Wednesday, September 29, 2021

সাতক্ষীরার ৫লক্ষাধিক শ্রমিকের নেই নিয়োগপত্র দেওয়া হয়না ক্ষতিপূরণ, মানা হয়না শ্রম আইন https://ift.tt/eA8V8J

এসএম শহীদুল ইসলাম: সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঝাউডাঙ্গার একটি তেল কলকারখানার শ্রমিক এনায়েত উল্যাহ্ (ছদ্মনাম)। তিনি জানান, কলকারখানাটিতে ৮জন শ্রমিক কাজ করেন। তবে কর্মক্ষেত্রে তাদের নেই কোন পরিচয়পত্র, নেই নিয়োগপত্র। তারা পাচ্ছে না শ্রম অধিকার। তারা আছেন ঝুঁকিতে। তবুও জীবন জীবিকার তাগিদে শ্রম বিকাতে হচ্ছে। এ অবস্থা শুধু এনায়েত উল্যাহর একার নয়। এ অবস্থা জেলার বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁ, লেদ, ওয়েল্ডিং, ডেকোরেটর, মোটরগ্যারেজ, গৃহনির্মাণ, ইটেরভাটা, ধান-চাল চাতাল, চাল মিল, করাত কল, তেল মিল, শপিং সেন্টার, বিপনী-বিতান, পরিবহন, বেসরকারি ক্লিনিকসহ বিভিন্ন কল-কারখানার ৫ লক্ষাধিক শ্রমিকের। ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে জড়িয়ে পড়া এসব শ্রমিকরা হাড় ভাঙা পরিশ্রম করেও পায় না তাদের ন্যায্য অধিকার। শারিরীক নির্যাতন, গালিগালাজ তো আছেই। জীবন ও জীবিকার তাগিদে নামমাত্র মজুরিতে কাজ করতে হয় তাদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাতক্ষীরা জেলা সদরের ব্রহ্মরাজপুর এলাকার কয়েকজন ধান-চালের চাতাল শ্রমিক জানান, চাতালে কাজ করেই তাদের সংসার নির্বাহ হয়। বছরের ৯ মাসই কাটাতে হয় চাতালে। অথচ মিল মালিকদের পক্ষ তাদের কোন নিয়োগপত্র কিম্বা পরিচয়পত্র দেওয়া হয়না। যে কারণে তারা জানেই না সরকারিভাবে তাদের মজুরি কত। তারা জানেই না তাদের অধিকার কতটুকু। তারা জানান, ধান সিদ্ধ করার বয়লার ব্লাস্ট হলে মৃত্যু নিশ্চিত। তারপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। রাইচ মিলের ফিতায় হাত লেগে আহত হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু তাদের চিকিৎসা খরচ নিজেদেরই করতে হয়েছে। কোন মালিক তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। একই কথা বলেন স’ মিলের কয়েকজন কর্মচারী। তারাও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। তাদের নেই নিয়োগপত্র।

সিরাজুল ইসলাম নামের একজন বাস চালক জানান, তিনি ৩০ বছর ধরে সাতক্ষীরা-আশাশুনি সড়কে বাসের ড্রাইভার হিসেবে কাজ করছেন। বাস মালিকের অধীনে তিনি চাকরি করলেও জীবনে নিয়োগপত্র কী জিনিস তা চোখে দেখেননি। তবে শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে তার পরিচয়পত্র আছে। আছে লাইসেন্সও। মহামারি করোনাকালে বাস বন্ধ থাকায় মালিকের পক্ষ থেকে কোন সাহায্য-সহযোগিতা পাননি তিনি। এক বছর ছয় মাস তিনি বেকার। করোনাকালীন সময়ে দুর্বিসহ জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। ড্রাইভারের চাকরি ছেড়ে তিনি এখন চা-পান বিক্রি করে সংসার নির্বাহ করছেন। সিরাজুল ইসলাম বলেন, এ অবস্থা শুধু তার একার নয়, তার মতো শতশত শ্রমিক মালিকের পক্ষ থেকে কোন নিয়োগপত্র পায় না। পায় না কোন বিপদকালীন সুবিধা। অনেকেই পেশা বদল করে স্বাধীন পেশায় চলে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

এদিকে পরিবহন ও মিল মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শ্রমিকরা নিয়োগপত্র চায় না। হয়তো অনেকেই জানেই না। আবার অনেকে নিতে চায় না। নিয়োগপত্র নিতে না চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে মালিকরা বলেন, শ্রমিকরা মনে করেন নিযোগপত্র নিলে তাদের শর্ত মানতে হবে। অন্যত্র কাজ করা যাবে না। ইচ্ছেমত যাওয়া-আসা করা যাবে না। মালিকের নির্দেশ মানতে হবে ইত্যাদি। তাই তারা নিয়োগপত্র না নিয়ে চুক্তিভিত্তিক কাজ করতে আগ্রহী। এদিকে শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী নিয়োগদাতা চাইলে মহামারির সময়ে কাজ বন্ধ করে দিতে পারেন এবং ব্যয় সংকোচনের উদ্দেশ্যে কর্মীদের অব্যাহতি দিতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে কর্মীদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৫০০ থেকে আড়াই হাজার শ্রমিকের কারখানাকে মধ্যম এবং আড়াই হাজারের বেশি শ্রমিকের কারখানাকে বড় কারখানা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, মধ্যম আকারের কারখানাগুলোর মাঝে ৮৪ শতাংশ এবং সব বড় কারখানাগুলোতে শুধু শ্রমিকদের মাসিক বেতন দেওয়া হয়। তাদের বকেয়াগুলো এবং আইন অনুযায়ী কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না। সমীক্ষাটি বলছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ১৪ শতাংশ শ্রমিক। সিপিডির গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘প্রায় ষাট শতাংশ কারখানা তাদের শ্রমিক সংকোচন করেছে। বাকি কারখানাগুলো শ্রমিক ছাঁটাই করেছে, অথবা তাদের শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ায়নি। ২০২০ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরের মাঝামাঝিতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ৬১০টি ছোট থেকে মাঝারি কারখানার ওপর সমীক্ষা চালিয়ে জানতে পারে, ৯৬ দশমিক চার শতাংশ কারখানায় শ্রমিক সংকোচনের সময় ক্ষতিপূরণের আইনগুলো ঠিক মতো মানা হয় না।

এদিকে সম্প্রতি এ্যাকশন এইডের সহযোগিতায় হেড’র বাস্তবায়নে এবং দৈনিক পত্রদূতের আয়োজনে মিডিয়া ক্যাফের আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, বেশিরভাগ কারখানা কর্মীদের ছাঁটাই ও চাকরিচ্যুত করার নিয়মগুলো সঠিকভাবে মানা হয় না। ডিআইএফই-এর দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী কোনো কারখানা যদি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ভর্তুকিসহ ঋণ সুবিধা নিয়ে থাকে, তাহলে তারা কর্মী সংকোচন বা ছাঁটাই করতে পারবে না। তবে বেশিরভাগ কারখানা এই নির্দেশটি মানছে না। ২০২০ সালে কয়েক হাজার শ্রমিক বকেয়া বেতন ও সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শ্রমিকরা বেতন এবং ওভারটাইম ও অন্যান্য প্রাপ্য টাকার দাবিও জানান। গত বছর মে মাসে জেলায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের প্রণোদনার অর্থ প্রদান ও ত্রাণের দাবিতে মানববন্ধন করেছিল কয়েকটি সংগঠন। মানববন্ধনে বলা হয়েছিল, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, রং পালিশ শ্রমিক, ইলেক্ট্রিশিয়ান, রেস্তোরাঁ, বোর্ড ফার্নিচার, টাইলস মোজাইক, স্বর্ণ ছাই শ্রমিক, দর্জি, রিকসা-ভ্যান, সংবাদপত্র বিক্রেতা, ইটভাটা, মাছের কারখানা, কাঁকড়া ডিপো, ওয়েলডিং শ্রমিকসহ সাতক্ষীরা শহরের প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে তারা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে। জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি এড. ফাহিমুল হক কিসলুর নেতৃত্বে শ্রমিক নেতৃৃবৃন্দ সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. বদিউজ্জামানের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপিও পেশ করেছিলেন।

এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে জেলায় মোট জনসংখ্যা ২৩ লক্ষ ১৭ হাজার ১৫৮ জন। নিয়মানুযায়ী দেশে প্রতি বছরে জনসংখ্যা ৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। সেই হিসাব মতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে সাতক্ষীরা জেলায় লোক সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ লক্ষ ৩৩ হাজার ১৫জন। (জনসংখ্যা সুত্র: পকেট বুক-২০১৬)।

খাদ্য পরিস্থিতি ২০১৮-১৯ অনুযায়ী সাতক্ষীরা জেলায় ১৭ লক্ষ ৯২ হাজার ৭৫৩ জন কৃষির সাথে জড়িত। তাদের পরিবার সংখ্যা ৩ লক্ষ ৫৮ হাজার ৫৫০টি। শ্রমিক ও মৎস্যজীবীসহ অন্যান্য পেশায় জড়িত রয়েছে ৫ লক্ষ ২৪ হাজার ৪০৫ জন। যাদের পরিবারের সংখ্যা দাঁড়ায় এক লক্ষ ৪ হাজার ৮৮১। সর্বমোট সাতক্ষীরা জেলায় ৪ লক্ষ ৬৩ হাজার ৪৩১টি পরিবার রয়েছে। তবে একটি পরিবারে ৪ জন সদস্য ধরলে পরিবারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ লক্ষ ৭৯ হাজার ২৮৯টি। জেলা কৃষি বিভাগের হিসাব মতে জেলায় ৩ লক্ষ ৮১ হাজার ৭৩০ হেক্টর জমি আছে। এসব জমিতে ৩ লক্ষ ৫৮ হাজার ৫৫০টি পরিবার কৃষি কাজ করে থাকে। এরমধ্যে ভূমিহীন চাষীর পরিবার ৬৭ হাজার ২৩০টি, প্রান্তিক চাষীর পরিবার এক লক্ষ ৩১ হাজার ৩৭টি, ক্ষুদ্র চাষীর পরিবার রয়েছে এক লক্ষ ৯৫৭টি, মাঝারি চাষীর পরিবার  ৪৪ হাজার ৮৪২টি এবং বড় চাষীর পরিবার রয়েছে ১৪ হাজার ৪৮৪টি।

 

 

 

 

 

The post সাতক্ষীরার ৫লক্ষাধিক শ্রমিকের নেই নিয়োগপত্র দেওয়া হয়না ক্ষতিপূরণ, মানা হয়না শ্রম আইন appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3ilojrb

No comments:

Post a Comment