Thursday, May 27, 2021

জলোচ্ছ্বাসে সর্বনাশ: এক জোয়ারে লন্ডভন্ড উপকূলীয় জনপদ https://ift.tt/eA8V8J

সামিউল মনির, শ্যামনগর: ঘুর্ণিঝড়ের তান্ডব থেকে রেহাই মিললেও ‘ইয়াস’ এর প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে শ্যামনগর উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বুধবার দুপুরের একমাত্র জোয়ারের তোড়েই লন্ডভন্ড হয়ে গেছে উপকূলীয় এ জনপদের বিস্তীর্ণ এলাকা।

বসতবাড়ি থেকে শুরু করে চলাচলের রাস্তা, মিষ্টি পানির পুকুর আর ফসলী জমিসহ হাজার হাজার বিঘা জমির চিংড়ী ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার আটটি ইউনিয়নকে ঘিরে থাকা একশ’ নব্বই কিলোমিটার উপকূল রক্ষা বাঁধের সামান্য অংশ নদীতে বিলীন হলেও সিংহভাগ জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়েছে।
উল্লেখ্য, বুধবার বেলা ১১টার দিকে সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলাকে ঘিরে থাকা নদীসমুহে সৃষ্ট জোয়ারের পানি ৪.৩৭ মিটার (পিডব্লিউড) লেভেল পর্যন্ত উঠে। অথচ প্রায় ষাট বছর পূর্বে এই এলাকায় নির্মিত উপকূল রক্ষা বাঁধের লেভেল রাখা হয়েছিল ৪.৩০ মিটার। মূলত ডিজাইন লেভেল অতিক্রম করার কারণে একযোগে গোটা শ্যামনগরকে ঘিরে থাকা উপকূল রক্ষা বাঁধের প্রায় সবগুলো পয়েন্ট দিয়ে একযোগে জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় বিশালকারের এই ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীসহ স্থানীয়রা জানায়, বুধবার সকাল থেকে উপকূলবর্তী এ অংশে হালকা ঝড়ো বাতাস ও মাঝেমধ্যে মৃদু বৃষ্টি থাকলেও ‘ইয়াস’ তান্ডবের বিন্দুমাত্র আঁচ করা যায়নি। তবে আগের দিনের ধারাবাহিকতায় উপকূলবর্তী শ্যামনগর উপজেলাকে ঘিরে থাকা নদ-নদীসমুহে সকাল আটটার পরপরই অস্বাভাবিক জোয়ার লক্ষ্য করা যায়। ভরা কটালের কারণে বেলা দশটা নাগাদ এসব নদীর পানি উপকূল রক্ষা বাঁধ উপচে লোকালয়ে প্রবেশের সম্ভবনা তৈরী হয়।

স্থানীয়রা জানান, লোকালয়ে পানির প্রবেশ ঠেকাতে খুব ভোর থেকে শতশত গ্রামবাসী একাধিক দলে বিভক্ত হয় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ শুরু করে। এসময় তারা গাবুরাসহ পদ্মপুকুর, কৈখালী, বুড়িগোয়ালীনি, মুন্সিগঞ্জ, কাশিমাড়ী ইউনিয়নগুলোকে স্পর্শ করা বাঁধের ঝুঁকপুর্ন অংশে মাটি ও বালির বস্তা দিয়ে বাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালায়।
পাখিমারা গ্রামের শাহিন বিল্লাহ, চকবারার আব্দুস সালাম ও চুনকুড়ি এলাকার আব্দুস সামাদসহ স্থানীয়রা জানায়, বেলা এগারটার দিকে প্রবল জোয়ারের চাপে স্থানীয়দের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। আকস্মিকভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠা পাশর্^স্থ খোলপেটুয়া, কালিন্দি, চুনকুড়ি, কপোতাক্ষ, আড়পাঙ্গাশিয়া ও মালঞ্চসহ অপরাপর নদীর পানি ‘হুহু’ করে বাঁধ উপচে যেতে শুরু করে।
মুহুর্তের মধ্যে একযোগে উপজেলাকে ঘিরে থাকা ৫, ১৫ ও ৭ নং পোল্ডারের উপকূল রক্ষা বাঁধের তুলনামুলক নিছু অংশ দিয়ে তীব্র বেগে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকে সংলগ্ন এলাকাকে ভাসিয়ে দেয়। মাত্র দুই ঘন্টার ব্যবধানে দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার নাপিতখালী, চাঁদনীমুখা, জেলেখালী, গাগড়ামারী, পদ্মপুকুরের পাতাখালী, ঝাপা, মুন্সিগঞ্জের সিংহড়তলী, চুনকুড়ি, হুলো, কৈখালীর জয়াখালী, নীদয়া, কাঠামারী, বুড়িগোয়ালীনির দাতিনাখালী, দুর্গাবাটিসসহ অন্তত ৭০টি গ্রাম জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়। দ্বিতীয় দিনে যে সংখ্যা আরও ১৫টি বেড়ে যায়।
এসময় পানিতে ভাসতে থাকা গাবুরা, বুড়িগায়ালীনি, কৈখালী ও পদ্মপুকুরসহ আরও পাঁচটি ইউনিয়নের লক্ষাধিক একর জমির চিংড়ি ঘের, ফসলী জমিসহ মিষ্টি পানির পুকুর পানিতে তলিয়ে যায়। পানিবন্দী হয়ে পড়ে এসব এলাকার অন্তত ৬০ হাজার মানুষ। পানিতে গোটা এলাকা নিমজ্জিত হওয়ার পর দুপুরের পর ভাটার সুযোগে বাড়িঘর ছেড়ে সাইক্লোন শেল্টারসমুহে আশ্রয় নেয় প্রায় আট চল্লিশ হাজার মানুষ।
ইয়ুথ নেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস এর সাতক্ষীরা জেলা সমন্বয়ক শাহিন বিল্লাহ বলেন, ইয়াস আগমনের সতর্কতা আরও অন্তত সাতদিন আগেই জারি করা হয়। গত সাতদিনের প্রস্তুতি সত্ত্বেও উপকূলের বিস্তীর্ন অংশে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা গত কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে সর্বোচ্চ। তিনি জানান সব ধরনের সতর্কতা এবং প্রস্তুতির পরও বুধবার যে ধংসযজ্ঞ চলেছে তা কেবলমাত্র উপকূল রক্ষা বাঁধের জন্য। প্রায় ছয় দশক আগে নির্মিত বাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টিকে দীর্ঘদিনেও আমলে না নেয়ার অনিবার্য পরিনতি এবারের ক্ষয়ক্ষতি।
অনেক স্থানে বেড়িবাঁধের কোন অস্তিত্ত্ব নেই-উল্লেখ করে পাতাখালীর তরুণ জলবায়ু এক্টিভিস্ট তরিকুল ইসলাম জানান, আইলার আঘাতের সময় শ্যামনগরের প্রায় ১১৭ কিলোমিটার বাঁধ নদীতে বিলীন হয়। পরবর্তীতে উল্লেখযোগ্য অংশে রিংবাঁধ নির্মানসহ ভাঙন কবলিত বাঁধ মেরামত করা হয়। কিন্তু এসব অংশে যেমন বাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়নি। তেমনী পাতাখালসিহ অনেক অংশে নদীতে ধসে যাওয়া বাঁধের উপর ন্যুনতম মাটি দেয়া হয়নি। যার প্রেক্ষিতে বার বছরের ব্যবধানে একটু বড় ধরনের জোয়ার হতেই এসব এলাকার মাইলের পর মাইল রক্ষা বাঁধের উপর দিয়ে পানি দিব্যি লোকালয়ে ঢুকেছে।
সাবেক অধ্যক্ষ আশেক-ই এলাহী বলেন, বিগত দিনগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আশংকাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বিপরীতে ষাট এর দশকে নির্মিত এসব বাঁধ নতুনভাবে ডিজাইন করে তৈরীর প্রয়োজন সত্ত্বেও তা করা হয়নি। উপরোন্ত বাঁধ মেরামত কার্যক্রমে স্থানীয় সরকার বিভাগকে সম্পৃক্ত না করায় কাজের গুনগত মান কখনই রক্ষা হয় না। এমতাবস্তায় নদীতে তীব্র জোয়ারের সৃষ্টি হতেই গোটা জনপদজুড়ে ভুতুড়ে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
ভাঙন কবলিত অংশে বসবাসরত স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে তীব্রতা না থাকায় ঝড় কিংবা বৃষ্টিতে তাদের ন্যুনতম ক্ষতি হয়নি। বরং ভরা কটালের সুযোগে নদীসমুহে অতি জোয়ারের কারনে উপকূল রক্ষা বাঁধ উপচে গ্রামের পর গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। ঝড় বা বৃষ্টির কারণে কোন মানুষ পুর্ব থেকে প্রস্তুতকৃত ১০৩টি সাইক্লোন শেল্টারে না গেলেও জলোচ্ছ্বাসের পর বুধবার দুপুরের পর প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সেখানে আশ্রয় নেয়।
উল্লেখ্য শ্যামনগর উপজেলায় মোট ১২টি ইউনিয়ন থাকলেও বুধবারের জলোচ্ছাসে তিনটি সম্পূর্ণভাবে এবং অপর নয়টি ইউনিয়ন আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে বৃহস্পতিবার দুপুরের পর উপজেলঅর ১২টি ইউনিয়নের সবগুলো অংশে জোয়ারের পানি পৌছে যায়। প্রশাসন সুত্র জানায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ দুর্গত হয়ে পড়লেও বিধ্বস্থ হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি।
জোয়ারের পানি প্রবেশ করে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত করে বসত ঘরবাড়ি, চিংড়ি ঘেরসমুহ প্লাবিত করলেও নেমে যাওয়ার সময় অসংখ্য কাঁচা পাকা রাস্তা ধসিয়ে দিয়ে গেছে। এসব এলাকার অসংখ্য গাছ-গাছালি উপড়ে পড়লেও কয়েক হাজার মিষ্টি পানির পুকুর লবণ পানিতে ডুবে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে শ্যামনগরকে ঘিরে থাকা উপকূল রক্ষা বাঁধের মাত্র ২০৫ মিটার এলাকা ভেঙেছে। তবে ১৯০ কিলোমিটার বাঁধের শতাধিক অংশ উপচে জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। এধরনের প্লাবন ঠেকাতে নুতন ডিজাইনে বাঁধ নির্মাণের অত্যাবশ্যক বলেও পাউবো সূত্রের দাবি।

 

The post জলোচ্ছ্বাসে সর্বনাশ: এক জোয়ারে লন্ডভন্ড উপকূলীয় জনপদ appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3vmXzep

No comments:

Post a Comment