Monday, September 27, 2021

কলারোয়ায় ‘রঙিন মাছের কারিগর’ সাইফুল্লাহ এখন কোটিপতি! https://ift.tt/eA8V8J

নিজস্ব প্রতিনিধি: মানুষের কত রকম শখ আছে। কারো কৃষি কাজ, কারো পাখি পালন করতে ভালো লাগে, কারোর ফুল চাষ করতে ভালো লাগে, আবার কারো অ্যাকুরিয়ামে রঙিন মাছ চাষ করতে ভাল লাগে। কিন্তু কখনও কখনও এই সৌখিন বিষয়টি হয়ে ওঠে জীবন সংসারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক। এমন একজন সৌখিন মানুষ রয়েছে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার ব্রজবাকসা গ্রামের মৃত আব্দুল হাকিমের বড় ছেলে সাইফুল্লাহ গাজি। তিনি রঙিন মাছ চাষ করে পাল্টে নিয়েছে তার জীবন-জীবিকা। অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি তাকে দেশব্যাপী পরিচিতিও এনে দিয়েছে। এখন তাকে সবাই এক নামে চেনেন ‘রঙিন মাছের কারিগর’ হিসেবে।

তার হ্যাচারির পানিতে ভাসছে নানা রঙের মাছ। লাল, নীল, কমলা, কালো, বাদামি, হলুদ রঙের মাছের ছড়াছড়ি। গোল্ড ফিশ, কমেট, কই কার্ভ, ওরেন্টা গোল্ড, সিল্কি কই, মলি, গাপটি, অ্যাঞ্জেল প্রভৃতি বর্ণিল মাছ দেখলে চোখ জুড়িয়ে, মন ভরে যায়। কলারোয়ার এই তরুণ উদ্যোক্তা সাইফুল্লাহ গাজী রঙিন মাছের চাষ তার জীবনকে রাঙিয়ে দিয়েছে। সাইফুল্লাহ মাত্র ৬২০ টাকায় অ্যাকুরিয়াম মাছের চাষ শুরু করেন। আর সেই মাছ চাষ তাকে আজ বানিয়েছে কোটিপতি। তিনি জমি কিনে সেখানে গড়ে তুলেছেন ব্রজবাকসা এলাকার সেরা দালান কোটা। বাড়িটি বানাতে ১কোটির উপরে খরচা হয়েছে। এক সময় বিদেশ থেকে আমদানি করা অ্যাকুরিয়ার মাছ সৌখিন ব্যক্তিদের বাসা-বাড়িতে শোভা পেত। কিন্তু উদ্যোমী সাইফুল্লাহ’র চেষ্টায় দেশ থেকে উৎপাদিত মাছ এখন সৌখিনদের বাসা-বাড়িতে যাচ্ছে। বর্তমানে দেড় কোটি টাকার মূলধন খাটিয়ে ব্যবসা করছেন সাইফুল্লাহ গাজি। যিনি সাতক্ষীরার কলারোয়ার বজ্রবকসা গ্রামের বাসিন্দা। বর্তমানে ২০টি পুকুরে বিভিন্ন প্রকারের অ্যাকুরিয়ামের মাছ চাষ করছেন তিনি। বিশাল মূলধন খাটানোর পাশপাশি ৫০জন বেকারের কর্মসংস্থান করেছেন এই সাইফুল্লাহ গাজী। তার পুকুরে বাহারি রঙের মাছে সমারোহ দেখা গেছে। প্রতিদিন সকালে পাত্রে শব্দ করে মাছকে খাওয়ার দাওয়াত দেন সাইফুল্লাহ। শব্দ শুনে পুকুরের এক কিনারে জমা হয় সব রঙিন মাছ। এরপর খাবার ছিটিয়ে দিলেই নিমিষেই খাবার খেয়ে তৃপ্ত হয় মাছগুলো।

সাইফুল্লাহ ও তার স্ত্রী জেসমিন সুলতানার ডাক ও মাছেদের সাড়া দেওয়ার এক অপূর্ব দৃশ্য দেখে অবাক স্থানীয়রা। সফল উদ্যোক্তা সাইফুল্লাহ গাজী বলেন, আমার পিতা-মাতার ৭ ছেলে-মেয়ের মধ্যে আমি বড় ছেলে। পিতার সংসারে খুবই অভাব থাকার কারণে বেশী লেখাপড়া করতে পারেনি। একপর্যায়ে ১৯৯৭ সালে অভাবের তাড়নায় জেদের বশবতী হয়ে প্রতিবেশি দেশ ভারতে কাজে যাই। সেখানে টেক্সটাইল মিলে কাজ করার পাশাপাশি একটি গ্রামীণ এলাকায় যাই। সেখানে বেশ কয়েকটি পুকুরে নানা রঙের মাছ চাষ দেখতে পাই। এর পরে ২বছর ৭মাস পর ১৯৯৯সালে দেশে ফিরে এসে রঙিন মাসের চাষ নিয়ে বাড়িতে আলাপ- আলোচনা শুরু করি। কিন্তু প্রথমে আমার পিতাসহ বাড়ীতে কেউ সম্মতি দেয়নি। এরপর অভাবের সাথে লড়াই করে না পেরে ওই বছরেই আবারো বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টেসে কাজ শুরু করি। কিন্তু পর্যাপ্ত আয় না থাকায় সন্তুষ্টি মেলেনি। তখন ঢাকার মিরপুর-১৩ নম্বরের একটি দোকানে অ্যাকুরিয়াম দেখি। ভারত থেকে সৃষ্ট আকাক্সক্ষা আর মিরপুরের দোকান দেখে অ্যাকুরিয়াম মাছ চাষের প্রতি প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তবে আগ্রহ থাকলেও মূলধন ছিল না। মাসের বেতনের সব টাকা খরচ করে অবশিষ্ট ৬২০ টাকা ছিল। সেই টাকায় পরেশ নামের এক বন্ধুর নিকট থেকে ২০০৪ সালে কয়েকটি মাছ নিয়ে বাড়িতে রওনা হই। বাড়িতে অ্যাকুরিয়ামের মাছগুলোকে এনে মাটিতে রিং ¯øাব বসিয়ে পালন শুরু করি। এক সময় মাছগুলো ডিম দেয়। কিন্তু পুরুষ মাছের অভাবে ডিমগুলো থেকে বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছিল না। তার পরে পুরুষ যোগাড় করে বাচ্চা উৎপাদন শুরু করি। এভাবেই অ্যাকুরিয়াম মাছ চাষ শুরু করি। সাইফুল্লাহ গাজি আরো বলেন, প্রথমে ১০রকমের মাছ আনলেও ৯ধরনের মাছকেই বাঁচানো যেত না। তবে ৫ বছরের অক্লান্ত সাধনায় ৯ধরনের মাছ প্রস্তুত করতে সক্ষম হই। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৬২০ টাকার মূলধন এখন দেড় কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ২০টি পুকুর এবং ৮৮টি হাউজে ২৬ প্রজাতির মাছ চাষ করা অ্যাকুরিয়ামের পেছনে এখন ৫০জন শ্রমিক কাজ করছেন। আমার চাষ করা অ্যাকুরিয়াম মাছ ঢাকার কাঁটাবন, খুলনা ও রাজশাহীসহ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশ রপ্তানি করার ইচ্ছা রয়েছে তার। এতে নিজে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি দেশ লাভবান হবে। তবে রঙিন মাছ চাষ এখন কেবল সাতক্ষীরা অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ না। ফেনী, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুরেও বাণিজ্যিকভাবে রঙিন মাছের চাষ হচ্ছে। এছাড়া অনেকে বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে বাসার ছাদেও রঙিন মাছের চাষ করে তা বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করছেন। বাংলাদেশে অ্যাকুরিয়ামে রঙিন মাছ ব্যাপক জনপ্রিয়। শৌখিন মানুষ বাসা-বাড়িতে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য অ্যাকুরিয়াম রাখেন। শপিংমল, হোটেল, রেস্টুরেন্ট এমনকি দোকানেও এখন অ্যাকুরিয়ামের ব্যবহার বেড়েছে। সাইফুল্লাহ গাজি জানান, ২০১৪ সালে পুকুর লিজ নিয়ে বেশি করে রঙিন মাছ চাষ শুরু করি। বিশেষ পদ্ধতিতে উৎপাদন করা মিল্কি কই কার্প, কিচিং গোরামি, কই কার্প, কমিটিসহ ২৫ থেকে ২৬ প্রজাতির রঙিন মাছ উৎপাদন হচ্ছে। এই মাছ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হচ্ছে। সাইফুল্লাহ গাজি আরো বলেন, এক সময় সব মাছ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। কিন্তু এখন আমার হ্যাচারিতে উৎপাদন করা মাছ সাতক্ষীরার চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। রঙিন মাছের জন্য দেশের সবচেয়ে বড় বাজার রাজধানীর কাঁটাবনের ব্যবসায়ীদের অনেকেই আমার কাছ থেকে রঙিন মাছ নিয়ে যান। এ ছাড়া খুলনার মাছ ব্যবসায়ী বকুল, রবিন, যশোরের নয়ন, দীপক, বাবু অসীম, সাতক্ষীরার রুহুল আমিনসহ দেশের অনেক ব্যবসায়ী আমার নিকট থেকে রঙিন মাছ নিয়ে যান। বিশেষ পদ্ধতিতে মাছের রঙ পরিবর্তনও করার কথা উল্লেখ করে সাইফুল্লাহ আরো বলেন, রঙ বদলিয়ে সিল্কি নামের একটি মাছ তৈরি করছি। অনেকটা জরির মতোই দেখতে। সে জন্যই নাম দিয়েছি সিল্কি। রঙ পরিবর্তন করা এ মাছের চাহিদাও রয়েছে। তবে প্রযুক্তির অভাবে পরিপূর্ণ চাষ করতে পারছি না। সরকারের তরফ থেকে ওই সমস্ত প্রযুক্তি পেলে আমি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানী করতে পারতাম। কারণ বিদেশে এ রঙিন মাছের চাহিদা ব্যাপক।
সাইফুল্লাহ বলেন, বর্তমানে ২০টি পুকুর লিজ নিয়ে রঙিন মাছ চাষ করছি। প্রতিটি মাছ সর্বনিম্ন ১০ টাকা আর সর্বোচ্চ ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এই ব্যবসাকে ঘিরেই বড় ছেলের নামে ‘রেজা অ্যাকুরিয়াম ফিস’ নামের একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান শুরু করেছি। আমি এক সময় অন্যের শ্রমিক ছিলাম। এখন আমার অধীনে ৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। ছোট ছেলে রিফাত হাফিজিয়া মাদ্রাসার ছাত্র। সাইফুল্লাহ’র স্ত্রী জেসমিন সুলতানা বললেন, ২০০৪ সালে মাত্র ছয় জোড়া পোনা মাছ দিয়ে আমরা চাষ শুরু করি। সেই থেকে স্বামীর সঙ্গে মাছ চাষে সহযোগিতা করে আসছি। ব্যবসা বাড়াতে তখন হাতে টাকা ছিল না। পরে ঢাকা আহছানিয়া মিশন থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে মাছ চাষ স¤প্রসারণ শুরু করি।

এখন আমার স্বামী একজন সফল উদ্যোক্তা। আমার স্বামীর মতো সারা দেশে রঙিন মাছ চাষের প্রায় ২ হাজার ৬০০ উদ্যোক্তা রয়েছে। বর্তমানে আমরা দুই ছেলেকে নিয়ে আল্লাহ’র ইচ্ছায় খুবই ভাল আছি। একই গ্রামের আব্দুল মাজেদ, বাবু, সেন্টু ও ঘেনা নামের রঙিন মাছ ব্যবসায়ী দৈনিক সমকালকে বলেন, পুকুরের পরিবেশ একটু ভালো রাখলে, চুন ব্যবহার করলে, স্বচ্ছ পানি থাকলে এবং জীবাণুমুক্ত পানি হলে সেখানে রঙিন মাছ উৎপাদন করা যায়। কিচিং গোরামি, মিল্কি কই কার্প, কই কার্প ও কমিটিসহ ২৫ থেকে ২৬ প্রজাতির রঙিন মাছ উৎপাদন হয়। প্রতিটি মাছের দাম সর্বনিন্ম ১০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত। তারা বলেন, সহজ শর্তে ব্যাংক থেকে ঋণ পেলে এ ব্যবসা আরো স¤প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে একটু সহযোগিতা পেলে আমাদের ব্যাপকভাবে চাষ করে রঙিন মাছ বিদেশে আরো রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। কলারোয়া বাজারের আজমলসহ অনেক ব্যবসায়ী বলেন, অ্যাকুরিয়াম আগে উচ্চবিত্তদের বাড়িতে বেশি দেখা যেত। সময় পাল্টেছে, এখন মধ্যবিত্ত এমনকি নিন্মবিত্তরাও শখের বশে বাসা-বাড়িতে অ্যাকুরিয়াম রাখেন। দিন যত যাচ্ছে এর ব্যবহারও ততই বাড়ছে। ফলে ধীরে ধীরে সেই বিদেশ নির্ভরতা কমে এসেছে। যার ফলে দেশের টাকা দেশেই থাকছে। তারা আরো জানান, এখন তার অনেক শিক্ষার্থী রঙিন মাছ উৎপাদন করে তাদের কাছে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করে। এতে করে শিক্ষার্থীরাও নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখছে। বিদেশ থেকে রঙিন মাছ আমদানিকারক পপুলার অ্যাকুরিয়াম সেন্টারের অংশীদার শহীদুল ইসলাম জানান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর থেকে রঙিন মাছ আমদানি করা হয়। আগে মাসে ১০০ রঙিন মাছের কার্টন আমদানি করতেন। এখন ৩০ থেকে ৪০ কার্টন মাছ আমদানি করছেন। কারণ দেশেই এখন রঙিন মাছ উৎপাদন হচ্ছে। দামও তুলনামূলক অনেক কম। তিনি আরো বলেন, বিদেশের এক জোড়া গোল্ড ফিশের দাম পড়ে দুই হাজার টাকা। চিংড়ির জোড়া ৬০০ টাকা। এর বেশি দামও আছে। তা ছাড়া ওই সব রঙিন মাছের খাবারের দামও বেশি। তাই মানুষ এখন দেশে উৎপাদিত রঙিন মাছ বেশি কিনছে। এ বিষয়ে কলারোয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রবীন্দ্রনাথ এই উদ্যোগকে ভালো উল্লেখ করে বলেন, এর চাষ প্রণালি অন্য মাছের মতো। শুধু আলাদা কিছু খাবার দিতে হয়। তবে এই রঙিন মাছে চাহিদা থাকায় খামারিরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। আমরাও চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।

The post কলারোয়ায় ‘রঙিন মাছের কারিগর’ সাইফুল্লাহ এখন কোটিপতি! appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/2Wfbk2m

No comments:

Post a Comment