Tuesday, May 25, 2021

করোনাকালে অটিজম ও বিশেষ শিশুর যত্নে করণীয় https://ift.tt/eA8V8J

ডা. জাকির

অটিজম সম্পর্কে বাংলাদেশে সাধারণ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গী অনেকাংশে নেতিবাচক। অনেকে বিষয়টি সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ বলেও মনে করে। অটিজম শব্দটি গ্রীক শব্দ ‘অটোস’ থেকে এসেছে। এর অর্থ স্বয়ং বা স্বীয় বা নিজ। আর ইংরেজি অটিজম এর বাংলা অর্থ আত্মসংবৃতি বা মানসিক রোগবিশেষ। এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা অস্বাভাবিকভাবে নিজেদের গুটিয়ে রাখে। এজন্য এটিকে অটিজম নামকরণ করা হয়েছে।

অনেকেই অটিজমকে সিজোফ্রেনিয়া বলে ভুল করেন। ১৯৪৩ সালে আমেরিকার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ লিও ক্যানার সর্বপ্রথম মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে রোগটি সনাক্ত করেন এবং অটিজম শব্দটি ব্যবহার করেন।

দ্য আমেরিকান হেরিটেজ ডিকশনারি অব দ্য ইংলিশ ল্যাগুয়েজ এর সংজ্ঞা অনুযায়ী অটিজম হলো শিশুর বিকাশজনিত অসমর্থতা, যার বৈশিষ্ট্য হলো সামাজিক মিথস্ক্রিয়া ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রবল ঘাটতি এবং ক্রিয়াকলাপ ও মনোযোগের চরম সীমাবদ্ধতা এবং  নিদিষ্ট কিছু আচরণের পুনরাবৃত্তি। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ, সামাজিক আচরণ, সামাজিক কল্পনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেশ সমস্যা লক্ষণীয়।

মূলত অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্ন শিশুর বয়স বাড়ার সাথে সাথে সামাজিক যোগাযোগ, ভাববিনিময় ও আচরণগত সমস্যা দেখা যায়। এসকল কারণে অভিভাবকগণ তাদেরকে সুস্থ শিশু থেকে আলাদা করে ফেলে এবং অজ্ঞতার কারণে এ সমস্যাকে প্রাকৃতিক অভিশাপ বলে শিশুকে সমাজ থেকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতাও দেখা যায়।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় সবদেশেই এই কোবিড-১৯ ছড়িয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাস বড়োদের পাশাপাশি শিশুদের মধ্যেও সংক্রামিত হচ্ছে এবং তা শিশুদের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে। করোনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থেকে দূরে রাখার জন্য স্বাভাবিক শিশুদের পাশাপাশি বিশেষ শিশুদেরও একটি রুটিন করুন। তাদের খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা, ঘুম ও শিক্ষাদীক্ষা একটি নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী চলতে অভ্যস্ত করা যেতে পারে। এ সময় বিশেষ শিশুরা বাড়িতে তাদের পূর্বের স্বাভাবিক খাবার খাবে।

তবে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও ডাল প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি খাবে। তাতে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। সবুজ শাক-সবজি-ফলমূল বেশি খাবে এবং তাদের ভিটামিনস ও মিনারেলযুক্ত খাবার বেশি খেলে তাদের ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে। প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে এ সময়। এ ছাড়াও, করোনাভাইরাস নাক ও মুখ দিয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং প্রথম ৩-৫ দিন তারা মানুষের গলায় সংক্রমিত হয়। এ জন্য দিনে ৩-৫ বার গরম পানি লবণ দিয়ে/লেবু-চা এ সময় বিশেষ শিশুর করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে।

করোনাকালীন এই বিশেষ শিশুদের মধ্যে মানসিকভাবে এক ধরনের বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্নতা কাজ করবে। কারণ তারা অন্যদের সঙ্গে খেলতে পারছে না। তাদের ভাবগুলোর আদান-প্রদান করতে পারছে না। যদিও তাদের ভাবের বহিঃপ্রকাশটা অন্যদের মতো নয়, ভাববিনিময় অন্য শিশুদের তুলনায় আলাদা। তাদেরকে সময় দিন এবং বাড়ির ছোট ছোট কাজে নিয়োজিত রাখুন। বাসায় সম্ভব হলে পাজল দিয়ে খেলা, বাবল ফুলানো খেলা, টুকি খেলা, পুতুল খেলা, চা বানানো খেলা ইত্যাদি খেলাতে নিয়োজিত রাখা যেতে পারে। আর এ সমস্ত খেলাতে পিতা-মাতা শিশুর সঙ্গে খেলতে পারেন এবং এতে করে শিশুর খেলা আরও আনন্দময় হয়ে ওঠে।

যে সমস্ত বিশেষ শিশু নিয়মিত স্কুলে যেত, তাদের হঠাৎই স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিশুর আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে। বিশেষ শিশুরা নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে থাকতে চায় এবং রুটিন মেনে চলতে চায়। তাই এ সময় শিশুর জন্য বাসায় স্কুল সময়ে একটি সেশনের আয়োজন করা যেতে পারে, সেটি হতে পারে সকালে ৯টা-১০টা বা ১০টা-১১টায়। যেখানে স্কুলের সঙ্গে মিল রেখে শিশুকে বয়স অনুযায়ী ছবি আঁকা শিখান, ছড়া শিখান, গল্প বলুন, ধর্মীয় বিধিবিধান শিখান, গান বা মিউজিক শিখান। এতে শিশু তার বিভিন্ন শিক্ষায় পারদর্শী হবে এবং তার সময়গুলো খুব ভালো কাটবে। স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে এ সময় নিয়মিত পড়াশোনার ব্যাপারে যোগাযোগ করা উচিত প্রত্যেক অভিভাবকদের।

করোনার এ সময়ে শিশুরও মানসিক উদ্বিগ্নতা ও উৎকণ্ঠা থাকে ফলে রাতের ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে। শিশুকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শোয়ানোর অভ্যাস করুন। মোবাইল ও অন্যান্য ডিভাইস তার রাতের ঘুমের বাধার কারণ হয়ে উঠতে পারে। সে দিকে খেয়াল করুন প্রয়োজন হলে তার স্বাভাবিক ঘুমের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে মেলাটনিন জাতীয় ওষুধ ১/২ ট্যাবলেট খাওয়াতে পারেন।

এ সময়ে বিশেষ শিশুর আচরণের উপর মনোযোগ দিন। শিশুর হঠাৎ আচরণের পরিবর্তন দেখা গেলে, হঠাৎ অতিমাত্রায় চঞ্চলতা দেখা দিলে (হাইপার একটিভিটি) তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তবে খেয়াল রাখুন এ সময় শিশু যেন অতিমাত্রায় ডিভাইস নির্ভর না হয়ে পড়ে। প্রয়োজন হলে খোলা মাঠে বা ছাদে নেয়া যেতে পারে আর যদি সম্ভব না হয় তাহলে শিশুকে দিনের বেলায় ঘরের বারান্দাতে অথবা জানালার পাশে বসতে উৎসাহিত করতে হবে।

বিশেষ শিশুদের করোনার উপসর্গ অন্য শিশুদের মতোই। যেমন: জ্বর, হাঁচি, কাশি, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। উপসর্গগুলো অন্য শিশুদের মতো হলেও তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং তারা নিজেদের পরিষ্কার-পরিছন্নতা নিজেরা রাখতে পারে না। (অন্য শিশুদের তুলনায়)।

হালকা ঠাণ্ডা, কাশি, জ্বরের জন্য নাপা বা প্যারাসিটামল এবং এন্টি হিসটামিন জাতীয় ওষুধ (Fexofenadin) খাওয়ানো যেতে পারে এবং জ্বরের জন্য গা স্পঞ্জিং করতে হবে। জ্বর যদি না কমে এবং রোগ বাড়তে থাকে তাহলে বিশেষজ্ঞ শিশু চিকিৎসক বা হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে। তবে শিশুদের হাইপারএকটিভিটি ও অন্যান্য এর জন্য নির্ধারিত ওষুধ বন্ধ করার প্রয়োজন নেই।

শিশু বাইরে গেলে মাস্ক পরাবেন, দিনে ৩/৪বার সাবান পানি দিয়ে (নিজে এবং শিশুকে), গরম পানি খাওয়াবেন কয়েকবার, বাসার খেলনাগুলো সপ্তাহে ২ বার পরিষ্কার করবেন, এ সময় বাড়িতে অতিথি প্রবেশ না করানোই ভালো, প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে নিজে বা শিশু যাবে না। যদি একান্তই বাইরে যেতে হয় সেইক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্ব মানা, মাস্ক ও হাঁচি-কাশি শিষ্টাচার মানা, বাসায় ঢুকার পূর্ব মুহূর্তে এলকোহল যুক্ত হ্যান্ড সেনিটাইজার দ্বারা হাত সেনিটাইজ করুন, হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলুন, সর্বোপরি গোসল ও কাপড় ধৌত করে তারপর আপনার প্রিয় শিশুকে স্পর্শ করুন।

সরকার এনডিডি ট্রাস্টের মাধ্যমে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এ শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমকে যুগোপযোগী করতে দক্ষ শিক্ষক তৈরির জন্য বিশেষ শিক্ষা স্কুলের শিক্ষকদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। এনডিডি শিশুর সমন্বিত/বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা, ২০১৯ মোতাবেক স্থাপিত বিদ্যালয় সমূহে অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্ন শিশুদের পাঠদান নিশ্চিত করছে। এনডিডি ব্যক্তিদের কর্মমুখী প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে মেধা অনুযায়ী তাদেরকে দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে এবং জব ফেয়ার-এর মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হচ্ছে। অভিভাবক প্রশিক্ষণ নির্দেশিকা প্রণয়নপূর্বক অভিভাবক ও কেয়ার গিভার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।

সরকারি উদ্যোগে অটিজম বৈশিষ্টসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা ও সেবা প্রদান করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর পেডিয়াট্রিক নিউরো-ডিসঅর্ডার এন্ড অটিজম (IPNA) ও শিশু ও মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজে শিশু বিকাশ কেন্দ্র এবং জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল এ সংক্রান্ত চিকিৎসা ও সেবা প্রদান করা হচ্ছে। মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে এনডিডি ট্রাস্ট কর্র্তৃক ২০০০-২০২১ অর্থবছরে ২৫০০ জন এনডিডি ব্যক্তিকে ১০,০০০ টাকা করে এককালীন চিকিৎসা অনুদান প্রদান করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় দশ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অটিজম স্পেকট্রাম ডিজিজ এ আক্রান্ত। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। রুপকল্পঃ ২০২১, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, রুপকল্পঃ ২০৪১ এবং ডেল্টা প্লান বাস্তবায়ন করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে সকল শ্রেণিপেশার মানুষকে নিয়েই উন্নয়ন ঘটাতে হবে। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে উপযুক্ত কাউন্সেলিং, পুনর্বাসন, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাদেরকে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমেই সম্ভব সমন্বিত উন্নয়ন। সর্বোপরি, করোনাকালীন অটিজম ও বিশেষ শিশুর প্রতি অধিক নজর রাখুন এবং নিয়মিত এ শিশুর চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন।

 পিআইডি ফিচার

 

The post করোনাকালে অটিজম ও বিশেষ শিশুর যত্নে করণীয় appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3fGUb7D

No comments:

Post a Comment