Wednesday, May 27, 2020

প্লাবিত উপকূল: সুপেয় পানির জন্য হাহাকার https://ift.tt/eA8V8J

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সুপার সাইক্লোন ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে একের পর এক ভেঙেছে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ। ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়েছে  সাতক্ষীরার সব কয়টি উপজেলা। এতে পানিতে ভাসছে উপকূলের শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ ও খুলনার কয়রাসহ কয়েকটি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। দিনে দুইবার ডুবছে আর দুইবার জাগছে উপকূলবাসি। ২০ মে, বুধবারকয়েক ঘণ্টার তাণ্ডবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরাকে তছনছ করে গিয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। যত দিন এগোচ্ছে, পরিস্থিতি ততই ভয়াবহতা হচ্ছে। শুধুমাত্র গাছপালা ভেঙে পড়া এবং বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে যাওয়ার মধ্যেই ক্ষয়ক্ষতি সীমাবদ্ধ নেই। ওইদিন প্রাথমিকভাবে মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবা একেবারেই বিকল হয়ে গিয়েছিল। সেসব পরিষেবা যত স্বাভাবিক হচ্ছে, ক্ষয়ক্ষতির সামগ্রিক চিত্রটাও ধীরে ধীরে সামনে আসছে।সুন্দরবনের বাইরে সাতক্ষীরাসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বাড়িঘর সমেত সর্বস্ব হারিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছেন সাধারণ মানুষ। ভেসে গেছে শতশত মাছেরঘের ও কাকড়ার খামার। ফসলের ক্ষেত পানিতে ডুবে গেছে। সুন্দরবনের কোলে শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী ও কাশিমাড়ি ইউনিয়ন, আশাশুনির সদর, প্রতাপনগর, আনুলিয়া ও প্রতাপনগর ইউনিয়ন এবং খুলনার কয়রা উপজেলার চারটি ইউনিয়নে ঘূর্ণিঝড়ের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। কয়েক লক্ষ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানে। পানির তোড়ে ভেসে গিয়েছে বাড়িঘর।পানি যেখানে উঠতে পারেনি, সেখানে আবার ঝড়ের দাপটে উড়ে গিয়েছে অসংখ্য কাঁচাবাড়ির চাল। দরমার দেওয়াল সমেত খড়ের চাল ভেঙে পড়ার ছবিও সামনে এসেছে।এরআগে ২০০৯ সালে আইলার সময়ও একই অবস্থা দেখা দিয়েছিল এসব এলাকায়। সেইসময় রিং বাঁধ নির্মাণ করে পানি আটকানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়।কিন্তু বেড়িবাঁধ নির্মাণের সেই পরিকল্পনা লাল ফিতায় আটকে থাকে প্রায় ১১টি বছর। এ অভিযোগ স্থানীয়দের। এঁদের মধ্যে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা তাদের মাছের খামার রক্ষায় বেড়িবাঁধ নির্মাণে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।চরম খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে উপকূলজুড়ে। সেখানে  কোথাও কোথাও একবুক পর্যন্ত পানি জমেছে। বহু বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের পর আটদিন কেটে গেলেও, এখনও ভাঙা বাঁধের মেরামত হয়নি। সেখানে প্রচুর গাছপালা ভেঙে পড়েছে। পানির তোড়ে ভেসে গিয়েছে বহু বাড়িঘর ও দোকানপাট। তার মধ্যেই ত্রিপল খাটিয়ে কোনও রকমে মাথা গুঁজে রয়েছেন সাধারণ মানুষ।এই সমস্ত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছে দিতে ইতোমধ্যেই সরকারের তরফে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে ত্রাণ কম বলে অভিযোগ আসছে অনেক এলাকা থেকেই। ত্রাণ কাজে নেমেছে অনেক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক সংগঠন।এদিকে দুর্গত এলাকায় সুপেয় পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। বন্যা দুর্গত আশাশুনি উপজেলার অনেকেই ত্রাণ পায়নি। ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। গবাদিপশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন গোটা উপকূল। ফলে জ্বলছে বিদ্যুতের আলো, ঘুরছে না পাখা। নলকূপগুলো রয়েছে পানির নিচে। রাস্তাগুলোর উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে জোয়ার-ভাটা। রাস্তাগুলো ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে।ঘূর্ণি আম্পানের আটদিন অতিবাহিত হলেও ভাঙন কবলিত বাঁধ বাঁধা যায়নি। বরং নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এদিকে,কা‌লিগ‌ঞ্জ-শ্যামনগর সীমান্ত এলাকার গোয়ালঘেসিয়া নদীর ঘোলায় ঘূ‌র্ণিঝড় আম্পা‌নে ভাঙনকব‌লিত বে‌ড়িবাধ সংস্কা‌রের কাজ চল‌ছে। কালিগঞ্জ উপ‌জেলা চেয়ারম্যান সাঈদ মে‌হেদী জানার, তাঁর নেতৃ‌ত্বে স্বেচ্ছাশ্র‌মের ভি‌ত্তি‌তে হাজার হাজার মানু্ষ সেখা‌নে কাজ কর‌ছেন।আশাশুনির শ্রীউলা ইউনিয়নের বাসিন্দা যুবলীগ নেতা তোষিকে কাইফু জানান, বানভাসি মানুষের মাঝে সুপেয় খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্র, ওয়াপদা ও আশাশুনি টু ঘোলা কোলা রোডের উপরে আশ্রয় নেওয়া মানুষের জন্য পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। হাজরাখালী, মাড়িয়ালা, কলিমাখালী, লাঙ্গলদাড়িয়া গ্রামের বানভাসি মানুষ চরম দুর্দিনে রয়েছে।বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক ডাঃ আ ফ ম রুহুল হক এমপির নির্দেশে বানভাসী মানুষের জন্য সুপেয় বিশুদ্ধ পানি সরাবরাহ করে যাচ্ছে আশাশুনি উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কাজ করছে মেডিকেল টিমের সদস্যরা।এদিকে,সাতক্ষীরার উপকূলের অনেক ইউনিয়নে মানুষের বাড়ি ঘরে মধ্যে এখনও জোয়ার-ভাটা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে না পেয়ে অধিকাংশ এলাকার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণে নেমে পড়েছে। কিন্তু নদীতে প্রবল জোয়ার থাকায় বাঁধ টেকানো যাচ্ছে না। এক পাশের বাঁধ দিয়ে বাড়ি ফিরতেই আরেক পাশে ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।জানা যায়, মঙ্গলবার ভোর থেকে বেলা ১২টায় সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের লেবুবুনিয়া ৩ কিলোমিটার বেড়ি বাঁধ ৮ হাজার জনগণকে সাথে নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম নির্মাণ করে বাড়ি ফিরতেই প্রবল জেয়ার সেটা ভেঙে আবারও লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। এদিকে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালী ও কাশিমাড়ি ইউয়িনের ঘোলা এলাকার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে রিং বাঁধ নির্মাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।শ্যামনগরের গাবুরা গাইনবাড়ি এলাকার আব্দুল হাসান বলেন, এলাকার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গ্রামের ৭ থেকে ৮ হাজার মানুষ যেয়ে ৭ঘন্টা কাজ করে বাঁধ দিয়ে বাড়ি ফিরতেই আবারও নতুন করে আরো তিন জায়গায় ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বুড়িগোয়ালিনী এলাকা থেকে আব্দুল হালিম জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের দিন দাতিনাখালী এলাকায় পাউবোর বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। সেখান থেকে আজ পর্যন্ত নদীর সাথে লোকালয়ের জোয়ার-ভাটা চলছে। পানিউন্নয়ন বোর্ডের কোন খবর নেই। আমাদের নিজেদের বাঁচা নিজেদের বাঁচতে হবে। তাই স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামত করি। সম্পূর্ণ এলাকা এখনও মেরামত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু নরম মাটিতে বাঁধ খুব বেশি শক্ত হচ্ছে না। পানির চাপে আবার যে কোন মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে।শ্যামনগরের গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম বলেন, ঝড়ের পর বাঁধ ভেঙে এখনও এলাকায় জোয়ার-ভাটা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাউকে আমাদের সাথে পায়নি। তবে তারা বাঁশ বস্তা দিয়ে আমাদের সাহায্য করেছে। আম্পানে গাবুরার লেবুবুনিয়ায় বাঁধের তিন কিলোমিটার নদীতে বিলিন হয়ে যায়। ঈদের দিনও ৮হাজার জনগণ বাঁধ নির্মাণে কাজ করছে। ৪টি জায়গায় নতুন করে বাঁধ ভেঙে গেছে। নদীতে প্রবল জোয়ার। কোন কিছু টিকছে না। শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউপি চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডল বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন খবর নেই। আমার ইউনিয়নের দাতিনাখালী এলাকায় জনগনকে সাথে নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করেছি। কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। নদীতে জোয়ার-ভাটা চলার কারণে সময় লাগবে। জোয়ারের চাপ কমলে আমরা আবারও কাজ করবো।তিনি আরও বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতির কারণে আমাদের এই অবস্থা। পানিতে ডুবে হাবুডুবু খেতে হচ্ছে উপকূলের কয়েক লাখ মানুষের। খুব বিপদে আছি।শ্যামনগরের কাশিমাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ বলেন, ঝড় হয়ে গেছে আজ ৮দিন হয়ে গেলো। নদীর বাঁধ ভেঙে এলাকার সাথে একাকার হয়ে আছে কেউ খবর নিচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে ৫ হাজার জনগণ সাথে নিয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ করে করেছি । এখন তো বাঁধ দিতে পারবো না। রিং বাঁধ দিয়ে পানি ঠেকাতে হচ্ছে। না হলে অনেক গ্রাম নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যাবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ দেয়। এছাড়া তাদের কোন খোঁজ নেই। দেখতে আসে না আমাদের কাজে সাহায্য পর্যন্ত করে না। তাদের ফোন দিলে তারা বলে সেনাবাহিনী কাজ করবে বলে তারা এড়িয়ে যায়। যখন এক জায়গায় বাধঁ বেঁধে বাড়ি ফিরছি তখন অন্য দিকে ভেঙে যাচ্ছে।সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আবুল খায়ের বলেন, গাবুরা এলাকার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করতে চেয়েছেন, তাদের আমরা বস্তা দিয়ে সাহায্য করেছি। তারা যেটা চাচ্ছে তখন সেটা সরবরাহ করছি। আমরা তো কাজ করি না। ঠিকাদারা কাজ করে কিন্তু ঠিকাদার নিয়োগ করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তারপরও এলাকায় পানি বন্ধ করতে তাদের সাহায্য করছি।সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো: নাহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা ঈদের দিনেও কাজ করেছি। সেনাবাহিনী কাজ করবে। সে কারণে রিপোর্ট করতে হচ্ছে। যারা স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করেছে, তাদের সকল প্রকার বস্তা ও বাঁশ দিয়ে আমরা সাহায্য করেছি।সার্বিক বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে ১২ হাজার ৬৯৮ টি মাছেরঘেরে ১৭৬ কোটি ৩ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে। কৃষিতে মোট ১৩৭ কোটি ৬১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে ৬৫ কোটি ১৮ লক্ষ ৪০ হাজার টাকার আম, ৬২ কোটি ১৬ লক্ষ টাকার সবজি, ১০ কোটি ২২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকার পান ও ৪ লক্ষ ৫০ হাজার তিল রয়েছে। গরু ছাগল হাঁস-মুরগি মিলে ৯৫ লক্ষ ৩৮ হাজার ৬১৬ টাকার ক্ষতি হয়েছে আম্পানের আঘাতে। এছাড়া জেলায় মোট ৮৩ হাজার চারশত ৩১টি ঘর বাড়ি বিধ্বস্থ হয়েছে। এরমধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্থ হয়েছে ২২হাজার ৫১৫টি এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬০ হাজার ৯১৬টি। জেলায় ৮১ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এছাড়া ৫৬.৫০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

এসএম শহীদুল ইসলাম:

The post প্লাবিত উপকূল: সুপেয় পানির জন্য হাহাকার appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3ekNw0u

No comments:

Post a Comment