Thursday, April 22, 2021

গবেষকের পেশাকে গুরত্বের সাথে দেখার সুযোগ দিতে হবে https://ift.tt/eA8V8J

অজয় কান্তি মন্ডল:

যেকোন দেশের উন্নতির প্রধান সোপান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। যেখানে আমাদের দেশ বেশ পিছিয়ে।এই পিছিয়ে থাকার ভিতরে বেশ কিছু কারন বিদ্যমান আছে। সবগুলোর মধ্যে অন্যতম কারন সরকারের গবেষণা খাতে বরাদ্দের অপ্রতুলতা। সাথে আছে গবেষকদের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব। যেখানে আমাদের পাশের দেশগুলো হর হামেশায় আমদেরকে টপকে উপরে উঠে যাচ্ছে সেখানে আমরা সবসময়ে পিছু হটছি।

গবেষণার জন্য দেশের সরকারী বরাদ্দ সত্যিই অপ্রতুল।এজন্যই দেশের গবেষণা খাতে যথেষ্ট অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়না। বাইরের দেশ থেকে প্রযুক্তি কিনে নিয়ে দেশে বাস্তবায়ন করার থেকে দেশেই যদি সেই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা যায় তাহলে তার সুফল সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সবাই পাবে। যেটা হতে পারে দেশকে ডিজিটাল সেবার দোরগোড়ায় পৌছে দেওয়ার খুবই সহজ পন্থা।

দেশে যেসব সরকারী বা স্বায়ত্তশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোর অবস্থা সত্যিই নাজুক। এর একমাত্র কারন গবেষকদের গবেষণা কাজে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না পাওয়া।গবেষণার ভিতর যে আনন্দ আছে সেই আনন্দটা পাওয়ার মত সুযোগ আমাদের দেশেরগবেষকরা পায়না। পরিসংখ্যান ঘাটলে দেখা যায় বেশীরভাগ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে হাতে গোনা খুবই কম সংখ্যকই গবেষক, গবেষণাকে আনন্দের খোরাক হিসেবে নিয়ে বেশ ভালো থেকে ভালোতর করছে।

বাকিরা নামেমাত্র গবেষণা করে চলেছেন এবং গবেষণা কাজকে চাকুরী হিসেবে নিয়েছেন। চাকুরী বলতে নিয়ম মাফিক অফিস করা এবং মাস গেলে বেতন তুলে সংসারের ভরন পোষণ করা। নিজেদের মেধাকে গবেষণার পিছনে ব্যয় করার মত মন মানসিকতা তাদের দিনকে দিন আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বেশীরভাগ গবেষকদের মধ্যে এই চিন্তাধারা তৈরির একটা ধারাবাহিকতা পূর্ব হতে চলে আসছে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা একজন ছাত্রছাত্রী যখন কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে কিছুদিনের কর্মজীবনের পরেইসে হতাশায় ভুগতে শুরু করে। চাকুরীজীবনেরপ্রথমে বেশ উৎফুল্ল থাকলে ও বেশিরভাগদেরই হতাশা শুরু হয় তাদের ঊর্ধ্বতন বসদের থেকে। প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধার কারনে বসরা পাইনি তাদের নায্য অধিকার, যথাসময়ে চাকুরীতে পদোন্নতি। উপরন্তু নিত্যসঙ্গী হিসেবে বাড়তি উপদ্রব হয়েছেসংসারের টানাপোড়ন। এর ফলে কি হয়েছে?

সবাই গবেষণাকে চাকুরী হিসেবে নিয়েছেন। গবেষণা কাজের জন্য নয়। শুধুমাত্র নিজেদের কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির জন্য যেটুকু দরকার হয় সেটুকু করেই বছরের পর বছর হাত পা গুঁটিয়ে বসে থেকেছেন। এর পেছনে ও অবশ্য বেশ কিছু কারন আছে। যখনই তারা কাজে হাত দিতে গেছেন তখনই নানান সীমাবদ্ধতা, যেমনঃ পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতির অভাব, রাসায়নিক দ্রব্যাদির অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারনে আবারো পিছিয়ে এসেছেন।

এর ফলশ্রুতিতে সবার ধারণাটা এমন হয়েছে যে,“গবেষণা করে তো আমি বিশাল কোন সুযোগ সুবিধা পাব না, তবে কেন এত কষ্ট করে আমাকে গবেষণা করতে হবে?”‘হ্যাঁ’ কথাগুলো আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই তুলে ধরলাম।

দেশের একজন গবেষক তার সংসারের ভরণপোষণ, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া সহ আনুসঙ্গিক অন্যান্য খরচাদি সরকারী বেতন ভাতাদির সাথে কতটা সামঞ্জস্য সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। আর সেজন্যই একজন গবেষকের গবেষণা কাজে মনোনিবেশ করেওঅনেক পিছুটানে তাকে ফিরে আসতে হয়। কেননাতার তো চাকুরীর বেতনের বাইরে অন্য কোন আয়ের সুযোগ নেই। আর সেজন্যই মাসের শেষে তাদের সংসারের জন্য নিত্যদিনের বাজারের ব্যাগের ওজনটাও আস্তে আস্তে কমতে থাকে।

অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। ভারতের একজন গবেষক আমাদের দেশের গবেষকের কয়েকগুন বেতন পেয়ে থাকেন।সেখানে গবেষকদের মূল্যায়ন করা হয় দেশের নামীদামী ব্যক্তিদের একজন হিসেবে।চীনের চিত্র তো পুরোটাই অবাক করার মত। চীনে একজন গবেষক মানে তিনি মহৎ পেশার সাথে জড়িত। একজন গবেষককে চীনারা দেশের সেরা ব্যক্তি হিসেবে গন্য করেন।

সাথে সুযোগ সুবিধার কোনরকম ঘাটতি নেই। বেশি সংখ্যক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশেও আছে বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা। সুবিধা বলতে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা। একজন ছাত্র যখন তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রী শেষ করে তখন তার গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করে দেশি টাকায় পাঁচ লাখের ও বেশি আয় করে ফেলে। আর তখন থেকেই তার ভিতরে গবেষণার আগ্রহ অনেক গুনে বেড়ে যায়। সেটাই স্বাভাবিক। যখনই দেখা গেছে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশে চীন সরকার বাড়তি সুবিধা হিসেবে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা দেওয়া শুরু করেছে তখন থেকেই চীনের গবেষণা সেক্টর দৌড়াতে শুরু করেছে।

যার ফলশ্রুতিতে চীন খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে বিশ্বের সেরা গবেষণা পত্র প্রকাশের রেকর্ডে অবস্থান করছে। সেইসাথে এগুলোর সুফল ও চীন হাতেনাতে পাচ্ছে। প্রযুক্তিগত সবদিক দিয়ে চীন বিশ্বের নাম্বার ওয়ানে যাওয়ার এখন মাত্র সময়ের ব্যাপার। চীন সরকার মনে করে যেটাতে আমাদের ভবিষ্যৎ মূল্য আছে সেটার পেছনে আমরা কেন অর্থ ব্যয় করবনা? চীনাদের দৈনন্দিন জীবনের সবখানেই প্রযুক্তির ছোয়া এনে দিয়েছে সেদেশের গবেষকরাই। তাইতো চীন এখন আমেরিকা, রাশিয়ার মত অনেক উন্নত দেশকেও তোয়াক্কা করেনা।

চীন, ভারত পারলে আমরা কেন পারবনা? কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও আমাদের দেশের চিত্র সকল দেশের থেকে আলাদা। দেশে গবেষকদের কোন কদর তো নেই বরং তাদেরকে অবহেলার চোখে দেখা হয়। তাইগবেষকরা ও ধরে নিয়েছে তাদের পেশাটা দেশের অন্যান্য সকল চাকুরীজীবীদের চেয়ে নিরীহ পেশা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে পাশ করা ছাত্রছাত্রীরাই এই গবেষণা সংশ্লিষ্ট কাজে যুক্ত হন।আর একটু পরিস্কার করে বলতে গেলে এভাবেই বলতে হয়।

দেশের নামীদামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহের সবথেকে টপ র‍্যাঙ্কের প্রথম সারির ছাত্রছাত্রীরাই যোগ দেন গবেষণা সংশ্লিষ্ট কাজে। হতে পারে সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নতুবা কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। এরপর অনেক আশা নিয়েই গবেষণা শুরু করেন। আর হতাশাটাও শুরু হয় তখন থেকে। বেশ কিছু কারনে এই হতাশা শুরু হতে থাকে।

আমাদের দেশের গবেষকদের পদোন্নতির জন্য নানান জটিলতায় বসে থাকতে হয় বছরের পর বছর।সকল শর্তাবলী পূরনের পরেও গবেষকদের পদোন্নতি পেতে কারও বসে থাকতে হয়েছে যুগের পর যুগ। অথচ যেখানে বাইরের দেশগুলোতে পদোন্নতির জন্য পর্যাপ্ত চাহিদা পূরণ হলেই তারা স্বয়ংক্রিয় ভাবে পদোন্নতি পেয়ে যাচ্ছে। সেজন্য খুবই অল্প বয়সেই বড় মানের গবেষক বনে যেতে সময় লাগছে না।

আবার পদোন্নতি পেয়েও তারা নিজেদেরকেআগের চেয়ে ভালভাবেই গবেষণা কাজে ধরে রেখেছেন। তা না হলে যেকোন মুহূর্তে তাদের পদোন্নতি থেকে আবারো অবনতি হওয়ার ভয় আছে। যার ফলে গবেষণা সবসময় মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহারে সেখানে কোন ঘাটতি দেখা যায়না।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে অতিদ্রুত পদোন্নতির বিষয়টা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তুসেখানে ও বেশ কিছু সমস্যা আছে। অনেক শিক্ষক পদোন্নতি পেয়ে সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছেন তো গবেষণায় ইতি টেনে দিয়েছেন। সবার ক্ষেত্রে বিষয়টা প্রযোজ্য না হলেও এই রীতির অনুসারীরা ও একেবারে কম না।কেননা পদোন্নতি পাওয়ার পরেউচ্চপদ থেকে নিচে নামার রীতি আমাদের দেশে নেই। তাই পদোন্নতির জন্য শুধুমাত্র যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু করেই সবাই ক্ষ্যান্ত থাকেন।পদোন্নতির পর্ব তো শেষ।

একদিক দিয়ে বিবেচনা করলে বলা যায় অন্যান্য গবেষকদের চেয়ে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সুযোগ সুবিধা সামান্য হলেও বেশি। কিছু না হলেও তারা যথাসময়ে পদোন্নতি পান এবং খুবই অল্প সময়ে উচ্চ গ্রেডের বেতন ভাতাদি পেয়ে থাকেন।যেহিসেবে শিক্ষকরা সবাই পদোন্নতি পেয়ে উচ্চতর গ্রেডে উঠে যাচ্ছে ঠিক সেই হিসেবে দেশের গবেষণা সেক্টরে উন্নতি হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, প্রায়শই দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর র‍্যাঙ্কিং দিনকে দিন নিচের দিকে যাচ্ছে। যেটা মোটেও আশাব্যাঞ্জক নয়।

আমাদের দেশের মেধাবীরা যখন উচ্চশিক্ষায় দেশের বাইরে পাড়ি জমায় তখন তাদের মেধার বহিঃপ্রকাশ সত্যিই প্রশংসনীয়। তাইতো বিভিন্ন কঠিন প্রতিযোগিতায় তারা নিজেদেরকে সেরা থেকে সেরা প্রমানিত করে। উন্নত বিশ্বের কাছে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে। আমাদের দেশের সন্তানরা কোনকিছুতে হার মানেনা সেটাও তারা বিশ্বকে ভালো করে বুঝিয়ে দেয়। বিপরীত ক্রমে এর একটা খারাপ প্রভাব ও আমাদের দেশে পড়ে। কেননা তাদের ভিতরে সিংহভাগই দেশে ফেরেনা। শুধুমাত্র দেশে বিদ্যমান সুযোগ সুবিধার সাথে তাদের মেধার মূল্যায়নের সঠিক মাপকাঠি তারা পায়না।

যেটা তাদের ফিরতে অনুৎসাহিত করে। বিদেশে বহু পরিচিত বন্ধু বান্ধব আছে যারা ইতোমধ্যে ডক্টরেট ডিগ্রী শেষ করেই সেখানে পোস্ট ডক্টারল গবেষক হিসেবে গবেষণা শুরু করেছে। দেশে ফিরে আসার ব্যাপারে তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে অনেক হতাশা ব্যাঞ্জক কথা শোনায়। এটায় বাস্তব চিত্র। গভীরভাবে ভাবলে আমরা পরিস্কার ধারণা পাব। এসব উচ্চশিক্ষিত গবেষকদের যদি উপযুক্ত গবেষণা বান্ধব পরিবেশ দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনা যেত তাহলে দেশ আমেরিকা বা চীন হয়ে যেতে বেশিদিন সময় লাগত না সেটা জোর দিয়েই বলা যায়।

সবকিছুর থেকে পরিত্রানের পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। আমাদের দেশে মেধাবীর অভাব নেই। শুধু অভাব আছে উপযুক্ত পরিবেশের যেখানেতাদের মেধাকে যথাপোযুক্ত খাটানো যায়। বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে অগ্রগতি ছাড়া দেশের সার্বিক উন্নয়ন আদৌ সম্ভব নয়। তাই সরকার তথা সংশ্লিষ্ট সকলকে বিষয়টা অতীব গুরুত্বের সাথে ভাববার বিষয় বলে প্রতীয়মান হয়। খুবই সহজ সমাধান হতে পারে শুধুমাত্র গবেষণা সংশ্লিষ্ট কাজে সামান্য সহায়তা বাড়িয়ে। সহায়তা

গুলোর মধ্যে হতে পারে গবেষণা বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং সেই সাথে গবেষকদের সামান্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। আর্থিক সহায়তার পরিমান সামান্য দিয়েই শুরু করা যেতে পারে যেটা নির্ভর করবে প্রকাশিত গবেষণা পত্রের পদমর্যাদার উপর। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে চীনের নেওয়া পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো যেতে পারে। সেটাতে আশানুরূপ ফল পেলেই আমাদের গবেষণা খাতের উন্নতির সাথে সাথে দেশ ও তড়িৎ গতিতে এগিয়ে যাবে। সেইসাথে সকল গবেষক শুধুমাত্র পদোন্নতির জন্যই প্রয়োজনীয় শর্তাবলী পূরণ করে বসে না থেকে নিজেদের মেধার সর্বোচ্চ এবং সঠিক ব্যবহারে সচেষ্ট হবেন। সাথে সাথে দেশ ও বীরদর্পে এগিয়ে যাবে উন্নত থেকে উন্নততর বিশ্বের দিকে।

 

লেখকঃ অজয় কান্তি মন্ডল, গবেষক, ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজো, ফুজিয়ান, চীন।

Email: ajoymondal325@yahoo.com

The post গবেষকের পেশাকে গুরত্বের সাথে দেখার সুযোগ দিতে হবে appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3xiKzYv

No comments:

Post a Comment