়ালেই আমি খালিদার স্যার হতে পারব, এখন কি খালিদা আমাকে স্যার বলে না?
স্যারের যুক্তি ছিল অদ্ভুত। মা বুঝতে পারত না। সত্য বলতে আমি তখনও বুঝিনি, এখনও বুঝিনি। চাকরি করা কি খারাপ? নিজে ভালো থাকতে চাওয়া কি খারাপ। স্যারের উপর তো কেবল স্যার নয়, পরিবার এর ভালো থাকা না থাকা জড়িত। নাসরিন ম্যাডামের চোখের নিচে কালি পড়ত। তার জন্য কি স্যার দায়ী না কোনোভাবে।
স্যার ছিল একেবারে গোঁড়া নাস্তিক। গোঁড়া কথাটা এই জন্য ব্যবহার করলাম কারণ নাস্তিকতা ছাড়া আর কোনো কিছু উপলব্ধি করে দেখেননি তিনি। গোঁড়া বলতে তো এটাই বোঝায়, যে নিজের মত, নিজের ভাবাদর্শ ছাড়া অন্য সব মত আর্দশ বিশ্বাসকে ভুল ভাবে, অযৌক্তিক ভাবে নিজেকে একমাত্র সঠিক ভাবে। স্যারও বিশ্বাস করতেন একদিন সারা পৃথিবী জুড়ে কমিউনিজম বিরাজ করবে এবং এও বিশ্বাস করতেন কেবল শিবদাস ঘোষের চালিত পথই সঠিক কমিউনিজম।
আমার কেমন জানি মনে হত, স্যার নিজের বুদ্ধি দিয়ে কথা বলেন না, কিছু কথা তার মনে পোঁতা হয়েছে, সেই কথাগুলো তিনি অন্ধের মতো ফলো করেন। কোনও এক ভাবধারার কাছে যেন তিনি তার চিন্তা ভাবনা বন্ধক রেখেছেন।
এমনি করে কি চিন্তার মুক্তি আসে? মুক্ত চিন্তক মানে কি কোনো এক মতবাদের কাছে চিন্তা চেতনা বন্ধক দেওয়া? মুক্তচিন্তক শব্দটির সঠিক মাত্রা কী?
নাস্তিকতা আমাদের সাধারণ জীবনে কতটুকু প্রয়োজন হয়! নাস্তিকতা আমাদের খাওয়া পরা মতো বেসিক নিডের সাথে কতটা সম্পর্কিত? নাস্তিক মানুষ মাত্রই কি ভালো মানুষ। আমাদের সবার উদ্দেশ্য নাস্তিক হওয়া না ভালো মানুষ হওয়া? ভালো মানুষ হতে গেলে ফ্যামিলির কথা ভাবা দরকার কি দরকার নয়? কেবল সমাজের কথা ভাবাই কি ভালো মানুষ হওয়া! আস্তিক মানুষ কি সমাজের ভালো করতে পারে না।
স্যারকে ঘিরে আমার প্রশ্ন ছিল অনেক।
স্যারদের দল কুসংস্কার বিরোধীসভা করতেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে রচনা প্রতিযোগিতা করতেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা এখনও প্রাসঙ্গিক কিনা তাই নিয়ে ডিবেট করতেন। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকজন যোগ দিত এই সব অনুষ্ঠানে। হয়তো বা সংখ্যাটা চার পাঁচে আটকে থাকত। স্যার এবং স্যারের মতো আরো দুচার জন লোকের পরিচিতজনরা এই সব অনুষ্ঠানে অংশ নিত।
স্যার কখনও ঈদের নামাজ পড়তে যেত না। অনেক মুসলিম আছেন যারা সারা বছর এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়লেও ঈদের নামাজ পড়তে যান। স্যার সে দলেও নাম লেখাননি। এতোটাই নাস্তিকতা তার অন্তরে ছিল।
আমি বলতাম- তাহলে আপনি সেমাই পায়েস খান কেন?
স্যার বলতেন- ঈদে আমার আগ্রহ নেই আমার আগ্রহ মানুষের আনন্দে।
আমি বলতাম-আপনার তো কোনও আনন্দ নেই, তাহলে আপনার কীসের ঈদ?
স্যার বলতেন- এই যে তুমি ঈদের দিন সাজ গোছ করবে। ঘুরতে যাবে। পড়াশোনা করবে না। তুমি খুশি থাকবে। তুমি আমার আপনার জন। তোমরা খুশি থাকলেই আমার ঈদ। ঈদ তো উৎসব ছাড়া আর কিছু নয়।
– কিন্তু আপনি নামাজ পড়তে যান না কেন?
– যাই না, কারণ বিশ্বাস করি না যে আল্লা বলে কেউ আছে।
-তাহলে পৃথিবীর সৃষ্টিতে আপনি বিশ্বাস করেন না? যে পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা কেউ আছে? মানুষের সৃষ্টিকর্তা কেউ আছে?
-পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে আপন নিয়মে। তুমি সায়েন্স পড়ছ তুমি ভালো জানো। আমি তো ইংরেজি পড়াই। স্যার রসিকতা করত।
-কিন্তু ধরেন এই যে মায়ের পেটে বাচ্চার দেহে প্রাণ আসে, হঠাৎ করে কিছু একটা বেরিয়ে যায় সেটা? এত চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রযুক্তি মানুষকে অমর করতে পারেন না?
-তুমি যখন ডাক্তার হবে তখন তুমি গবেষণা কোরো এই নিয়ে।
-আপনি কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন।
-তোমার কি ভালো লাগে সবচেয়ে জানো। তোমার এই তর্ক করা। যখন মানুষ প্রশ্ন করতে শিখবে, তর্ক করতে শিখবে তখন মানুষ আস্তে আস্তে আসল সত্যের দিকে এগিয়ে যাবে।
-আসল সত্য কী?
-আসল সত্য হল, যা সত্যিকারের সত্যি। যা মানুষের বানানো নয়, মনগড়া নয়।
-সে তো যে সত্যিই হোক না কেন, সে একজন মানুষের মাধ্যমে আসবে। মানুষের মাথা থেকেই বেরোবে?
-বেরোলেও, সে প্রশ্ন করে করে একটা পর্যায়ে আসার পর আসবে, আশমান থেকে আসবে না। আশমান থেকে আসা ধর্মগুলো মানুষের মাঝে বিভেদ করে কেবল। জাতপাত মারামারি কাটাকাটি হিংসা।
– ধর্মই কেবল কাটাকাটি হিংসা করে? রাজনৈতিক দল করে না? দুই দেশে যুদ্ধ হয় না! বিশ্বযুদ্ধ তো ধর্মের কারণে হয়নি!
– কিন্তু কুরুক্ষেত্র ক্রুসেড অহুদের যুদ্ধ?
– কিন্তু ধর্ম কেবল হানাহানি করে এ কেমন করে বলেন আপনি? হানাহানি, যুদ্ধের মূল কারণ মানুষ, মানুষের আগ্রাসী মনোভাব, অন্যের চেয়ে আমি বড়ো, এই ধারণা। যখন মানুষের মধ্যে ‘আমি, আমার পরিবার, আমার সম্মান, আমার গৌরব, আমার জাতি, আমার ধর্ম, আমার দেশ’ এই চিন্তাভাবনা বড়ো হয়, তখনই মানুষের মনে সৃষ্টি হয় অন্যের প্রতি বিদ্বেষ।
– তুমি বলো ধর্ম মেয়েদের পরাধীন করে না? জাতপাত তৈরি করে না? অস্পৃশ্যতা কুসংস্কারগুলো বানায় না? মানুষ মনকে এক অলীক দোজখ-বেহেশতে বা স্বর্গ-নরকে আবিষ্ট রাখে না?
স্যারের সাথে আমার তর্ক বিতর্ক চলতো পড়া থামিয়ে। তখন স্যার স্যার থাকতেন না, আমি ছাত্রী থাকতাম না। ডিবেটে অংশ নেওয়া দুই প্রতিপক্ষ। স্যার আমার ইংরেজি পড়ার সাথে সাথে আমার কথা বলার ক্ষমতা বাড়িয়েছিলেন। সোজাসাপ্টা হওয়া শিখিয়েছিলেন। বলতেন – জোরে কথা বলা নয়, কথায় জোর থাকা দরকার।

The post ছেঁড়া পাতা নীল কলম appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3ssJnPq

No comments:

Post a Comment