Tuesday, April 27, 2021

খরতাপে পুড়ছে সাতক্ষীরার উপকূল https://ift.tt/eA8V8J

রনজিৎ বর্মন, সুন্দরবনাঞ্চল (শ্যামনগর): বৈশাখের খরতাপে পুড়ছে বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূল। বৃষ্টির দেখা নেই, তাপদাহে জনজীবন নাকাল। বৈশাখের প্রথম দিকে এমন খরতাপ সামনে অপেক্ষা করছে আম- কাঁঠাল পাকানো ভরা মধুমাস।

সে সময়ে এই জনপদের জন্য কেমন আবহাওয়া অপেক্ষা করছে এমন আলোচনা মানুষের মধ্যে। দিনে ও রাতে নাভিশ^াস। গরমে গাছগাছালির পাতাও নড়তে দেখা যাচ্ছে কম। ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সকল জিনিসপত্র গরমে যেন তেঁতে উঠছে। বাতাসে আদ্রতা কম থাকায় ফ্যানের বাতাসও যেন গরম হয়ে উঠছে।

বৃষ্টিপাত সংকট ও অধিক তাপমাত্রায় উপকুলের কৃষি খরায় আক্রান্ত কৃষকের দুচিন্তা বৃদ্ধি: বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী গত কয়েক মাসে কোন বৃষ্টিপাত নেই। ফলে বৃষ্টিপাতের রেকর্ড নেই। বৃষ্টি নির্ভর ফসল চাষিদের মাথায় হাত উঠেছে। উপকূলের শ্যামনগর লবণাক্ত এলাকা হিসেবে পরিচিত। শুষ্ক মৌসুমে কৃষি ফসলের ক্ষেত, লবণ পানির চিংড়ি ঘের, পুকুর বা জলাশয়ে সর্বত্র অন্যান্য মৌসুমের তুলনায় লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে যায়। প্রচন্ড খরায় শ্যামনগর উপজেলার ধূমঘাট, কৈখালী, মুন্সিগঞ্জসহ অন্যান্য এলাকার রসাল ফল তরমুজ মুটিয়ে ছোট হয়ে গেছে। কিন্ত বৃষ্টি না থাকায় তরমুজ সাইজ ও ওজনে কম হয়েছে। বাজারে দেখা যায় ছোট ছোট গুটি গুটি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে।

শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ গ্রামের আম চাষি পরিমল রায় বলেন প্রচন্ড খরায় আমের গুটি শুকিয়ে পড়ে যাচ্ছে। জেলেখালী গ্রামের বাসিন্দা নিরঞ্জন মন্ডল বলেন তার লিচু গাছের লিচু শুকিয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া অতিরিক্ত গরম থাকায় ক্ষেতের শাকসবজি লাল শাক, ঢেঁড়স, মিষ্টি কুমড়া অন্যান্য ফসল শুকিয়ে যাচ্ছে।

শ্যামনগর উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ এসএম এনামুল ইসলাম বলেন, পানি সংকটের কারণে তরমুজের সাইজ ছোট হচ্ছে, বাঁকা হচ্ছে। আবার কোথাও পোকার আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, বৃষ্টির পানিতে ভিটামিন বিশেষ করে নাইট্রোজেন থাকে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে এবার তরমুজ ফসল কাক্সিক্ষত উৎপাদন না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

শ্যামনগরে দিনে দিনে বোরো ধান চাষের আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর এর উপরে জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিসের উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মো: জিয়াউল হক বলেন, সব ফসলের জন্য বৃষ্টি প্রয়োজন। কিন্ত এবার শীতের পর থেকে বলা যায় বৃষ্টির দেখা নেই। ফলে বোরো ধানের কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া নিয়ে কিছুটা হলেও শঙ্কা রয়েছে।
তাপপ্রবাহ ও লবণাক্ততায় উপকূলের মৎস্য সম্পদ মরতে বসেছে: শ্যামনগর সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার তুষার মজুমদার বলেন, তাপদাহের কারণে উপজেলায় শতকরা ৮০ ভাগ চিংড়ি ঘেরে মাছ মারা যাচ্ছে। চিংড়ি সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রী পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে কিন্তু বর্তমানে তার বেশি তাপমাত্রা পড়ায় ঘেরের মাছ মারা যাচ্ছে। একই সাথে পানির পিপিটিও বেড়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। চিংড়ি ঘেরগুলিতে পানি কম থাকায় তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় মাছ মরছে অধিকাংশ ঘেরে। বর্তমানে লবণ পানির মাছের ঘেরে লবণাক্ততা সর্বোচ্চ ২৫ পিপিটি পাওয়া গেছে।

টানা খরতাপ ও বৃষ্টি শূণ্যতায় ঔষধী গুণ সম্পন্ন সুন্দরবনের মধু ঐতিহ্য হারাতে যাচ্ছে: উপকূলের সুন্দরবন সংলগ্ন দাতিনাখালি গ্রামের মৌয়াল আজগর আলি, আব্দুল হালিম বলেন, বৃষ্টি হলে মধু প্রাপ্তি বেশি হয়। প্রচন্ড খরায় মধু শুকিয়ে যায়। গাবুরা এলাকার মেীয়াল আবুল কাশেম, মুন্সিগঞ্জ গ্রামের মৌয়াল সিরাজুল ইসলাম বলেন, গাছে মধু থাকলেও অন্যান্য বার এক একটি চাকে মধু বেশি পাওয়া যেত কিন্তু এবার বৃষ্টি নেই ফলে মধুর চাকে মধু কম পাওয়া যাচ্ছে।

বন গবেষক ঋজু আজম বলেন বৃষ্টির সাথে মধু উৎপাদনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বৃষ্টি কম হলে গাছে ফুল কম হয় আর ফুল কম হলে মধুর প্রাপ্তিও কম হয়।
খাওয়ার পানির সংকট বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ছে রোগ: দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকা শ্যামনগরে খরায় চলছে সুপেয় পানির সংকট। লবণাক্ত এলাকা হিসেবে বিভিন্ন এলাকায় সারা বছর কমবেশী সুপেয় পানির সংকট থাকে। কিন্ত শুষ্ক মেীসুমে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করে থাকে। বর্তমানে উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ, ঈশ^রীপুর, রমজাননগর, কাশিমাড়ী, পদ্মপুকুর, কৈখালী ইউনিয়নসহ অন্যান্য এলাকায় পানির জন্য পিএসএফ বা অন্যান্য উৎস থেকে নারীরা লাইন দিয়ে কলস নিয়ে পানি সংগ্রহ করছেন। সম্প্রতি উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউপির দুর্গাবাটি সাইক্লোন শেল্টার সংলগ্ন পানিউন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে যেয়ে খোলপেটুয়া নদীর লবণ পানিতে এলাকা প্লাবিত হয় এর ফলে পুকুর বা জলাশয় লবণ পানিতে ভরে যাওয়ায় খাওয়ার পানির সংকট দেখা যায়। গত ১৮ এপ্রিল ভাঙ্গনকৃত এলাকাবাসীর আয়োজনে খাওয়ার পানির দাবীতে সুন্দরবন সংলগ্ন মুন্সিগঞ্জ প্রধান সড়কে নারী ও পুরুষের অংশ গ্রহণে এক মানববন্ধনের আয়োজন করে থাকেন।

বৈশাখের তাপদাহে বিভিন্ন এলাকায় খাল বিল শুকিয়ে ফেটে গেছে। মাঠ ফেটে যাওয়ায় জমিতে ঘাস কম হওয়ায় গবাদিপশুর খাদ্য সংকটও দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় শুকনো মেীসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পুকুর পুন:খনন কাজ করছেন অনেকে। উপজেলা সদরের বাদঘাটা গ্রামের দিনমজুর শম্ভু মন্ডল, কালাম গাজী বলেন তারা এক দল শ্রমিক সকালে ও বিকালে কয়েকটি পুকুর পুন:খনন কাজ করছেন।

শ্যামনগর জলবায়ু বিশেষজ্ঞ লির্ডাসের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল বলেন বর্তমানে প্রচন্ড খরতাপ চলছে এর ফলে খরা বিরাজ করছে। অত্যাধিক তাপপ্রবাহের কারণে মাটির ময়েশ্চর কমে যাচ্ছে। লবন পানির স্তর ভূগর্ভস্তরের কাছাকাছি চলে আসছে। এর ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর লবনাক্তা বৃদ্ধির কারণে ফসল মারা যাচ্ছে, ব্যাপকভাবে খাওয়ার পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। তাপপ্রবাহের কারণে বৃদ্ধ মানুষের হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকছে। তিনি বলেন উপকূলীয় এলাকায় বেশি বেশি তাপ মাত্রার বৃদ্ধির ফলে বিশেষ করে কৃষি ফসল ক্ষতি হতে পারে ও খাওয়ার পানির সংকট বেড়ে যেতে পারে।

দীর্ঘদিন উপকূলীয় এলাকায় নারীদের নিয়ে কাজ করছেন নকশীকাঁথার পরিচালক চন্দ্রিকা ব্যানার্জী বলেন তাপপ্রবাহ বৃদ্ধি ও খরার কারণে নারীদের প্রধান সমস্যা খাওয়ার পানি। পরিবারের সকলের কথা চিন্তা করে নিজেকে পানি কম করে পান করতে হয়। তিনি বলেন, দেহের চাপা অংশগুলোতে ঘাম জমে খুব সহজে রোগ সংক্রমণ হয়। যেমন দাদ, চুলকানি, ঘামাচি, একজিমা, ফোঁড়া প্রভূতি। এ সময় দেখা যাচ্ছে পেটের পীড়া ও নারীদের ইউরিন জনিত সমস্যা।

শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার বিপ্লব কুমার দে বলেন, প্রচন্ড তাপদাহের কারণে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্তমানে ডায়রিয়া, পেটেরপীড়া ও চর্মরোগীর সংখ্যা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এছাড়া বড় ছোট সকল বয়সের মানুষের সর্দ্দি,কাশি দেখা যাচ্ছে। গরমের কারণে পেটের পীড়া ও চর্মরোগ বেশি দেখা যায়।

 

উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে ভর্তিকৃত রোগীর মধ্যে শিশু ও বয়স্ক প্রায় ডায়রিয়া আক্রান্ত। উপজেলার দেবীপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি অনিরুদ্ধ কর্মকার সম্পদ বলেন, ক্লিনিকে বর্তমানে প্রত্যহ তাপপ্রবাহের জন্য ৪০/৪৫ জন রোগী ডায়রিয়া, সর্দ্দিকাশি জনিত রোগী আসছেন চিকিৎসার জন্য।

পরিবেশবিদদের আশঙ্কা: আবহাওয়াবিদদের মতে শিলাবৃষ্টির প্রধান শর্ত প্রচন্ড গরম। আমাদের দেশে বৈশাখ মাসে গরম পড়ে। প্রচন্ড গরম পড়লে কালবৈশাখী নামে পরিচিত ঝড়ের সময় শিলাবৃষ্টি হয়। প্রচন্ড গরমে বাতাসে উর্ধ্বমুখী চাপ সৃষ্টি হয় ফলে কালবৈশাখী হয়।

পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএন এর বড় ধরনের একটি গবেষণায় বরাত দিয়ে বিবিসি নিউজ বাংলা ২০১৯ সালের ৭ ডিসেম্বর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষণের কারণে মহাসাগর গুলোতে অক্সিজেন কমে যাচ্ছে। যার কারণে ক্ষতি হতে পারে মাছের অসংখ্যা প্রজাতি।

শ্যামনগর সরকারি মহসীন ডিগ্রী কলেজের প্রভাষক ড. প্রতাপ কুমার রায় বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশে^ বৃদ্ধি পাচ্ছে তাপমাত্রা। তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিরুপ প্রভাব পড়ছে মানুষ, প্রকৃতি, জীব ও উদ্ভিদের উপর। তাপ বৃদ্ধির ফলে এক দিকে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্য দিকে শীতল অঞ্চলের বরফ গলে পুরা পৃথিবীর উপর পড়ায় এই দ্বৈত চাপ মোকাবেলা করা মানুষ ও প্রকৃতির জন্য কঠিন হচ্ছে। তিনি বলেন বৈশি^ক তাপমাত্রা এমন হারে বাড়তে থাকলে এক সময় মানুষ সহ সকল জীব পৃথিবীতে অভিযোজন থেকে ছিটকে পড়তে পারে। তাপপ্রবাহ বা দাবদাহ বৃদ্ধির ফলে উপকুলীয় অঞ্চল বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে মত প্রকাশ করেন।

একদিকে বৈশি^ক মহামারী কোভিড-১৯, অন্যদিকে প্রচন্ড তাপদাহ। এযেন এক অন্যরকম জীবনযাত্রা। এ ছাড়া বর্তমান সময়ে চলছে পবিত্র রমজান মাস। করোনা প্রতিরোধে লকডাউনের কারণে সাধারণ মানুষ বাড়ীতে থাকলেও ক্ষেত খামারের কাজও প্রচন্ড তাপমাত্রার কারণে করতে পারছেন বলে অনেক কৃষক জানান। নাভিশ^াস গরমের মধ্যে কৃষকদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে ‘আল্লহ মেঘ দে, পানি দে, আরও দে ছায়া।’

The post খরতাপে পুড়ছে সাতক্ষীরার উপকূল appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3eFEoFH

No comments:

Post a Comment