Thursday, April 30, 2020

ইরফান খান: বলিউডের যেই অভিনেতাকে হলিউডও মনে রাখবে https://ift.tt/eA8V8J

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সিনেমা জগতের সেরা অভিনেতাদের একজন ছিলেন ইরফান খান এবং হলিউডে কাজ করা ভারতের সবচেয়ে সফলদের একজন।

প্রায় ৮০টি সিনেমায় অভিনয় করা অভিজ্ঞ ইরফান খানের বয়স যখন ত্রিশের কোঠায়, সেসময় প্রায় এক দশক টেলিভিশন ইণ্ডাস্ট্রিতে সাফল্য না পেয়ে ভেবেছিলেন অভিনয়ই ছেড়ে দেবেন।

বলিউডের প্রথাগত রোমান্টিক সিনেমার নায়ক হওয়ার মত মুখশ্রী ইরফান খানের না থাকলেও হিন্দি সিনেমার পাশাপাশি লাইফ অব পাই, স্লামডগ মিলিয়নিয়ার ও জুরাসিক ওয়ার্ল্ডের মত হলিউড ফিল্মে অভিনয়ের মাধ্যমে অভিনেতা হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেছিলেন তিনি।

চরিত্রগতভাবে অন্তর্মুখী ও দার্শনিক ধাঁচের ইরফান মাঝে মাঝেই ইসলাম ধর্ম ও তার কাজ করা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিগুলো নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করতেন।

গার্ডিয়ান পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আমি সবসময় বলিউড নামটার বিরুদ্ধে। এই ইন্ডাস্ট্রির নিজস্ব স্টাইল আছে, হলিউডের অনুকরণে এর নামকরণ করার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। এর উৎপত্তি পার্সি থিয়েটার থেকে।”

“হলিউড অত্যন্ত পরিকল্পনামাফিক। ভারতের কোনো পরিকল্পনাই নেই। এটি অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত এবং ঘরোয়া। ভারত আরেকটু আনুষ্ঠানিক এবং হলিউড আরেকটু স্বতঃস্ফূর্ত হলে ভাল হত।”

বাস্তব জীবনে, ইরফান খানের মত দুই ঘরানাতেই সাফল্য অর্জন করতে খুব কম অভিনেতাই পেরেছেন।

প্রথম জীবন

রাজস্থানের টঙ্ক গ্রামে ১৯৬৭ সালের ৭ই জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন সাহাবজাদা ইরফান আলী খান।

তার মায়ের পরিবারের রাথে রাজপরিবারের সম্পর্ক ছিল এবং তার বাবা ছিলেন একজন স্বপ্রতিষ্ঠিত একজন টায়ারের ব্যবসায়ী।

নাম থেকে পরিবারের গৌরবময় অতীতের পরিচায়ক ‘সাহেবজাদা’ অংশটি ইরফান খান পরিত্যাগ করেন। তিনি মনে করতেন তার পরিবারের পরিচয় তার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে বাধা দেবে।

তার বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের প্রত্যাশা অনুযায়ী তিনি বাবার টায়ারের ব্যবসায় বসেননি। অভিনেতা হওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি, যদিও তার পরিবার ও বন্ধুরা এই পেশায় ইরফানের কোনো ভবিষ্যত দেখেননি।

“কেউ চিন্তাও করেনি যে আমি অভিনেতা হতে পারবো। আমি খুবই লাজুক ও শুকনা ছিলাম। কিন্তু আমার ইচ্ছা ছিল প্রবল।”

১৯৮৪ সালে দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় স্কলারশিপ আবেদন করেন তিনি। সেখানে ভর্তির সময় থিয়েটারে অভিজ্ঞতা আছে বলে মিথ্যা তথ্য দেন তিনি।

এ বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমার মনে হয়েছিল ভর্তি হতে না পারলে আমার দমবন্ধ হয়ে যাবে।”

তার ভবিষ্যত স্ত্রী’র – লেখক সুতপা সিকদার – সাথে তার দেখাও হয় একটি ড্রামা স্কুলে।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার স্ত্রী বলেন, “সে সবসময় লক্ষ্যে স্থির ছিল। সে কাজ শেষে ঘরে এসে সোজা বেডরুমে গিয়ে বই পড়া শুরু করতো। পরিবারের বাকি সদস্যরা তখন আড্ডা দিতাম।”

কর্মজীবনের নৈতিকতা

সমসময় সিনেমায় কাজ করার জন্য আগ্রহী হলেও ইরফান খানের শুরুর দিকের চরিত্রগুলো ছিল ভারতীয় টিভি সোপ অপেরার বা সিরিয়ালের।

ভারতে বহু টিভি চ্যানেল থাকায় এবং সেসব চ্যানেলের প্রতিটিতে অনেকগুলো করে ধারাবাহিক নাটক থাকার কারণে অভিনয়ের কাজ পাওয়া যেতো সহজেই, কিন্তু তা দিয়ে শিল্পির মনের খোরাক মিটতো না। এক দশক ধরে ইরফান খান জি এবং স্টার প্লাস নেটওয়ার্কে ‘মধ্যবিত্ত গৃহবধু’দের পেছনেই ছুটেছেন।

সেসময় অভিনয় ছেড়ে দেয়ার কথা ভেবেছিলেন তিনি।

ইরফান একবার বলেছিলেন, “একটি কাজের পর তারা আমাকে টাকাও দেয়নি কারণ তারা বলেছিল আমার অভিনয় খুবই খারাপ।”

বড় পর্দায় ইরফান খানের অভিষেক আরো হতাশাজনক ছিল।

মিরা নায়ারের অস্কার মনোনয়ন পাওয়া সালাম বোম্বে সিনেমায় তরুণ চরিত্র হিসেবে কাজ করলেও শেষপর্যন্ত তার চরিত্রটি মূল সিনেমায় জায়গাই পায়নি।

বড় পর্দায় তারকাখ্যাতি

তার ব্রেক থ্রু আসে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সিনেমা ‘দ্য ওয়ারিয়র’এর মাধ্যমে। হিমালয়ে এবং রাজস্থানে শুটিং করা হয়েছিল সিনেমাটির।

ব্রিটিশ পরিচালক আসিফ কাপাডিয়া ঐ সিনেমাটিতে কোনো প্রতিষ্ঠিত হলিউড অভিনেতার খরচ বহন করতে সক্ষম ছিলেন না, তাই অচেনা কোনো প্রতিভাবান অভিনেতা খুঁজছিলেন।

ঐ সিনেমাটি বাফটায় সেরা ব্রিটিশ ফিল্ম হিসেবে আলেক্সান্ডার কোরডা পুরস্কার পায়।

অস্কারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক তালিকার শর্টলিস্টেও আসে সিনেমাটি, তবে ব্রিটেনের দেশীয় ভাষা হিন্দি না হওয়ায় শেষপর্যন্ত শর্টলিস্ট থেকে বাদ পড়ে।

‘দ্য ওয়ারিয়র’ সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়, আর এই বিষয়টিই ইরফান খানের ক্যারিয়ার তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখে। পরের দুই দশকজুড়ে প্রতি বছরই তিনি পাঁচ থেকে ছয়টি করে সিনেমায় অভিনয় করতে থাকেন।

ড্রামা স্কুলেই ইরফানের প্রতিভাকে কদর করা মিরা নায়ারে – সাথে সম্পর্ক রাখেন ইরফান, যিনি সালাম বোম্বে সিনেমা থেকে তাকে বাদ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে ‘দ্য নেমসেক’ ও ২০১০ সালে ‘নিউ ইয়র্ক, আই লাভ ইউ’ তৈরি করেন তারা।

যে কারণে হলিউডও মনে রাখবে তাকে

২০০৭ সালে ইরফান খান নিউ ইয়র্কে যান তার অভিনিত মাইকেল উইন্টারবটমের ‘এ মাইটি হার্ট’ সিনেমার প্রচারে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি ড্যানিয়েল পার্লের অপহরণ ও হত্যার ঘটনা ও তদন্ত নিয়ে তৈরি করা ঐ সিনমোয় তার সহ অভিনেতা ছিলেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।

নিউ ইয়র্কের সিনেমা হলগুলোতে ঐ সময় ইরফান খানের দু’টি সিনেমা চলছিল। নতুন রিলিজ হওয়া ‘এ মাইটি হার্ট’এর পাশাপাশি ২০০৬ এ বের হওয়া মিরা নায়ারের ‘দ্য নেমসেক’ও চলছিল কয়েকটি হলে।

এর পরের বছর বের হওয়া ড্যানি বয়েলের ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ ছিল তার সবচেয়ে সফল সিনেমাগুলোর একটি। ঐ সিনেমোর সাফল্য ইরফান খানকে হলিউডে প্রতিষ্ঠিত করতে বড় ভূমিকা রাখে। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি একজন ম্যানেজার ও একজন এজেন্ট নিয়োগ দেন।

এরপর কিছুদিনের মধ্যেই ‘দ্য অ্যামেজিং স্পাইডারম্যান (২০১২)’, ‘ইনফার্নো (২০১৬)’ এবং ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড (২০১৫)’-এর মত সিনেমায় অভিনয় করেন ইরফান খান।

জুরাসিক ওয়ার্ল্ডের প্রচারণার সময় সাংবাদিকদের একটি ঘটনা বলেছিলেন ইরফান খান।

১৯৯৩ সালে জুরাসিক পার্ক সিরিজের প্রথম সিনেমাটি যখন বের হয়, তখন তিনি বোম্বের (বর্তমান মুম্বাই) টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতেন। সেসময় টিকিট কেটে ঐ সিনেমা দেখতে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না তার। ২২ বছর পর তিনি ঐ সিরিজেরই এক সিনেমায় অভিনয় করেন, যেটি বিশ্বব্যাপী ১৭০ কোটি ডলারের ব্যবসা করে।

হঠাৎ করেই ইরফান খান হলিউডে অভিনয় করা সবচেয়ে জনপ্রিয় ভারতীয় অভিনেতা হয়ে যান।

তবে অ্যাং লি’র ‘লাইফ অব পাই (২০১২)’ – এর মত বিখ্যাত সিনেমায় অভিনয় করলেও ইরফান খানকে বেশ কয়েকবার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে যে তিনি হলিউডের সিনেমায় ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করবেন নাকি বলিউডের সিনেমায় মূল চরিত্রে অভিনয় করবেন।

মূলত স্লামডগ মিলিয়নিয়ার সিনেমার পর এই সমস্যা শুরু হয় ইরফানের।

তবে শুধু শীর্ষ পর্যায়ে নয়, হলিউডে ছোটোখাটো সিনেমাও করেছেন ইরফান। ২০১৮ সালে অ্যামেরিকান ইন্ডি সিনেমা ‘পাজল’-এ কেলি ম্যাকডোনাল্ডের সাথে অভিনয় করেন তিনি।

ইসলামের সাথে সম্পর্ক

সিনেমার যেসব চরিত্রের সাথে ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক বিষয়ের নিবিড় সংযোগ রয়েছে, সেসব চরিত্রে কাজ করতেন না ইরফান খান – যেমন দীপা মেহতার ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’ এবং মিরা নায়ারের ‘রিলাকট্যান্ট ফান্ডামেন্টালিস্ট।’

নিউ ইয়র্কে ৯/১১’-র হামলা হওয়ার পর দু’বার তাকে লস অ্যাঞ্জেলস বিমানবন্দরে আটক করা হয়, কারণ তার নামের সাথে একজন সন্দেহভাজন হামলাকারীর নামের সাদৃশ ছিল।

একসময় পারিবারিক নাম ‘খান’ও বাদ দিতে চেয়েছিলেন তিনি।

শিয়া ধর্মের উৎসব মহররমের সময় পশু কোরবানির সমালোচনা করে ইসলামিক নেতাদের রোষানলেও পড়েন একসময়।

তিনি বলেছিলেন, “আমরা এসব রীতি পালন করি এর পেছনের অর্থ না জেনেই।”

অসুস্থতা

২০১৮ সালে তার দেহে নিউরোএন্ডোক্রাইন টিউমার শনাক্ত হয় – যা রক্তে হরমোন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে।

তার অসুস্থতার জন্য লন্ডনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি এবং তার ফলোয়ারদের জন্য ইনস্টাগ্রামে একটি কবিতা পোস্ট করেছিলেন – যেখানে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তার অসুস্থতার সাথে মানিয়ে নিতে তার ধর্ম বড় একটা ভূমিকা পালন করেছে।

২০১৮ সালে – ইরফান খান যখন বিশ্বের সামনে তার প্রতিভা তুলে ধরতে শুরু করেছেন কেবল – তখনই জানা যায় যে তিনি নিউরোএন্ডোক্রনিক টিউমারের রোগী।

দুই বছর ক্যান্সার চিকিৎসা চালানোর মধ্যেই ‘আংরেজি মিডিয়াম (২০২০)’ সিনেমার কাজ শেষ করেন তিনি।

ভবিষ্যতে তার আরো অগণিত চরিত্রে অভিনয় করার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু সৌভাগ্যবশত তিনি তার ভক্তদের দেখার জন্য তার শিল্পকর্মের বিশাল রত্নসম্ভার রেখে গেছেন।

The post ইরফান খান: বলিউডের যেই অভিনেতাকে হলিউডও মনে রাখবে appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3f3KBdD

No comments:

Post a Comment