মনিরুজ্জামান মুন্না
বই হচ্ছে জ্ঞানের আধার। জ্ঞানার্জনের দুটি শ্রেষ্ঠ মাধ্যম-বই পড়া ও ভ্রমণ করার মধ্যে বই পড়াই অপেক্ষাকৃত সহজ, সাবলীল ও ব্যয়সাধ্য। বইমেলা অর্থ বইয়ের মেলা বা বই নিয়ে যে মেলা। অর্থাৎ বইই হয়ে ওটে এ মেলার মূল উপকরণ, উপস্থাপনা ও নির্ভরতার বস্তু। তবে বিষয় বা বস্তুনিষ্ঠতা বইয়ের বৈশিষ্ঠ্য বা ধর্ম নয়, বই জীবন-জিজ্ঞাসা ও আত্মিক পিপাসা নিবৃত্তির তথ্য উপাত্ত ও বিশ্লেষণের সন্নিবেশ। তাই অন্যান্য যে কোন মেলার সাথে এর তুলনা বা সাদৃশ্য চলে না। কথায় বলে বোবার কোন শত্রু থাকেনা। কিন্তু আমরা দেখি শুধু বাকশক্তি ছাড়া আর সবকিছুই তার থাকে, বরং পরোক্ষভাবেই থাকে। তেমনি বই হচ্ছে নীরব বন্ধু। মিত্রত্ব ছাড়া এর শত্রু হওয়ার কোন শক্তি, সামর্থ ও কুটকৌশলতার সুযোগ থাকে না। তাই একখানা পছন্দের বই সঙ্গে থাকলে মানুষ কথনো নিঃসঙ্গ হয়না। বিশ^স্ত সঙ্গী হয়ে তা হতাশা, আলস্য অবসন্নতা ও দুশ্চিন্তা মুক্তির অনন্য অবলম্বন হতে পারে। একটি ভালো বই বস্তুনিষ্ঠ সুন্দর ভাবনায় আচ্ছন্ন বা ব্যস্ত রাখার সার্থক ভূমিকা নিতে পারে।বই মানুষের নিজ নিজ স্বতন্ত্র সাধনা, ভাব ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে লিপিবদ্ধ আর অন্তরে ধারন করারসুযোগ দেয়। যা অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতর নির্বাক সাক্ষী হয়ে থাকে। তাই তা মহাকালের লৌকিক সেতু বন্ধনে শিল্প-সাহিত্য-সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জীবন জগতের নান্দনিক দর্শনের সঙ্গী হয়। বই আমাদের প্রয়াত বিখ্যাত মনীষীদের নিঃশব্দ উপস্থিতি ও পরিচয় মিলায়। ফলে সুন্দর ও শিক্ষান্বেষু জীবন গঠনে বইয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- ‘মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল যদি কেউ এমন করে বেধে রাখতে পারতো যে, ঘুমিয়ে পড়া শিশুটির মতো চুপ করে থাকতো, তকে সেই নীরব মহাশব্দের সাথে বইয়ের তুলনা হতো। যেখানে নীরব ভাষার স্থির প্রবাহ মানবাত্মার অমর আলোকে কালো অক্ষরের শৃঙ্খল বুননে কাগজের সীমানায় বাঁধা পড়ে থাকে।’ শঙ্খের মধ্যে যেমন সমুদ্রের শব্দ শোনা যায়, তেমনি বইয়ের মধ্যে হৃদয়ের আবেদন ও অবেগি উত্থান-পতনের শব্দ শোনা যায়। এখানেই যেন জীবিত ও মৃত ব্যক্তির হৃদয় এব পাড়ায় পাশাপাশি বাস করে। বাদ-প্রতিবাদ দুই ভাইয়ের মতো একসঙ্গে থাকে। সংশয়-বিশ^াস, কৌতূহল-আবিষ্কার একই দেহের অঙ্গ হয়ে মিশে থাকে।সুতরাং বই কোন আনুষঙ্গিক অনুষঙ্গ ছাড়াই এক নির্ভরশীলতার এক আস্থাশীল আশ্রয়। ধর্ম, ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বইয়ের প্রভাব, প্রতিফলন, গুরুত্ব ও বৈশিষ্ঠ্য নিয়ে কালে কালে বড় বড় কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, গবেষক, মনীষিগণ বিভিন্ন ভাবে তাদের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির কথা ব্যক্ত করেছেন। আমি সে প্রসঙ্গে যাব না।
১৮০২ সালে ম্যাথু কেরি’র উদ্যোগে নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল শহরে প্রথম বই মেলার আসর বসে। তাঁর এ উদ্যোগী ভাবনা তত্ত্বের ইতিবাচক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ১৮৭৫ সালে অপেক্ষাকৃত বড় পরিসরে নিউইয়র্কেও ক্লিনটন শহরে একশ-জন প্রকাশক মিলে বই মেলার আয়োজন করে। এ মেলায় ত্রিশহাজার বই প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকে। ১৯৪৯ সালে জার্মানির ফ্রাংকফুটে শুরু হয় আরও বৃহত্তর বই মেলার আসর। কার্যত: এখান থেকেই বই মেলার আধুনিক ও গাণিতিক গতি সঞ্চারণের স্মরণীয় শুভযাত্রা। মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশের অন্যতম আধুনিক অবলম্বনীয় উপকরণ এবং অনন্য উর্বরক্ষেত্র হিসেবে বই মেলা যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। তাই দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর থেকে আত্মিক ও মানসিক পরিতৃপ্তিতে বইমেলা জনপ্রিয় হতে থাকে। আসলে বহুমাত্রিক প্রাণপ্রাচুর্যের চেতনাজাত প্রবণতার সন্নিবেশ ঘটায় এ মেলা।তাই বই মেলা অন্য কোন মেলার মতো নয়। বই মেলা বৈচিত্র্যময় অজ¯্র বই সমাবেশের সুযোগ করে দেয়। তাই বইয়ের এ সমাবেশ মিলিয়ে দেয় রুচির সাথে বইয়ের, ভানার সাথে ভাবনার, মানুষের সাথে মানুষের, চেতনার সাথে বিষয়ের, দেশের সাথে দেশের। জানিয়ে দেয় পারস্পরিক শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সভ্যতা, রাজনীতি ও সামাজিক জীবনবোধের আন্ত:সম্পর্ককে। সে কারণে বইমেলায় মূলত জীবন জিজ্ঞাসুদের ভীড় পরিলক্ষিত হয়। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর থেকে দেশে দেশে বই মেলা যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আসলে তখন থেকে মানুষ বুঝতে পারে যে, বৈচিত্র্যময় অজ¯্র বইয়ের সাথে অজ¯্র মননী আবেগ, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির সন্নিবেশ ঘটে। তাই অনুসদ্ধিৎসু ও কৌতূহলী জিজ্ঞাসা নিরাময়ের উপাদান হয়েযুগে যুগে বই মানুষের কাছে কাঙ্খিত গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
ভাষা শহিদদের স্মৃতিবাহী ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আরম্ভ হয় মাসব্যপী বাংলা একাডেমি আয়োজিত ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। ’৫২ পরবর্তীকালে শুরুরদিকে এ ছিল অন্যরকম মেলা।অর্থাৎ কবিদের মেলা। তখন একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে কবিতা পাঠের আসর বসাতো বাংলা একাডেমি। প্রথম দিকে ৫০ থেকে ১০০ কবি, তারপর ১৫০, ২০০, ৩০০, ৩৫০ কবিও কবিতা পড়েছেন এ আসরে। খালিপায়ে‘প্রভাতফেরী’ করে শহীদমিনারে ফুল দিয়ে আনেক দূর-দূরান্ত থেকেও কবি-সাহিত্যিকরা আসতেন এই আসরে যোগ দিতে। কবিতা শুনতে এবং কবিদের দেখতেও আসতেন অনেকে উৎসাহী সাহিত্যপ্রেমী, কবিতামোদিরা। তখন একুশে সঙ্কলের যুগ। অর্থাৎ একুশ এলেই দেশের নানান অঙ্গন থেকে প্রকাশ করা হতো সম্মৃদ্ধ সাহিত্য সঙ্কলন। অনেক কবি-সাহিত্যিক ও সাহিত্যমোদিদের সমাবেশ জেনে পথে-পথে যারা ফেরি করে সঙ্কলন বিলাতেন বা বিক্রি করতেন তারাও আসতেন এই অনুষ্ঠানে। বিক্রির আশায় আসর সংলগ্ন বাংলা একাডেমি চত্ত্বরের এক পাশে অবিক্রিত সঙ্কলন নিয়ে বসতেন তারা। এভাবে যায় কয়েক বছর। তারপর সঙ্কলনগুলোর সাথে আসতে থাকে পাঁচ-দশটি কবিতার বই। পরে তার সাথে যুক্ত হয় কিছু রাজনৈতিক বিষয়াদির বই।স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৭৪ সালে হঠাৎ ঐ সময়ের সাড়া জাগানো প্রকাশক ‘মুক্তধারা’র চিত্তরঞ্জন সাহা যোগ দেন বইপত্র নিয়ে। বিষয়টি নজরে ধরে শুরু হয় মেলার চিন্তা; তারপর আয়োজন।চিত্তরঞ্জন সাহা’র সম্পৃক্ততায় একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে পরের বছর (১৯৭৫ সালে) বাংলা একাডেমি প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বইমেলার উদ্বোধন করে। এরপর থেকে বাংলা একাডেমি নিয়মতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠনিকভাবে প্রতি বছর বইমেলার এ আয়োজন অব্যাহত রাখে। একদিন থেকে এক সপ্তাহ, এরপর এক পক্ষ, এখন পুরোমাস। এক সময় ছিল বইয়ের স্টলের প্রায় সমান সংখ্যক ফুচকা, চটপটি ও অন্যান্য খাবারের দোকান। আর প্রকাশকদের চেয়ে সংগঠন, সমিতি, সংস্থা, প্রতিষ্ঠানের জন্য বেশি জায়গা বরাদ্দের ব্যবস্থা। এক সময় সংযুক্ত হওয়া ক্যাসেটের দোকানগুলোর মাইক কান ঝালাপালা করে দিতো সকলের। উন্মুক্ত সুযোগে অপ্রকাশদের মতো অলেখকরাও দাপট দেখিয়েছে মেলায়। বই ও সাহিত্য সংশ্লিষ্টদের এ স্বতন্ত্র সুযোগ-সুবিধায় ক্ষমতা আর বাণিজ্যিক কর্তৃত্ব ফলিয়েছে তারা। প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের নামে স্টল বরাদ্দ নিয়ে কুড়িয়েছেন বাহাবা। সময়ের যৌক্তিক দাবি আর চাহিদার সঙ্গে-সঙ্গে বলছে দৃশ্যপট। নিয়ম করে সরানো হয়েছে কিছু অনিয়ম। রয়ে গেছে কিছু নিয়ম করা অনিয়ম। আর সুপারিশ থাকলেও কিছু অনিয়মের নিয়ম করা হয়নি এখনও। তারপরও মেলা বদলে দিয়েছে এবং ধরে রাখার অবলম্বন হয়েছে বইয়ে ব্যবসা, প্রকাশের আগ্রহ, পাঠকের রুচি অভ্যাস। এক অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করেছে বইয়ের পরিচিতি, প্রদর্শন, বেচা-কেনা,প্রকাশ ও প্রচার-প্রসারের। তাই বই লেখা, প্রকাশ করা, কেনাকাটা, ও প্রাসঙ্গিক আন্যান্য কার্যক্রমে এ মেলা এক অনন্য ভূমিকা রাখে। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মেলাটিকে ‘বাংলা একাডেমি বইমেলা’ নামে অবহিত করা হলেও ১৯৮৫ সাল থেকে ‘একুশে বইমেলা’ নামকরণ করা হয়। গঠনমূলক পরিকল্পনা ও কাঠামোগত উন্নয়নে বাংলা একডেমি’র এ আয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক রূপাপায় এবং উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটায়। ১৯৯৫ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র উদ্যোক্তা হিসেবে বাংলা একডেমি’র সাথে যুক্ত হয়। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের প্রশংসনীয় ভূমিকার মাধ্যমে সরাসরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বইমেলা আরও আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। বর্তমানে ঢাকার এই বইমেলাটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার প্রক্রিয়াধীন।
মেলা প্রাঙ্গণের সীমবদ্ধ পরিসরে বিচিত্র প্রকরণের আগণিত বইয়ের সমাবেশ ঘটায় ক্রেতাদের পক্ষে বিভিন্ন স্টল ঘুরে রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী বই নির্বাচন সহজ হয়। মেলার সাজোয়া বর্ণাঢ্য উন্মুক্ত পরিবেশে লেখক, প্রকাশক ও পাঠক বা ক্রেতাদের মধ্যে সরাসরি ভাববিনিময় ও আন্ত:সম্পর্কের অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাই বইয়ের টানের সাথে মেলার আকর্ষণ নবতর প্রাণশক্তির এক অনাবিল আনন্দ¯্রােতে অবগাহনের শিহরণ জাগায়। যুগের যান্ত্রিকতায় কর্মব্যস্ততা মানুষের নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠেছে। তাই যারা এমনিতে সময় ধরে বই খুঁজে নিয়ে কেনার সুযোগ পান না বা আগ্রহ হারিয়েছেন কিংবা বই সংশ্লিষ্ট আনন্দঘন সমাবেশ পান না তারাও এক দুর্বার অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে বই মেলায় ছুটে আসেন। যাপিত জীবনের জটিল ও কুটিলাবর্তের বন্ধনজাল ছিন্ন করে অন্তরের মালিন্য ঘোচাতে কখনো কখনো বইকেনার আগ্রহ ছাড়াও মানুষ ভিড় জমায় এ মেলায়। তাদের কেউ কেউ কিনেও ফেলেন দু’একটি বই। মেলার সার্বিক আবেদন আর মোহমুগ্ধ আবহ বড়দের বইকেনার আগ্রহ সৃষ্টিতে যেমন ইন্ধন যোগায়, ছোটদের আগ্রহ, উৎসাহ ও কল্পনাকে তেমন উজ্জীবিত করে। শুধু জ্ঞানের আধার হয়েই নয়; বই মানুষের মনের বেদনা মোছায়, আনন্দ দেয়। এক অলৌকিক চৈতন্যে নান্দনিক ও দার্শনিক সত্যবোধ জাগায়। অনুপ্রাণিত করেপ্রেম-প্রীতি, নতি-সহানুভূতি, মায়া-মমতা, ত্যাগের দীক্ষা আর সত্য-সুন্দরের সাধনায়। যুগে যুগে বই-ই এনেছে চেতনার উত্তরণ। তাই এর প্রভাব দৃষ্টিকে করে উন্নত, মনকে করে উদার, জীবনকে করে নিখুঁত সুন্দর। মানুষকে দেয় আলোক পথের সন্ধান। ফলশ্রুতিতে বইয়ের এ মেলা আমাদের মনুষ্যত্ববোধ, জাতীয় চেতনা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অনুপম সহায়ক শক্তি। দেশ ও জাতির অগ্রগতির একটি প্রধান উপলক্ষ।
অনগ্রসরতা, অজ্ঞতা, অসচেতনতা ও পাঠবিমুখতার কারণে আমাদের এ আঞ্চলে (পূর্ববাংলায়) বইমেলার প্রচলন ততটা প্রাচীন না হলেও বিশেষত দেশ স্বাধীনের পর তা নিয়ে প্রভূত উৎসাহ-উদ্দীপনা তথা আয়োজন লক্ষণীয়। হয়ত অত্যন্ত তাৎপর্যম-িত এ বিষয়টির প্রতি বিদ্যোৎসাহীদের আগ্রহ, কৌতূহল ও অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিবদ্ধের কারেণে এর অবাধ দূয়ার উন্মোচিত হয়েছে। তাইপ্রতি বছর বিশেষ ঘটা ও নিয়ম করে প্রধানত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ বই মেলাটি বেশ আড়ম্বরী তোড়জোড়ে জাকজমকভাবে পালিত ও উদযাপিত হয়ে আসছে। এছাড়া ঐ একই মাসে বা বছরের সুবিধা মত সময়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা-উপজেলা শহরে বইমেলার আয়োজন পালিত হয়ে আসেছে। বাংলাদেশের নৈঋত (দক্ষিণ-পশ্চিম) প্রান্তেআবস্থিত সুন্দরবন সংলগ্ন একটি প্রান্তিক জেলা সাতক্ষীরা। প্রান্তিকতা তার প্রকৃতি ও জীবন বিন্যাসে।জীবন-জীবিকা প্রবাহে সুখ-দু:খের ছন্দময় লীলামাধুরীতে এর প্রভাব সতত সঞ্চারিত। বর্ণাঢ্য সম্ভাবনাতে, সম্পদে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, কৃষ্টি-সভ্যতা-ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। বুড়োন পরগনার পরিচিতি ধরে অনেক গৌরব উজ্জ্বল কর্মকা-ে ও পৌরাণিক আদি উপাখ্যানে এ অঞ্চলের উল্লেখ মেলে।ব্রিটিশ যুগে বাঙালি জনপদেও শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মীয় তথা সামগ্রিক সামাজিক উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র ছিলো কোলকাতা (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)। সাতক্ষীরা সে প্রাণকেন্দ্রের খুব কাছে হওয়ায় এখানকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কীর্তিময়, আভিজাত্য ম-িত ও বৈচিত্র্য বৈভবে প্রতিফলিত। স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থানের পর সাতক্ষীরা কেন্দ্রিয় পাবলিক লাইব্রেরি এবং সাতক্ষীরা জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদ তারই ধারাবাহিকতায় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে।স্বাধীনতার স্বতন্ত্রে, নতুন ঠিকানায়, নতুন পরিচয়ে সাতক্ষীরার উৎসাহী সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুরাগীদের স্বত:স্ফূর্ত প্রয়াস ও উদ্যোগেসবকিছু যেন আবার প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। তবে সে প্রক্রিয়ায় বইমেলার প্রচলনটা প্রচলিত হয় বেশ পরে। তবে এখানে বইমেলা আসলে প্রতি বছর নির্ধারিত সময় ও নিয়ম মেনে অনুষ্ঠিত হয়নি।
১৯৯১ সালে কেন্দ্রিয় পাবলিক লাইব্রেরি’র উদ্যোগে লাইব্রেরি কক্ষে অস্থায়ী পার্টিশান দিয়ে বইমেলার প্রথম গোড়াপত্তন ঘটে। ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়রি পর্যন্ত ৯ দিনব্যাপি এ মেলা চলে। কেন্দ্রিয় পাবলিক লাইব্রেরি, ইসলামিক ফাউ-েশন ও স্থানীয় কিছু সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন এ আয়োজনে অংশগ্রহণ করে। আয়োজনটির পরিসর ক্ষুদ্র হলেও এর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীসহ সকল শ্রেণির দর্শকের উপস্থিতিতে জমজমাট হয়ে ওঠে। তাছাড়া বইমেলা প্রবর্তনের শুভ সূচনা হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এর পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৯২ সালে কেন্দ্রিয় পাবলিক লাইব্রেরিতে ১৯ জানুয়ারি থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ০৩ দিন ব্যপী বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলাটি চলে ‘পুঁথিঘর’ (পাঠ্যপুস্তক) ও ‘মুক্তধারা’ (সৃজণশীল) প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা’র একক উদ্যোগ ও অংশগ্রহণে। এ মেলাটিও উৎসাহী দর্শক-ক্রেতার ভিড়ে জমজমাট হয়ে উঠে। ঐ একই বছর (১৯৯২) ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭ দিনব্যাপী একই ভেনুতে কেন্দ্রিয় পাবলিক লাইব্রেরির উদ্যোগ ও আয়োজনে বইমেলার আসর বসে। মেলাটি সাতক্ষীরাবসীর কাছে সমগুরুত্ব ও আগ্রহের সাথে সমাদৃত হয়। ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে লাইব্রেরি’র সংগঠনিক জটিলতায় (সাধারণ সম্পাদকের মৃত্যুজনিত) বইমেলার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়। ১৯৯৫ সালে লাইব্রেরির উদ্যোগে বইমেলার আয়োজন চলে। এ মেলাটিতে ইসলামিক ফাউ-েশন, শিশু একাডেমিসহ সাতক্ষীরার ‘পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পক্ষথেকে কয়েকটি স্টল বরাদ্দের মাধ্যমে বইমেলাটি সুসম্পন্ন হয়। আর ঐবছর থেকেই বইমেলা লাইব্রেরির ভিতর থেকে বেরিয়ে সম্মুখ চত্বরের উন্মুক্ত পরিবেশে পৃথক-পৃথক স্টল নির্মাণের মাধ্যমে স্ব-স্ব আঙ্গিক সাজ-সজ্জায় অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বন্যাজনিত অস্থিরতা ও নানান অস্থিতিশীলতার কারণে বইমেলা আয়োজনের ধারাটি সাময়িক স্তব্ধ রয়ে যায়। ২০০২ সালে আবার বইমেলা উদ্যাপিত হয়। এরপর স্থানীয় ‘পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’ অনেকটা প্রভাবী ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠায় মূল উদ্যোক্ত লাইব্রেরি ও প্রশাসনের সাথে সমন্বয়হীনতার কারণে ২০০৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বইমেলার কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ২০১০ সালে জেলা প্রশাসক জনাব আবদুস সামাদ মহোদয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপ ও তত্ত্বাবধানে এ সংক্রান্ত বিবাদের অবসান হয়। লাইব্রেরি সংশ্লিষ্টদেরকে সাথে নিয়ে বইমেলা আয়োজনের উদ্যোগ শুরু করে। এভাবে ২০১০ সালে কেন্দ্রিয় পাবলিক লাইব্রেরি’র সম্মুখ চত্বরে এবং ২০১১ সালে জেলা শিল্পকলা একডেমি চত্বরে বইমেলার জমজমাট আয়োজন চলে। ২০১২ ও ২০১৩ সালে ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, আইলা জনিত অস্থিরতায় বইমেলা আবার বন্ধ রাখা হয়। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে যথানিয়মে বইমেলা চলে। ২০১৭ সালে মূল উদ্যোক্তার ভূমিকায় থাকা কেন্দ্রিয় পাবলিক লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের বই মেলার ব্যাপারে কোন সাড়া মেলেনি। যার কোন সঙ্গত কারণও জানা যায়নি। ২০১৮ সালে অনেকটা সংক্ষিপ্ত ও দায়সারা ভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে সাতক্ষীরার কয়েকজন লেখকের প্রকাশিত বই বিক্রয় ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ। যেটাকে কোন বইমেলা বা বইমেলার বিকল্প ভাবার সুযোগ আছে কিনা জানিনা। সুসমন্বয়হীন ও আকস্মিক সিদ্ধান্তের কারণে যাথাযথ প্রচার-প্রসারের অভাবে এ আয়োজনটি জমজমাট হতে পারেনি। সাতক্ষীরার বইমেলা আয়োজনে ধারাবাহিকতা ও ব্যবস্থাপনার কিছু ছন্দপতন ঘটলেও আসলে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত উদ্যোক্তা, পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্ববধায়ক হিসেবে সরাসরি সরকারি বা প্রশাসনিক সম্পৃক্ততা ছিলোনা। কার্যত ১৯৯৫ সাল থেকে মেলার তদারকি, প্রস্তুতি ও পর্যালোচনায় প্রশাসনের সরাসরি ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়।
২০১৯ সালের দুটি বইমেলার আয়োজন হয়। এ দুটি মেলা সম্পর্কে একটু আদালাভাবে বলার দাবি রাখে। কারণ এদু’টি সাতক্ষীরার বইমেলার ইতিহাসে রেকর্ড ভঙ্গকারী মেলা। আসলে সৌভাগ্যবশত এ সময়ে আমরা জেলা প্রশাসক হিসেবে পেয়ে যাই এস এম মোস্তফা কামাল মহোদয়কে, যিনি বাঙালি জাতিস্বত্তা লালনকারী অত্যন্ত সৃজনশীল ও সাহিত্য-সংস্কৃিত প্রেমি মানুষ। তিনি প্রায়ই বলেন-‘আমি ব্যতিক্রমে বিশ^াসী, তাই অপেক্ষাকৃত ভালো ও ভিন্ন আমেজ সৃষ্টি করতে না পারলে তা আমি করি না। তাছাড়া সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতা আমাকে টানে। অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও যখন আমি এমন কোন পরিম-লে যাই বা এ অঙ্গনের মানুষের সাহচর্য পাই, তখন কি এক অদ্ভূত অক্সিজেনের আবেশে তৎক্ষণাৎ সব ক্লান্তি নাশ হয়ে যায়। ’প্রথম মেলা ৭মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ দিবস থেকে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও জাতীয় শিশুদিবস পর্যন্ত। অবশ্য বইমেলার সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সাথে দিবস দু’টির ঐতিহাসিক তাৎপর্য তুলে ধরার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বই মেলার জন্য মনোনীত এই মাস এবং শুরু ও সমাপ্তির দিনক্ষণটি মেলাটিকে কয়েকটি বাড়তিমাত্রায় মহিমান্বিত করে তোলে, যা এ জনপদে ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক পরিচিতির আন্ত:সম্পর্ক অবহিত, নিবিড় ও মজবুত করতে ভূমিকা রাখে। ১১ দিনব্যাপী বইমেলার জন্য এই প্রথম ঢাকা কমপক্ষে পঞ্চাশটি খ্যাতিমান প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়।জ্ঞান মানুষের সুপ্ত অনুভূতি, অনুভব, উপলব্ধি ও মননী সৃজনীশক্তিকে তীক্ষè, কারুকার্যখচিত, ঐশ^র্যম-িত করে তোলে। আর বই-ই হতে পারে তার অনিবার্য পরিপূরক।’
বই মনুষ্যত্বের অপমান ও মানবতার অপধারণার বিরুদ্ধে প্রকৃত ন্যায়, যুক্তি ও সত্যের মুখবন্ধ আবেদন সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে। প্রেম-ভালোবাসা, নৈ:সর্গ, লৌকিক-অলৌকিক-অতিলৌকিক ও পরাবাস্তব চেতনাকে যথার্থ উচ্চকিতভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে এবং তা প্রকাশে উজ্জীবিত করে। ফলে ধ্রুপদি ভাবনার বস্তুনিষ্ঠ অর্জন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমরা নি:সন্দেহে বইয়ের কাছে সমর্পিত। যাবতীয় মানবিক গুণাবলি হাসিলের সক্ষমতায় নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বিচিত্র বিষয়ের পঠন-পাঠন ও অনুশীলনের বিকল্প নেই। যুক্তি আইন ও বাস্তবতার সিদ্ধান্ত মাথায় রেখে অবিচারের চুড়ান্ত পরিণতির নাম স্বাধীনতা। কঠিন ত্যাগ ও মূল্যে অর্জিত সে স্বাধীনতা রক্ষা এবং সুফল ভোগে বইপড়া বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চারও একটা যোগসূত্র আছে। ফলশ্রুতিতে একটি সার্থক বইমেলা মেলা পরিবেষ্টিত অঞ্চল বা জনপদে মনোগঠন ও আত্মিক উৎকর্ষ সাধনে প্রভাব ফেলে। গৌরবময় অতীত ঐতিহ্যে লালিত ও সমৃদ্ধ সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন কর্মযজ্ঞে চলমান ধারায় সাতক্ষীরাতে প্রথম যেন তেমনই একটি অধিকতর ফলপ্রসূ বইমেলার সার্থক আয়োজন পেয়েছি। তাই সঙ্গত কারণে এর আঙ্গিক সমৃদ্ধি, প্রসার, পরিসর ভিন্ন। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর চেতনাকে সর্বস্তরে ধারণ করতে প্রজ্ঞার শৈল্পিক দক্ষতা দিয়ে জেলা প্রশাসক মহোদয় মূল উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। আর তাই তিনি সংশ্লিষ্টদের সাথে নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বইমেলা মতো সময়োপযোগী বাস্তব ও গঠনমূলক কিছু প্রসঙ্গিক পদক্ষেপ, পরিকল্পনা, নির্দেশনা নিয়ে। যার পৃষ্ঠপোষকতা আর নিয়মিত তদারকিতে সে বার আমরা একটি কাঙ্খিত কার্যকরী, ফলপ্রসূ ও সার্থক বইমেলার সফল বাস্তবায়ন ঘটাতে পেরেছি। যা এ নৈঋত সীমান্ত মফস্বলের পেক্ষাপটে একটি উন্নত বইমেলার আমেজ-মেজাজে পরিপুষ্ট। তাই অপেক্ষাকৃত নতুনত্বে এমন একটি বইমেলা উপহার পেয়ে সাতক্ষীরাবাসী মুগ্ধ, পুলোকিত।
একই সালের অর্থাৎ ২০১৯ সালে দ্বিতীয় বইমেলাটি আরও বর্ণাঢ্য ও আকর্ষণীয় আয়োজনে সাতক্ষীরাবাসীকে ঋদ্ধ করেছে। সাতক্ষীরার সর্বস্তরের দর্শক-ক্রেতার কাছে বইমেলার চিরাচারিত ধারার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে আরও একধাপ এগিয়ে দেয়।ঢাকা থেকে খ্যাতিমান ৫৪টি পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এ মেলায় অংশ নিয়েছে। অংশ নিয়েছে নজরুল ইনষ্টিটিউট, বাংলদেশ চলচিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, জাতীয় গ্রন্থাগার, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, ইসলামিক ফাউ-েশন, মহিলা অধিদপ্তর, পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি(পুনাক)’সহ রাষ্ট্রায়ত্ত কিছু প্রকাশনা সংস্থা। এছাড়াও প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সংগঠন, সংস্থা এ মেলায় অংশ নেয়। ৭০টি পরিপাটি ও সাজোয়া বইয়ের স্টল শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কের পুরো মাঠজুড়ে বিরাজমান। এই প্রথম মেলা প্রাঙ্গণে নিরাপত্তার জন্য স্থায়ী পুলিশ বক্স, স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র ও সুপেয় পানি পানের ব্যবস্থা, অনুসন্ধান বা তথ্য পাওয়ার জন্য ইনফরমেশন বুথ এর ব্যবস্থা রাখা হয়। বই কেনায় উৎসাহিত করার জন্য প্রতি দুইশত টাকা মূল্যের বই ক্রয়ের বিনিময়ে একটি করে কুপন দেওয়া হয়। দামি ও আকর্ষণীয় উপহার সংবলিত এসব কূপনের ড্র অনুষ্ঠিত হয় মেলার সমাপনি আসরে। প্রতিদিন কুইজ প্রতিযোগিতার সরাসরি মূল্যবান (বই) প্রাথমিক, সেমি ও মেগা পুরস্কার অত্যন্ত প্রাণবন্ত করে তোলে। ১৬ নভেম্বর ২০১৯ থেকে ৩১ নভেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত ১৬ দিনব্যাপী এ আয়োজনের উদ্বোধনী দিনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে রঙ-বেরঙের ফেস্টুন, পতাকা এবং ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ী ও ব্যান্ডদল নিয়ে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কের মেলা প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছায়। উদ্বোধনী পর্বে অতিথী হয়ে আসেন ও আলোচনা পেশ করেন-ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চান্সেলার জনাব অধ্যাপক আরিফিন সিদ্দিকী, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব জনাব আব্দুল মান্নান, খুলনা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার জনাব আনোয়ার হোসেন হাওলাদার (বর্তমানে সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশন), জাতীয় গ্রন্থাগারের পরিচালক জনাব মিনার মুনসুর এবং রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়েরএকজন সিনিয়র শিক্ষকসহ স্থানীয় প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মহলের শীর্ষ ব্যক্তিগণ মঞ্চে উপবিষ্ট হন। তাঁরা তাঁদের আলোচনায় ও পরিদর্শনে মেলা সম্পর্কে অত্যন্ত মৌলিক ও ইতিবাচক মন্তব্য পেশ করেন। এই বইমেলাটি সাতক্ষীরা কেন্দ্রিয় পাবলিক লাইব্রেরির পঞ্চাশ বছর পূর্তি ও মুজিবর্ষকে উপলক্ষ করে আয়োজিত হয় এবং বিশেষ বিবেচনায় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মাধ্যমে সংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের অনুদানপ্রাপ্ত হয়। তাছাড়া মুজিববর্ষকে সংযোগ করে বাংলাদেশে এটিই প্রথম কোন অনুষ্ঠান। সুতরাং এর মর্যাদা, গুরুত্ব ও মাত্রা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। প্রথমে ১৬ নভেম্বর’২০১৯ থেকে ২৫ নভেম্বর’২০১৯ পর্যন্ত এর সময় ধার্য থাকে কিন্তু এর বিস্তৃত পরিসর ও সার্বিক আড়ম্বরতায় অভিভূত হয় এ জনপদের সকল মানুষ। তাই তাদের চাহিদা, প্রত্যাশা ও দাবির প্রতি সম্মান রেখে ৩১ নভেম্বর’২০১৯ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এ উপলক্ষে শহরের কয়েকটি আতিগুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে মনোরম গেট বা তোরণ নির্মাণ করা হয়। জনবহুল ও বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণস্থানে টানিয়ে দেওয়া হয় বইমেলার লোগো, সেøাগান, তথ্য ও বঙ্গবন্ধুর ছবি সংবলিত বিশালাকার ফেস্টুন। তাই সারা শহরময় এর একটা প্রভাব ও উৎসবি আমেজ বিরাজ করে। বিস্ময়ী দোলা জাগায় সকলের অন্তরে অন্তরে। মূল মেলাতে অত্যন্ত নান্দনিক কারুকার্য সম্পন্ন ফটক (গেট) ও মেলা মাঠের বাহারি সাজবেশ সকলকে অভিভূত করে।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্য ও দু:খের সাথে বলতে হয় যে, এত সব গতিময় উৎসাহ উদ্দীপনার পর পরই ২০১৯ সালের মে মাসে প্রাকৃতিক দূর্যোগ ‘ফণি’ ও তৎপরবর্তী ‘ডেঙ্গু’র প্রভাব এবং নভেম্বরে ‘বুলবুল। ২০২০ সালে মার্চে ভয়াবহ সংক্রামক ভাইরাস ‘করোনা’ এবং মে মাসে সাইক্লোন ‘আম্ফান’ এভাবে ধারাবহিক দুর্যোগী বিপর্যয়ের ঘনঘটায় অস্থির ও ল-ভ- দিক-দিগন্ত। বিশেষ করে ২০২০ সালে করোনার উগ্র আগ্রাসনের অকরুণ কারসাজির জটিল চক্রের আবর্তে স্থগিত হয়ে গেছে বই মেলার আবেদনী আয়োজন। প্রাণঘাতী সংক্রামক করোনা ভাইরাসের বিভৎসতায় হারিয়ে ও এলোমেলো হয়ে যায় বইমেলাসহ অন্যান্য সব আয়োজনের পরিকল্পিত পরিকল্পনা।অবশেষে করোনা জনিত জড়োতার জটিলতা কাটিয়ে আবারও বঙ্গবন্ধুৃর জন্মশতবর্ষ, জাতিয় শিশুদিবস ও স্বধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ১৭ মার্চ-২০২১ থেকে ২৬ মার্চ-২০২১ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ফিরে এসেছে ‘বঙ্গবন্ধু বইমেলা’। দশদিন ব্যপি এ আয়োজনে জাতিয় কর্মসূচির সাথে সংগতি রেখে এর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে আবৃত্তি উৎসব, সাংস্কৃতি উৎসব, শিশু উৎসব, বীর মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ, নাটক, প্রাসঙ্গিক আলোচনা ও আলোকচিত্র প্রদর্শন ইত্যাদি। এর পাশাপাশি রয়েছে কুইজ ও সাংস্কুতিক প্রতিযোগিতা (অবৃত্তি, সংগীত, চিত্রাঙ্কন, গল্পবলা ইত্যাদি)। যা উৎসবি আমেজের বন্ধ্যাত্ব কাটিয়ে মানুষকে একইসাথে পরিচ্ছন্নতা, শৃঙ্খলা ও সুরক্ষা সচেতনতার পাশাপাশি উদ্যামী আর সাহসী করে তুলেছে। শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে প্রাণবন্ত এ আয়োজনে মানুষ যেন আবদ্ধ জীবনের মুক্তি খুঁজে নিয়েছে।
বর্তমানে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় গণগ্রন্থগার ও জাতিয় গ্রন্থকেন্দ্র এর উদ্যোগে এবং স্থানীয় আয়োজনে বই মেলা যতেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। ব্যাপক আগ্রহ ও লোকসমাগমে তা সফল ও সার্থক হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি যে, করোনা কালিন সংকট কাটিয়ে প্রজন্মের মৌলিক ও মননশীল আত্মচৈতন্য সৃষ্টিতে এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সমাজিক দায়, আর সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার টানে দেশব্যপী এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। লেখক: সাধারণ সম্পাদক, সাতক্ষীরা সিকান্দার একাডেমি
The post বই মেলার সেকাল একাল: প্রেক্ষিত সাতক্ষীরা appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3lCDrRw
No comments:
Post a Comment