Friday, April 2, 2021

পরাবাস্তবতার আলোকে রূপসী বাংলার কবি https://ift.tt/eA8V8J

লাবন্য শাহিদা
‘পৃথিবীর এইসব গল্প বেঁচে র’বে চিরকাল এশিরিয়া ধুলো আজ বেবিলন ছাই হয়ে গেছে।’ বাঙলা ভাষায় যাঁরা আধুনিক কবিতা সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে পঞ্চপান্ডবের নাম প্রথমেই আসে। রবীন্দ্রনাথের পর তাঁরাই বাঙলা ভাষার প্রধান কবি। তাদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ অন্যতম। হুমায়ূন আজাদের মতে, ‘আধুনিকদের মতে এখন জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে জনপ্রিয়; এবং অনেকের মতে-শ্রেষ্ঠ’। রবীন্দ্রনাথের কাছে তার কবিতা ছিল ‘চিত্ররূপময়’। বুদ্ধদেব বসুর কাছে তিনি ‘নির্জনতম কবি’। তার প্রথমদিকের কাব্যে নজরুলের প্রভাব থাকলেও ক্রমে তিনি নিজস্ব সত্তা আবিষ্কার করে হয়ে উঠেন ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী। এই তিমির হননের কবি তার মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের দিকে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন। জীবনানন্দ যেন বাঙালীর এক চিরন্তন সত্তা। পরাবাস্তবতার মোড়কে বাঁধা তিনি রূপসী বাংলার কবি।
‘আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;
বলেছিলোঃ ‘এ নদীর জল
তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল;
সব ক্লান্তি রক্তের থেকে
স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;
এই নদী তুমি।’
জীবনানন্দের কবিতার শব্দ মোমের মত মনের ভিতরে গিয়ে লাগে। বেঁচে থাকার পথে কামনা গুলো বোধহয় এমনি ভাবে ছুটে আসে। তাই প্রিয়তমা তার কাছে তাই নদীর মত। তার কবিতার এমনি রেশ যেন চিত্রকল্পময়।
আধুনিকদের মধ্যে ব্যক্তিগত জীবনে সবচেয়ে ব্যর্থ ছিলেন জীবনানন্দ। সম্ভবত মা কুসুমকুমারী দাশের প্রভাবেই ছেলেবেলায় পদ্য লিখতে শুরু করেন। মৃত্যু হয়েছিল তার দুর্ঘটনায়; ট্রামের নিচে প’ড়ে লোকান্তরিত হয়েছিলেন তিনি। হয়তো আত্মহত্যা করেছিলেন। করুণা, স্বপ্নকাতর আর বিষাদে শোভাময় তার প্রতিটি কবিতা। জীবনের ক্লান্তি, হতাশা আর বিষণ্নতা তার কবিতার মর্মে মর্মে। বাঙলার প্রাকৃতিক শোভা তার কবিতায় অপরূপ ভাবে ফুটে উঠেছে। তার মত এমন মন্ত্রমুগ্ধ উপমার ব্যবহার খুব কমই দেখা গেছে বাকিদের মাঝে। একসময় তাকে শুধু কবিই ভাবা হত, পরে তার কিছু অপ্রকাশিত আর অজ্ঞাত উপন্যাস পাওয়া যায়। দুর্ভাগ্য যে ত্রিশের দশকে এগুলো খুঁজে পাওয়া যায়নি। না’হলে ঔপনাসিকের পদবি টাও নামের পাশে শোভা পেত তখন। কিন্তু যখন বেঁচেছিলেন, তখন কিছুই পাননি জীবনানন্দ।
জীবনানন্দের উল্ল্যেখযোগ্য দিক তিনি কবিতাকে মুক্ত আঙ্গিকে উত্তীর্ণ করে গদ্যের স্পন্দনযুক্ত করেন, যা পরবর্তী কবিদের প্রবল ভাবে আলোড়িত করে। তার কবিতা মানে আধুনিকতা, যুগযন্ত্রণা, আধুনিক জীবন দর্শন ও চেতনার আলোচনা। ইতিহাসের চেতনা দিয়ে যিনি অতীত ও বর্তমানকে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে বেধেছে। স্বভাবে ছিলেন তিনি অন্তমুর্খী, তার দৃষ্টিতে বিদ্যমান চেতনা আর হৃদয় ছিল পরাবাস্তবতায় মোড়া। যে সময়ে এসে বাঙালী জীবনানন্দকে আবিষ্কার করেছ তখন আমাদের মন রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীতে বিলীন, তাই বিংশ শতাব্দীর মানুষের কাছে জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রনাথেরই পরিপূরক।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বার বার বাংলার প্রকৃতিকে ফিরে পাওয়া যায়। এত অপরূপ ভাবে প্রকৃতিকে পাওয়া যায় যে, যার তুলনা তিনি নিজেই। তিনি রূপকথা-পুরাণের জগৎকে তার কল্পমানসে তুলির মাধ্যমে এঁকেছে। বিশষত রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থে যেভাবে আবহমান বাংলার চিত্ররূপ ও অনুসূক্ষ্ম সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতেই তিনি রূপসী বাংলার কবি হিসাবে খ্যাত হয়েছেন। কবি লিখেছেন, ‘মানুষের ব্যাথা আমি পেয়ে গেছি পৃথিবীর পথে এসে-হাসির আস্বাদ পেয়ে গেছি’। আবার কবি বলেছেন, ‘আমাদের রুক্ষ প্রশ্ন, ক্লান্ত ক্ষুধা, স্ফুট মৃত্যু- আমাদের বিস্মিত নীরব রেখে দেয়- পৃথিবীর পথে আমি কেটেছি আঁচড় ঢেড়, অশ্রু গেছি রেখে তবু ঐ মরালীরা কাশ ধান রোদ ঘাস এসে এসে মুছে দেয় সব’। পরাবাস্তবতার মিশেলে তার হৃদয় যেন উপচে উঠে প্রতি লাইনে। প্রকৃত সত্য কেবলমাত্র অবচেতনেই বিরাজ করে। পরাবাস্তববাদী শিল্পীর লক্ষ্য হল তার কৌশলের মাধ্যমে সেই সত্যকে গভীর থেকে তুলে আনা । জীবনানন্দ যেন পরাবাস্তবতাকে গভীর ভাবে ফুটিয়ে তুলতে সফল হয়েছে। কবি চিত্তে বারবার বলে উঠে, ‘’দূর পৃথিবীর গন্ধে ভ’রে উঠে আমার এ বাঙালির মন আজ রাতে; একদিন মৃত্যু এসে যদি দূর নক্ষত্রের তলে’।
জীবনানন্দ প্রেমের চিতা পোষণে যেন দগ্ধ করেছে অন্তর আত্মাকে। তিনি লিখেছেন, হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয়-চিতা শুধু প’ড়ে থাকে তার, আমরা জানি না তাহা;- মনে হয় জীবনে যা আছে তাই শালিধান। প্রেমের সত্তা থেকে কবি মানস যেন হাহাকারে ভরে গিয়েছিল। তাই সুরঞ্জনাকে ডাকতে গিয়েও যেন তার কন্ঠ রোধ হয়ে আসছিল। যেখানে কবি বলছে, ‘সুরঞ্জনা, আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছো; পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন; কালো চোখ মেলে ওই নীলিমা দেখেছো; গ্ৰীক হিন্দু ফিনিশিয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন ,শুনেছো ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা-নগরীর গায়ে। কী চেয়েছে? কী পেয়েছে? Íগিয়েছে হারায়ে’। কবিতার প্রতি ছন্দে ছন্দে যেন সুরঞ্জনা হেঁটে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে।
আপনি পরাবাস্তবতা ভালবাসলে আপনি জীবনানন্দকে আরো কাছ থেকে দেখতে পাবেন। জীবনানন্দ তার দেখা প্রতিটি সাধারণ দৃশ্য কে রুপকল্প দিয়ে সাজাতে পারত। যার ফলে, পাঠকের কাছে তা এক দারুন প্রতিচ্ছবি হয়ে ভেসে আসত। এই জন্য তার লেখা আধুনিক মানুষের কাছে আজ পরাবাস্তবতার সম্যকরূপে বিবেচিত হচ্ছে। জীবিত জীবনানন্দ দেখে যেতে পারেনি তার রুপকল্প আজ বাঙালি হৃদয়ে লালন করছে। নিজেদের দৃশ্যপটে একে তাকে স্মরণ করছে প্রতি মুহুর্তে। আকাশের রৌদ্র ধুলো থেকে সরে যিনি স্বপ্নের হাতে ধরা দিতে বলেছে কবিতার মধ্যে। ভালাবাসাকে তিনি লিখেছেন,
‘এইসব ভালবাসি-জীবনের পথে ঘুরে এইসব ভালোবেসে আমার হৃদয়
ঘরে আলো, বৃষ্টি ক্ষান্ত হ’ল সন্ধ্যায়
যখন ঘরের দীপ জ্বলে ওঠে সন্ধ্যায়-ধীরে ধীরে বৃষ্টি ক্ষান্ত হয়’

The post পরাবাস্তবতার আলোকে রূপসী বাংলার কবি appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3rKHHQj

No comments:

Post a Comment