কোহিনূর বিনতে আবুবকর
মানুষের ক্ষমতা অসীম। কতটা অসীম তা মানুষ নিজেই জানে না। কখনও প্রতিকূল পরিবেশ আর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেই মানুষ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয় তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা অপরিসীম সেই ক্ষমতা আর সম্ভাবনাকে। এই ক্ষমতা আর সম্ভাবনা নিজের অজান্তেই প্রত্যেকটা মানুষ আপন অস্তিত্বের অভ্যন্তরে লালন করে। মানুষ যখন স্বীয় অস্তিত্বের গভীরে প্রবল ইচ্ছাশক্তি বা ‘উইল পাওয়ার’ উপলব্ধি করে তখন সে নিজেই নিজেকে উৎসাহিত করতে সক্ষম হয় এবং নিজেকে উদ্বুদ্ধ করে এগিয়ে নিয়ে যায় অসম্ভবকে সম্ভব করতে অমিত সম্ভাবনার এক স্বর্ণময় সোনালী দ্বারপ্রান্তে, যেখান থেকে সে শুধু সম্মুখেই চলতে থাকে, পিছু হটে না আর কখনও।
আমার দেশ আর আমার দেশের মানুষের কথা বলছিলাম। বলছিলাম, আমার সাতক্ষীরা আর উপকূলীয় আরও কয়েকটি এলাকার মানুষের অপরিসীম মনোবল আর সম্ভাবনার কথা। সেই ২০ মে’র পর ফোনালাপে যে বর্ণনা শুনেছি, তারপর বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের পর থেকে বিভিন্ন অন লাইন নিউজ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুপার সাইক্লোন আম্পান এর ধংসযজ্ঞের যে চিত্র দেখেছি এবং পড়েছি তাতে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের জন্য ব্যাকুলতাই শুধু বেড়েছে দিনকে দিন। এমনি অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতেও অবিচল এলাকার মানুষের মাঝে যে দুর্জয় এবং অবিসংবাদিত মনোবল আর শক্তির বহি:প্রকাশ দেখেছি অপ্রতিরোদ্ধ এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে, বার বার তা শুধু অবাক বিস্ময়ে অনুভব করেছি, উপলব্ধি করেছি। আর আবিস্কার করেছি, উদ্বুদ্ধ করেছি নিজেকে, তাদেরই একজন আমিও যে তেমনি অপার সম্ভাবনাময়ী, অমিত শক্তির আধার, অপরাজেয় বীরত্বে বাঙময়। এই বীরত্ব গাঁথা লীন হয়না কখনও, ক্ষীণও হয় না। শেষ হয় না, হবেও না কোনোদিন। বার বার, প্রতিবার এই বীরত্বের স্বাক্ষর রাখি আমরা আইলা, সিডর, ফণী, বুলবুলের মত জীবন বিধ্বংসী ঝড়-তুফান আর জলোচ্ছাসের বিরুদ্ধে। এবারও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। প্রকৃতি বুঝি আমাদের বীরত্বের এই জ্বলন্ত আলোকরশ্মিকে বিলীন হতে দিতে চায় না, তাই বারে বারে সে ফিরে আসে আমাদেরই মাঝে কখনও আইলা, কখনও সিডর কখনও বা আম্পান নামে।
বীরের জাতি এই বাংলার মানুষ, কোথায় না আছে তাদের বীরত্ব গাঁথা! কী ভাষায়, কী স্বাধীনতায়, কী স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতায়! সারা বিশ্বব্যাপী সকল শ্রেণির মানুষ যখন করোনা মহামারি ঠেকাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে, তখন আমার দেশের ঘুর্ণিদুর্গত উপকূলীয় কিছু মানুষ করোনা মহামারীর কবলে লক ডাউনে থেকেও গৃহহীন হয়ে যায়, ভেসে যায় বাঁধ ভাঙা জলোচ্ছ্বাসে তাদের সাজানো গোছানো স্বপ্ন-সাধ-সংসার। পানিতে তলিয়ে যায় সব লোকালয়, মাছের ঘের। লোনা পানি দখল করে নেয় মানুষের পানযোগ্য পানির সকল আধার। গবাদি পশুর যেটুকু চারণভূমি সব বিলীন হয়ে যায়, মানুষে-পশুতে একই সাথে সব পাশাপাশি বসবাস গাছ তলায়, নৌকায় অথবা পানির ওপরে বাঁধা অস্থায়ী টোঙে। ফসলী ক্ষেতের ফসল বাঁধ ভাঙা ¯্রােতে সব একাকার। বাম্পার ফলন আ¤্রকাননে আম্পানের ধংসযজ্ঞ চুকিয়ে দিয়ে গেছে কৃষকের সকল হিসাব নিকাশ। আর মাত্র একটা সপ্তাহের অপেক্ষা ছিল তাদের, সময়-শ্রম-অর্থ দিয়ে অতি যতেœ পরিপক্ক করে তোলা আমগুলো বাজারজাতকরণের। সর্বনাশী ঝড়ের তান্ডবে বৃষ্টির বারি বর্ষণ যতটা না ছিল তার থেকে বেশি ছিল আ¤্র বর্ষণ। মুহূর্তেই গাছতলগুলো সয়লাব হয়ে যায় শত সহ¯্র আমের স্তুপে। জাম, জামরুল, লিচু, কাঁঠালের মধু মাসের স্বাদও কৃষকের ছিনিয়ে নিয়েছে আম্পান। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ফল-ফসলের বাগান সব উপড়ে পড়া আর ভেঙে পড়া গাছের নিচে চাপা পড়ে গেছে। এলাকাজুড়ে বৈদ্যুতিক বিপর্যয়ে প্রায় অন্ধকারে মানুষের বসবাস, বিচ্ছিন্ন সব যোগাযোগ, বন্ধ সকল কাজকর্ম।
ভাঙা বুক নিয়ে এমনই হতহৃদয় অবস্থায় তবু, কিছু মানুষ অমিত শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় বাঁধভাঙা তুফানের মুখে, সর্বিশক্তি দিয়ে তারা রুখে দিতে চায় প্রবল ¯্রােতের গতিপথ। হয়তো তারা পারেনি ¯্রােতের মুখে বাঁধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে প্রবল পানির তোড়ে ভেসে গেছে সবে, কিন্তু ইতিহাস তাদের মনে রাখবে। ভুলে যাবে না এই ত্যাগ, এই প্রচেষ্টা, এই বীরত্বগাঁথা তাদের।
স্বেচ্ছাসেবী হয়ে এগিয়ে আসে হাজার হাজার আমজনতা। দিনে রোজা থেকেছে তাতে কী, রাতেও তারা নির্ঘুম সৈনিক, জীবনবাজি রেখে বাঁধ বেঁধেছে নিজেদের জীবন, সহায় সম্পদ, ঘরদোর, গবাদি পশু বাঁচাতে। সকাল না হতেই আবার সব পানির ¯্রােতে একাকার! তবুও দমেনা বীরের দল, হয়না নিরাশ এতটুকু, অভিযোগ নেই কারো, ক্ষোভও নেই কোনো প্রকৃতির নিষ্ঠুর এই খেলার পুতুল হয়ে! তাই যে প্রকৃতি ওদের ঘর ছাড়া করেছে, সাজানো জীবন-ঘর-সংসার সব ল-ভ- করে দিয়েছে, রুদ্ররূপে তা-ব চালিয়ে ওদের সব স্বপ্ন-সাধ-সম্ভাবনা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে, ভাসিয়ে নিয়ে গেছে হাঁটু পানি, কোমর পানি, বুক পানিতে, সে পানির অভ্যন্তরেই তারা নতুন স্বপ্নের বাঁধ নির্মাণে ব্যস্ততার ফাঁকে দাঁড়িয়ে গেছে নজীরবিহীন এক আত্মসমর্পণের নমুনায় প্রকৃতিরূপী ¯্রষ্টার সমীপে। এ এক অপূর্ব আত্মনিবেদন, অভুতপূর্ব মিরাজ মুমিনের, পৃথিবী জুড়ে যার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাবে না কেউ!
ওদের আত্মা, আত্মশক্তি তাই মরে না কোনোকালে। ওদের স্বপ্ন-সাধ-ইচ্ছা সম্ভাবনা তাই শত প্রতিকূলতার মাঝেও অমিত শক্তি নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায় বার বার। ঝড়-তুফান, সাইক্লোন-জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংসাবশেষের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে যুগে যুগে ওরা তাই সুখের আলপনা আঁকে, স্বপ্ন আর সম্ভাবনার জাল বোনে। এই সুখের আলপনা কখনও মুছতে পারে না তুফান, পারবেও না কোনোদিন! এই স্বপ্ন জাল কখনও ছিন্ন করতে পারে না ঝড়ের তান্ডব, পারবেও না কোনোদিন! লেখক: কবি ও সাহিত্যিক
The post নজিরবিহীন এক আত্মসমর্পণ! appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3eSqsXn
No comments:
Post a Comment