Wednesday, December 15, 2021

সাতক্ষীরার মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ https://ift.tt/eA8V8J

জহিরুল ইসলাম শাহিন
ভারত বিভক্তের পর পূর্ববাংলা পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে চলে যায়-এ কথা সবার জানা। পূর্ববাংলা লাভের পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকচক্র পূর্ববাংলা অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক দিক থেকে কোণঠাসা করে রাখে। পাকিস্তান সরকার সব সময় পূর্ববাংলাকে সন্দেহের চোখে রাখতো এবং পূর্ববাংলার জনগণের প্রতি নিষ্ঠুর নিপীড়ন, নির্মম আচরণ, নির্যাতন, চরম অবহেলা এবং সকল ধরণের মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত ও অবহেলা করতে শুরু করে। পাকিস্তানের পিতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ বাঙালিদের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য প্রথম বাংলা ভাষার উপর আঘাত হানে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে বিরোধী দলীয় উপনেতা ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত কর্তৃক আনীত সংশোধনী প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঘোষণা দেন যে উর্দূই হবে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ঘোষনার পরপরই সারা বাংলার জনগন এবং ছাত্র সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণির পেশার লোক গর্জে ওঠে যার প্রভাব সারা দেশসহ সাতক্ষীরা জেলায় ও পড়ে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দলোনের চুড়ান্ত পর্যায়ে পাকিস্তান সরকার নত স্বীকার করে এবং বাংলাই পূর্ব বাংলার জাতীয় ভাষা হিসাবে স্বাকৃতি লাভ করে। এর পর ৫৪ এর যুক্ত ফ্রন্ট, ৬২’র শিক্ষানীতি, ৬৬ র ছয়দফা, ৬৯ এর গন অভূ্যূন্থান এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সারাদেশে মুক্তি যোদ্ধারা দেশের জনগনের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, নতুন দেশ গঠনের জন্য এবং নিজস্ব স্বাধীনতা নিয়ে স্বাধীন দেশে বসবাস করার জন্য স্বপ্ন দেখা শুরু করলো এবং ইস্পাত কঠিন দৃঢ প্রত্যয় নিয়ে জয় লাভ না করা পর্যন্ত মুক্তি যোদ্ধারা এবং সাহসী বীরের দল আর ঘরে ফিরবে না।

এই স্বধীনতা এবং মুক্তির সংগ্রামে সাতক্ষীরা জেলা পিছিয়ে ছিলনা। ঢাকা থেকে যে সমস্ত কেন্দ্রীয় কর্মসূচী ঘোষণা কর হয় তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের নির্ভিক অকুতোভয় সাহসী সৈনিকেরা। সুতরাং আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি মহান মুক্তিযুদ্ধে সাতক্ষীরা জেলার ছিল গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। দেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় সাতক্ষীরার সকল শ্রেণির ও পেশার মানুষ মুক্তির নেশায় এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল এবং ঝাপিয়ে পড়েছিল পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবন মরণ যুদ্ধে। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ থেকে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই সারা দেশ উত্তাল হয়েছিল। বিভিন্ন দফা ও দাবীতে ২ মার্চ পালিত হয় হরতাল ৩ মার্চ ছিল বিক্ষোভ দিবস। এদিকে পাকিস্তানি দোসরদের গুলিতে সাতক্ষীরার প্রথম শহীদ আব্দুর রাজ্জাকের নামানুসারে পরবর্তীতে শহরের প্রাণকেন্দ্র অবস্থিত চিলড্রেন পার্কটিকে শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্ক নামকরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ মন্ত্র মুুগ্ধের ন্যায় শ্রবণ করার জন্য হাজার হাজার সাতক্ষীরাবাসী অধীর আগ্রহে ছিল। এবং সঠিক দিক নির্দেশনা মুক্তির জন্য থাকার কারনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মান্য করে সাতক্ষীরার মানুষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর সারাদেশের ন্যায় সাতক্ষীরাতে শুরু হয় মুক্তির জন্য এবং পরাধীনতার মালিকের হাত থেকে নিজ দেশ, নিজ অঞ্চল রক্ষার জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। মুক্তিযুদ্ধের এই প্রস্তুতি লগ্নে সাতক্ষীরাতে দুইটি ঘটনা ঘটে। খুলনা ও যশোর শহর পাক বাহিনী কর্তৃক দখলের পর সাতক্ষীরা গমনের প্রস্তুতি নেয় তারা। তাদেরকে প্রতিরোধ করার জন্য অস্ত্রের প্রয়োজন। আর এ জন্য পাক বাহিনীর হানাদার দের রুখে দেওয়ার জন্য ১৪ থেকে ১৭ এপ্রিলের মধ্যে সাতক্ষীরা সংগ্রাম পরিষদ পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের সহযোগীতায় ট্রেজারি থেকে সংগ্রহ করে অস্ত্র, গোলাবারুদ। একাজে স্থানীয় পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা ছিল সাতক্ষীরার জনগণের কাছে অত্যন্ত প্রশংসনীয়। একই সময়ে ১৯ এপ্রিল গভীর রাতে তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) আব্দুল গফুর (পাইকগাছা) ও ইপি আর সুবেদার আইয়ুব আলী সাহেবের নেতৃত্বে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (বর্তমান সোনলী ব্যাংক নামে পরিচিত) সাতক্ষীরা শাখা থেকে একদল সশস্ত্র ইপিআর জোয়ান এবং মুক্তি যোদ্ধার ও কিছু যুবনেতারা এক লাখ পঁচাত্তর হাজার টাকা সংগ্রহ করে। মুক্তিযুদ্ধের খরচ মোটানোর জন্য ব্যাংক অপারেশন ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাপক ও আরো শক্তিশালী করার জন্য রণাঙ্গনকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরে একজন করে অধিনায়ক নিযুক্ত করে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। সাতক্ষীরা অঞ্চল ছিল ৮ম ও ৯ম সেক্টরের অধীনে। নবম সেক্টরের আওতায় ছিল সাতক্ষীরা দৌলতপুর সড়কসহ খুলনার দক্ষিণাঞ্চল এবং বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা, সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নবম সেক্টরে বেশ কয়েকজন সাব সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। তার মধ্যে মোহাম্মদ শাহজাহান-যিনি ক্যাপ্টেন শাহাজাহান মাষ্টার নামে খ্যাত, দেবহাটার উপজেলার বাসিন্দা। বর্তমান আশাশুনি থানা সাতক্ষীরা জেলা থেকে ৩৫ কি. মি. দক্ষিণে অবস্থিত এর পশ্চিম পাশে দেবহাটা ও কালিগঞ্জ থানা এবং পূর্ব দিকে খুলনা জেলা।

 

সেই সময় সাতক্ষীরা সদর থেকে একটি আধাঁ কাঁচা পাকা রাস্তা আশাশুনি পর্যন্ত ছিল। এছাড়া নদীপথ ও আশাশুনি থেকে সাতক্ষীরার যোগাযোগ সুগম ছিল। শত্রু সেনাদের এই যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্œ করার জন্য পাকিস্তান নেভী অফিসারদের মধ্যে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় পালিয়ে আসা সাব মেরিনার লে: গাজী মো: রহমাতুল্লাহ (সেক্টর কমান্ডারর্স ফোরাম খুলনা বিভাগীয় সভাপতি) মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের সাথে পরামর্শ করে প্রথমে আশাশুনি এবং বিপরীত তীরে চাপড়ার স্বাধীনতা বিরোধী আতিয়ার ও মতিয়ারের অবস্থিত রাজাকার ও মিলিশিয়া এবং বাঙালি পুলিশদের শত্রুঘাটি দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য তিনি প্রথমে আশাশুনি থানা আক্রমন করে শত্রু বাহিনীর শক্তি নিরীক্ষা করতে চাইলেন। আশাশুনি থানা এবং বিপরীত তীরে অবস্থিত চাপড়ার পাক বাহিনী দুর্গম ঘাঁটি ছিল। এখানে রেঞ্জারর্স রাজাকার পুলিশ মিলিয়ে দুই কোম্পানী সৈন্য অবস্থান করতো। এলাকাটি সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্গত হওয়ায় এর নিরাপত্তার দায়িত্ব ভার ছিলো ৫৫ ফিল্ড রেজিমেন্টের উপর। এছাড়া ২১ পাঞ্জাব সাতক্ষীরা এবং কলারোয়া অবস্থান করছিলো। এর সাথে আরও শক্তি জোরদার করার জন্য স্থানীয়ভাবে প্রচুর সংখ্যক রাজাকার ভর্তি করে। মুক্তিযোদ্ধা ও মিলিটারিদের মধ্যে প্রায়ই সময়ই সুন্দরবনের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের অনুকুলে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত উভয়ের মাঝে যুদ্ধ লেগে থাকতো। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নদীপথ দিয়ে বাংলাদেশের মধ্য ভাগ মুক্তি বাহিনীর যুদ্ধাস্ত্র পাঠানোর জন্য সর্বোত্তম পথ। এ পথের গতি রোধ করার জন্য অসংখ্য গানবোর্ট সার্বক্ষণিক টহল দিত। এই গানবোর্টের অনেকগুলো নৌ কমান্ডদের হাতে ঘায়েল হয়েছে। পাকিস্তানী নৌ কমান্ডদের অপ্রতিরোধ্য গতিতে কখনও স্তিমিত করতে পারেনি। ফলে সংঘঠিত হয়েছে বার বার যুদ্ধ। পাকিস্তানী শত্রু বাহিনী স্থানীয়ভাবে অনেকগুলো ব্যক্তি মালিকাধীন লঞ্চ রিকুইজিশন বহর সেগুলোকে খুলনা শিপইয়ার্ড থেকে কিছু রুপান্তর করে ৫ কি. মি. কামান ও হেভি মেশিনগান বসিয়ে গানবোর্টে রুপান্তর করে নিরাপত্তা রক্ষার কাজে লাগায়। স্থল ভাগে ও হানাদার বাহিনী কম্বিং অপারেশন শুরু করে। ফলে নৌকমান্ডদের কৈলাশগঙ্গ থেকে তাদের আশ্রয় স্থলে বদল করে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে সরে যেতে বাধ্য করে। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে সুন্দরবন এলাকায় সেনাশক্তি বৃদ্ধির জন্যে সাবমেরিন ও নৌপ্রশিক্ষণ ঘাঁটির অন্যতম সংগঠক লে; গাজী মো: রহমাতুল্লাহর নেতৃত্বে আরও ৩০ জন নৌ কমান্ডসহ একটি মুক্তিযোদ্ধা দল মংলা এলাকায় পাঠানো হয়। পূর্ব দলের সাথে এই দলের সমন্বয় এবং স্থলভাগের যোদ্ধাদের সাথে সমন্বিত হওয়ায় খুলনার দক্ষিণ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি বেশ বেড়ে যায় এবং সাথে সাথে গড়ে ওঠে শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য একটি বৃহৎ মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন। এরপর গাজী রহমাতউল্লাহের নেতৃত্বে ছাত্র নেতৃত্বদের সাথে সমন্বিত যুদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং সাতক্ষীরা ও খুলনার দক্ষিণ অঞ্চলে শত্রুঘাটি একের পর এক মুক্ত করতে থাকেন। ঐ সময়ে আশাশুনি ও শ্যামনগর এলাকায় রাজাকারদের শক্তি, অত্যাচার, নীপিড়ন এবং হিংসাত্মক মনোভাব বেশ বেড়ে যায়। ফলে এই সমন্বিত মুক্তিযোদ্ধা দল আশাশুনি থানা দখলের পরিকল্পনা করেন। আশাশুনি থানা দখলে আনতে পারলে সাতক্ষীরার ও খুলনার দক্ষিণ অঞ্চল তথা সুন্দরবন এলাকা মুক্ত অঞ্চলে পরিণত হবে। সে অবস্থায় মংলাসহ নৌ বন্দরগুলোতে নৌ কমান্ডাদের অপারেশন চালানো অনেক সহজ হবে। এমন ধারনা পোষণ করে সমন্বিত মুক্তিযোদ্ধা ও নৌকমান্ড বাহিনী আশাশুনি থানা ও তদসংলগ্ন এলাকা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন এই লক্ষ্যে ৬ অক্টোবর রাতে সম্মিলিতভাবে আক্রমন চালানো হয় আশাশুনি থানায়। কিন্তু শত্রু বাহিনীর নিরাপত্তা রক্ষর্থে এখানে থানার ছাদসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন বাড়ির ছাদে বাঙ্কার বানিয়ে রেখে ছিল ফলে সারা রাত যুদ্ধে মুক্তি বাহিনীর ১১জন যোদ্ধা মারাত্মকভাবে জখম হয়েছিল। সেদিন ঐ ভয়াবহ যুদ্ধের নেতেৃত্বে ছিলেন মেজর শামছুল আরেফিন, লে: গাজী রহমত উল্লাহ, খিজির কামরুজ্জামান টুকু, স ম বাবর আলী ও শেখ আব্দুল কাইয়ুম।

 

প্রথম দিনের যুদ্ধে তালা দখল সম্ভব না হলেও মুক্তিবাহিনী নিরাশ না হয়ে পর দিনই আবার আশাশুনি থানায় আক্রমন পরিচালনা করেন। ঐ দিন নৌ কমান্ডোরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অপর পাড়ে থানার ঘাটে ভাসমান ফেরি পল্টুনে বিস্ফোরণ ঘটান। বিস্ফোরণে সমস্ত এলাকা কম্পিত হয়েছিল এবং সমগ্র ফেরীঘাট তছনছ হয়ে যায়। ফলে এই দৃশ্য দেখে শত্রুবাহিনী ও রাজাকাররা অবস্থান ছেড়ে পালাতে থাকে। এ যুদ্ধে ১১ জন পাকসেনা ও ৪০ জন রাজাকার নিহত হয়। মুক্তি বাহিনী ৪ দলে বিভক্ত হয়ে থানা আক্রমন করে এবং পাক বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী ভয়ে দিকবিদিক ছুটা ছুটি শুরু করে। কমান্ডার জিএম গফফারের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি দল আশাশুনি সাতক্ষীরা সড়কের সাথে একটি ব্রিজ এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। তখন মুক্তি বাহিনীর অনেক সদস্যই শত্রু বাহিনীর সামনে দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে থানায় গিয়ে ওঠেন। ভয়াল যুদ্ধ দেখেই দখলদার বাহিনী ও রাজাকাররা অস্ত্র গুলি ফেলে পালিয়ে সদরে আশ্রয় গ্রহন করেন। পরদিন পাকিস্তানী বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে নিরীহ গ্রামবাসির উপর বৃষ্টির মত গুলি ও বোমা ফেলতে থাকে। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছুহটে সুন্দরবনে আশ্রয় নেয়। পরবর্তিতে আশাশুনি থানাসহ দখলদার বাহিনীর পতন হলে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাঙ্কার থেকে ১০-১২ জন বাঙালি যুবতীকে উদ্ধার করে। এই যুদ্ধে ৪০জন রাজাকার বন্দী হয়। ২৯ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা আবারো সুসজ্জিত হয়ে আশাশুনি থানায় পার্শ্ববর্তী নদীর বিপরীত পাড়ে চাপড়া গ্রামে পাকবাহিনীর দোসর আতিয়ার মতিয়ারের বাড়িতে অবস্থানকারী রাজাকার ঘাঁটির উপর প্রচন্ড আক্রমন পরিচালনা করেন। রাজাকার ও ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে কোন প্রতিরোধ ছাড়াই অবস্থান ত্যাগ করে আত্মরক্ষা করেন, কয়েকজন ধরাও পড়েন। ৩১ অক্টোবর প্রচুর গুলি ও ১৫টি রাইফেলসহ ১৫ জন রাজাকার হেতালবুনিয়া ক্যাম্পে লে: রহমত উল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করেন। উল্লেখ্য আত্মসমর্থনকারী রাজাকাররা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছে এবং পরবর্তিতে তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাতক্ষীরা জেলার গৌরবোজ্জল ভূমিকা আছে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে উজ্জীবিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে সকল কলেজে প্রশিক্ষণ এরপর ভারতে উন্নত আর্মড প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। মুজিব বাহিনী, মুক্তি বাহিনী গঠন করে অসংখ্য যুদ্ধ পরিচিালনা করা হয়। মুজিবনগরে স্থাপিত বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অর্থ বাবদ কয়েক কোটি টাকা সাতক্ষীরার মুক্তি যোদ্ধারা প্রদান করেন। সাতক্ষীরার অসংখ্য যুদ্ধের মধ্যে সাতক্ষীরার পাওয়ার হাউজ উড়িয়ে দেওয়া ও দেবহাটা টাউন শ্রীপুরের যুদ্ধের কথা উল্লেখযোগ্য। ৭ জুন ১৯৭১ দেবহাটার টাউন শ্রীপুরে ঐতিহাসিক যুদ্ধে শহীদ হন কাজল, নাজমুল, নারায়ন এবং আহত ও পঙ্গু হন এরশাদ হোসেন খান, চৌধুরী হাবলু ছাড়া আরও অনেকে। সাতক্ষীরা জেলার সমগ্র মুক্তি সংগ্রামে এবং যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী মেজর এম. এ. জলিল, লে: রহমত উল্লাহ, মো: কামরুজ্জামান টুকু, স ম আলাউদ্দীন, এএফম এন্তাজ আলী, স ম বাবর আলী, ক্যাপ্টেন শাহাজাহান মাষ্টার, মোস্তাফিজুর রহমান, কামরুল ইসলাম, খান আব্দুল মুয়িদ, খান চৌধুরী দুলু, মনসুর আহম্মেদ, আবু নাসিম ময়নাসহ সকল মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সাতক্ষীরাবাসী চিরদিন চির স্মরণীয় করে রাখবে। এদের মধ্যে স ম আলাউদ্দীন ছিলেন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। মহান মুক্তিযুদ্ধে যে ক’জন এমএলএ সরাসরি অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে স ম আলাউদ্দীন অন্যতম। তিনি মুক্তিযদ্ধের সংগঠক হিসেবে সরসরি যুদ্ধে অংশ নেন। একইভাবে এএফএম এন্তাজ আলীও সরসরি মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে অংশ নেন। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মতো সাতক্ষীরা জেলায় ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সাতক্ষীরা জেলাকে, জেলার সকল জনগণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে শান্তিপূর্ণভাবে সকলে এক যোগে, একসাথে পারস্পারিক সহানুভুতি ও সহযোগীতা নিয়ে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও উন্নত জেলায় পরিণত হবে এ আশা আমরা করতে পারি। ইতোমধ্যেই সাতক্ষীরা জেলা বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মতো আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে, এ কথা অনস্বীকার্য। সকল কৃতিত্ব মহান মুক্তিযোদ্ধাদের। আমরা তাদেরকে স্যালুট জানাই। লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু মহিলা কলেজ, কলারোয়া, সাতক্ষীরা

The post সাতক্ষীরার মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3eb2f09

No comments:

Post a Comment