শ্যামনগরে উন্নয়নকান্ডের নামে শ যত্রতত্র বোরিং করে বালু উত্তোলন: হুমকিতে জীব ও প্রাণ বৈচিত্র
শ্যামনগর প্রতিনিধি: উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নে গঙ্গার মোড় থেকে কালিন্দি নদী ও পরানপুর বিজিবি ক্যাম্প পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার কার্পেটিং রাস্তা নির্মাণের কাজ সম্প্রতি শুরু হয়েছে। তিন কোটি টাকা ব্যয়ে কাজটি সম্পন্নের দায়িত্বে রয়েছে রফিকুল এন্টারপ্রাইজ নামীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান প্রায়। প্রাথমিকভাবে মাটির কাজ শেষ হতেই এখন চলছে বালু ভরাটের কাজ। দীর্ঘ ৩ কিলোমিটার এ সড়কের জন্য প্রয়োজনীয় বালু সংগ্রহ করা হচ্ছে পাশের চিংড়ি ঘের ও ফসলী জমি থেকে।
কার্যাদেশ অনুযায়ী দরপত্রে প্রতি ঘনফুটের জন্য ২৭ টাকা বরাদ্দ থাকার পরও নির্দিষ্ট জায়গার পরিবর্তে সংশ্লিষ্টরা অধিক মুনাফার আাসায় পাশের জমি থেকে বালু সংগ্রহ করছে। বালু উত্তোলনের সাথে জড়িতরা ঠিকাদারের নিকট থেকে সমগ্র রাস্তার জন্য ৬ টাকার চুক্তিতে বালু সরবরাহ করতে যেয়ে স্থানীয়ভাবে তা উত্তোলন করছে। স্থানীয়ভাবে জমি মালিকদের উপর প্রভাব খাটিয়ে তারা মাটির গভীর থেকে ‘বুম’ পদ্ধতিতে ড্রেজার মেশিনের সহায়তায় ঐ বালু উত্তোলন করছে।
একইভাবে শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের কাশিপুর এলাকায় দেড় কিলোমিটার কার্পেটিং রাস্তা নির্মান কাজের জন্য সেখানে ১৫ ইঞ্চি করে বালু ভরাট করা হচ্ছে। ১ কোটি ৪২ লাখ টাকার এ কাজের জন্য নির্ধারিত জায়গার পরিবর্তে সংশ্লিষ্টরা পাশের কাশিপুর খাল থেকে অভিন্ন পদ্ধতিতে বালু উত্তোলন করছে। দরপত্রে প্রতি ঘনফুট বালুর জন্য প্রায় ৩০ টাকা বরাদ্দ সত্ত্বেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৭ টাকার চুক্তিতে জনৈক আব্দুল গফ্ফারের মাধ্যমে জনবসতির মধ্যভাগ থেকে ঐ বালু সংগ্রহ করছে। স্থানীয়রা বাঁধা সৃষ্টি করায় সংশ্লিষ্টরা প্রভাব খাটানোর পাশাপাশি গোপনে অব্যাহতভাবে বালু উত্তোলন চালু রেখেছে।
তবে শুধু কৈখালীর গঙ্গার মোড় কিংবা শ্যামনগরের কাশিপুর এলাকা না। বরং বুড়িগোয়ালীনির মহীন্দ্র মাছের আড়ৎ, কৈখালীর বিজিবি ক্যম্পসহ নুরনগর, ঈশ^রীপুর ও পদ্মপুকুরের বিভিন্ন অংশেও ফসলী জমি, চিংড়ি ঘের আর জলাশয় থেকে বালু উত্তোলন চলছে। রাস্তা ও বিদ্যালয় ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মানের পাশাপাশি ইট ভাটার কাজ আর ডোবা নালা ভরাটের কাজে একইভাবে বালু উত্তোলন অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে সদ্য শেষ হওয়া খ্যাগড়াঘাট এবং এক কোটি টাকা ব্যয়ে খানপুর এলাকায় দুটি রাস্তা নির্মানের জন্য পাশের খাল ও কৃষি জমি থেকে সমুদয় বালু উত্তোলন করা হয়েছে। আবার শুরুর অপেক্ষায় থাকা মুন্সিগঞ্জের কাপালীপাড়া ও নুরনগরের দাসকাটি এলাকার রাস্তা নির্মানের জন্য তদসংলগ্ন জমি থেকে বালু উত্তোলনের তোড়জোড় চলছে পুরোদমে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে মুলত ‘বুম’ পদ্ধতিতে ড্রেজার মেশিনের সহায়তায় মাটির গভীর থেকে বোরিং করে এসব বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিকট থেকে সাব-কন্ট্রাক্ট নেয়া স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালীরা বালু উত্তোলনের সাথে জড়িতদের মাধ্যমে এমন কান্ড ঘটাচ্ছে।
বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টদের দাবি উন্নয়ন কর্মকান্ড সচল রাখতে তারা এ কাজ করছে। তবে যত্রতত্র বোরিং করে বালু উত্তোলনের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে স্থানীয়রা। তাদের অভিযোগ বার বার আপত্তি জানানো সত্ত্বেও কোনভাবে বালুখোরদের আটকানো যাচ্ছে না। দুর্যোগ প্রবন এলাকা থেকে বালু উত্তোলনের ঘটনায় তারা দারুণ শংকিত বলেও জানায়।
কৈখালী গ্রামের গোলাম মোর্ত্তজা জানান, রাস্তাঘাটসহ সরকারি যেকোন কাজের সময় সংশ্লিষ্টরা পাশের খাল বিল থেকে বালু তুলছে। গত কয়েক বছর ধরে এ প্রবনতা মারাত্বকভাবে বেড়ে গিয়েছে। স্থানীয়রা বাঁধার সৃষ্টি করলে তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দেয়াসহ উর্ধ্বতন রাজনৈতিক নেতা আর প্রশাসনের আশির্বাদ থাকার কথা জানানো হয়।
কৈখালী এলাকার কয়েক গ্রামবাসীর অভিযোগ সেখানকার কার্পেটিং রাস্তা নির্মানের জন্য সেকেন্দার শেখ ও আব্দুল জলিলসহ কয়েকজনের চিংড়ি ঘেরে বোরিং করে প্রায় আড়াই কিলোমিটার রাস্তার বালু সরবরাহ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে শুরুতে আপত্তি করা হলেও তা আমলে না নিয়ে জোরপুর্বক সেখান থেকে বারু উঠায় সংশ্লিষ্টরা।
দাতিনাখালীর আনিছুজ্জামান জানান খ্যাগড়াঘাট এলাকার রাস্তা নির্মানের সময় পাশের জমি থেকে বালু উঠানোর সময় তিনি প্রশাসনকে অবহিত করেন। তবে কয়েকদিন বন্ধ রাখার পর ঠিকাদারের লোকজন একই অংশ থেকে বালু উঠিয়ে কাজ করেছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন এলাকার প্রভাবশালীরা মুলত ঠিকাদারের পক্ষে বালু উত্তোলনের কাজ করছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসনকে আড়াল করে বাইরে থেকে ভাড়ায় সরঞ্জামাদী আনিয়ে নির্বিঘেœ এসব জনবসতি থেকে বালু উত্তোলন চালিয়ে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট বালু মহালের বালু সংগ্রহে খরচ বেশী হওয়ার কারনে স্থানীয়ভাবে কৃষি জমি আর চিংড়ি ঘেরসহ জলাশয়গুলো থেকে বালু উঠানো হচ্ছে বলে তারা জানায়।
বালু উত্তোলনে জড়িত বাগমারীর আব্দুল গফ্ফার জানান, আমরা শ্রমিক। ঠিকাদারের লোকজন আমাদের যেখান দেখিয়ে দেয়, সেখান থেকে আমরা বালু তুলে দিই। স্থানীয়রা বাঁধা দিলে আমরা আর বালু উঠায় না।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান রফিকুল এনটারপ্রাইজের সত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম সংবাদকর্মী বলার পর ব্যস্ততার কথা বলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
বকুল হোসেন নামের অপর এক ঠিকাদার বলেন কাশিপুর এলাকায় স্থানীয় একটি মসজিদের কথা ভেবে স্থানীয়দের আহবানে বালু উত্তোলন করা হয়। তবে পরবর্তীতে কিছু মানুষ বাঁধা দেওয়াতে বালু উত্তোলনের কাজ বন্ধ করা হয়েছে।
উপজেলা প্রকৌশলী শেখ সাইফুজ্জামান সোহাগ বলেন, উন্নয়ন কর্মকান্ডের প্রয়োজনে ব্যবহৃত বালুর জন্য দরপত্রে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকে। এলাকার ক্ষতি করে বোরিং করে বালু উত্তোলন বন্ধে স্থানীয় সরকার বিভাগ আন্তরিক। কোন প্রকল্পে এ ধরনের অভিযোগ উঠলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্তা নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
পরিবেশ কর্মী শেখ লামিয়া তাহসীন তৌশি বলেন, অধিক মুনাফার জন্য সংশ্লিষ্টরা যত্রতত্র বোরিং করে বালু উত্তোলন করায় পরিবেশ হুমকির মধ্যে পড়ছে। স্থানীয় জীব বৈচিত্রসহ প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এখনই স্থানীয়ভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনের আন্তরিক হস্তক্ষেপের কথা জানান তিনি।
The post শ্যামনগরে বালু উত্তোলনে হুমকিতে জীব ও প্রাণ বৈচিত্র appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3djkhNe
No comments:
Post a Comment