Friday, October 29, 2021

‘আমার চোখেও চোখ রেখেছে কবিতা’ https://ift.tt/eA8V8J

প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়

বেদ ও উপনিষদের ভাষা, রামায়ণ ও মহাভারতের ভাষা, ত্রিপিটকের ভাষা, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ভাষা, চর্যাপদের ভাষা, রামচরিতমানসের ভাষা, রাজতঙ্গিনীর ভাষা,কালিদাসের ভাষা, চৈতন্যচরিতামৃতের ভাষা, গীতগোবিন্দের ভাষা,শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা, আবুলফজলের ভাষা, কবিরের ভাষা, অমরখৈয়ামের ভাষা, খনার ভাষা, অন্নদামঙ্গলের ভাষা, মেঘনাদ বধ কাব্যের ভাষা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাষা, বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভাষা, রামপ্রসাদের ভাষা, রবীন্দ্রনাথের ভাষা, অবনীন্দ্রনাথের ভাষা, নজরুলের ভাষা, সৈয়দ মুজতবা আলির ভাষা, অদৈত্যমল্লবর্মনের ভাষা,সতীনাথ ভাদুড়ীর ভাষা, সুকুমার রায়ের ভাষা, শরৎচন্দ্রের ভাষা, তারাশঙ্কর ও বিভূতিভূষণের ভাষা,, মানিকের ভাষা,জীবনানন্দের ভাষা,সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও বুদ্ধদেব বসুর ভাষা, সত্যজিৎ রায়ের ভাষা,কামিনী রায়, রাজলক্ষ্মী দেবী, আশাপূর্ণাদেবীর ভাষা এবং তার পরের প্রথিতযশা কবিসাহিত্যিকদের ভাষা….। এবং এই সময়ের কবিদের ভাষা। [ এটুকু ঠিকঠাক সাজিয়ে লিখতে পারলাম না ]

প্রকৃতি, সমাজ, বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস-
সভ্যতার ভেতরের আরও অনেক কিছু নিয়ে ক্রম বিবর্তনের পর আমাদের আর্য ও অনার্য মিশ্রিত যে ভাষা —এই সবটাই আমরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গ্রহণ করেছি। ভাষা ও সংস্কৃতির এই কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে লেখা বই যদি পাঠ করা যেত, তাহলে এ জন্মে আর এক লাইনও লেখার সময় থাকতো না আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের। তাই আমি আমার মতো একটি ভাষা তৈরি করে নিয়ে লিখে চলেছি আগডুম বাগডুম। টাকডুম টাকডুম।

একবিংশ শতাব্দীতে বাঙালির কাব্যভাষা ও সংস্কৃতির যে তরঙ্গ বয়ে চলেছে — সেই তরঙ্গও বিবর্তিত হতে হতে আজ যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে আছে, তা হলো আমাদের মতো অপ্রথিতযশা কলমশ্রমিকের কাব্যভাষা তার নিজের মতো করে তৈরি হয়েছে। তাই আমরা সকলেই এখন এক একজন কাব্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছি। এবং আমরা আমাদের মতো পছন্দের বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে হেঁটে চলেছি। এই ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানকে কেউ কেউ বলেন গোষ্ঠী। মাঝে মাঝে গোষ্ঠী কোন্দলও দেখা যায়। তা হলে ধরে নিতে কোনো অসুবিধে নেই, আমরা এখন গোষ্ঠীভাষায় কথা বলতে ও লিখতে অভ্যস্ত। এই গোষ্ঠীভাষার মধ্যে নানারকম ভাষার প্রলেপ লাগানো চলছে নিরন্তর। ফলে এখন কোনো একজন বিখ্যাত কবি বলতে পারবেন না—দেখো আমি যেমন করে কাব্যভাষা সৃষ্টি করেছি, সেই মতো এসো — আমাকে অনুসরণ করো। আমার মতো লেখো। আমার পথেই বাংলা সাহিত্য এগোবে।

এই মুহূর্তে তেমন কবির কাব্যভাষাকে আমরা নিশ্চিত খুঁজে চলেছি। যে ভাষা বিপুল আলোড়ন ফেলবে। এবং সেই কাব্যভাষা অন্তত ৫০ বছর টিকে থাকবে। আর যদি প্রতিভার জোরে ১০০ বছর সেই কাব্যভাষা টিকে যায়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। তিনি মনীষী হয়ে যাবেন।
এ প্রসঙ্গে একটি লেখার কথা মনে এলো। কয়েক বছর আগে একটি প্রত্রিকায় এক মহা পপুলার কবি আক্ষেপের কথা বলেছিলেন, তখনো তিনি ঠিক মতো কাব্যভাষা সৃষ্টি করতেই পারেননি!
এই আক্ষেপ আমাদের অনেকের মধ্যেও। কিন্তু ওই যে বললাম, আমরা অনেকেই নিজেদের মতো একটা ভাষা তৈরি করে নিয়ে লিখে চলেছি। যে ভাষার, বৃহৎ সমাজকে প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত করার কি কোনো ক্ষমতাই নেই? যে ভাষা লেখার পর ৭২ ঘন্টা পরেই আইসিইউতে চলে যায়? তারপর শ্মশানে?

ধরুন, দশকের হিসেব বাদ দিয়ে পাঁচজন কবির কবিতা কবির নাম না দিয়ে লিখে দেখাই আগে। বলতে হবে কোনটা কোন কবির কবিতা।
১.
” ..সবার মুখেই আলকাতরা, মধ্যমেধার ভীড়ে
পৃথিবীতে সাম্যবাদ এসে গেছে। ”

২.
” চাহিদা নামক অত্যাশ্চর্য পেন্ডুলামের কাছে
তুমি কেবল যোগান দিয়ে যাচ্ছ
সাতরঙের ইচ্ছাসমূহ। ”

৩.
” আমি সাজিয়েছি একান্ত আমারই ঘর্মকলি
খেলা শেষের খেলায় আজ বাজে হসংধ্বনি। ”

৪.
” হাতে হাত রেখে যে সম্পর্কের শুরু
প্রদীপের আলোয় ধরা পড়ে তার প্রতিচ্ছবি –”

৫.
” রগচটা কোন্ পদ্য ছিল,
খানিক উতল হাস্নুহানায় —
কে দিল তার ভাত বেড়ে আর
জাদুর ছিটে দানায় দানায়! ”

এই পাঁচ জন কবির মধ্যে তিনজন নারী ও দুজন পুরুষ। এখন কবির নাম না জেনে,শুধু কাব্যভাষা চিনে বলা যাবে কি এটি অমুকের, ওটি তমুকের। বলা যায় না। অথচ কবিতাগুলির বয়স হয়তো ৭ থেকে ৮ বছর।
কেন বলা যায় না? তাহলে কি এই সব কবির
” নিজস্ব কোনো কাব্যভাষা নেই, যা অন্য কারুর মতো নয়? ”
তাহলে কী আছে। কেন পড়ি এই সব কবিতা। নিশ্চয় কিছু আছে।
কী আছে, তা যিনি পড়বেন, তিনিই বুঝবেন। অন্য কেউ না।
আর হ্যাঁ, কবিও বুঝেসুঝেই লিখেছেন। না হলে তিনি লিখতে যাবেন কেন?
” পাঠক মনে রাখবেন, কী রাখবেন না, সেটা পাঠকের ব্যাপার — এমন কথা কবি বলতেই পারেন। ”

এখন উদাহরণ হিসাবে পাঁচজন বিখ্যাত কবির কবিতা এখানে লেখা যায়। তা লিখলাম না। তার বদলে কবিতা সম্পর্কে সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি গদ্য অনুসরণ করছি। ‘ শর্ত একটাই, কবিতা হল কিনা ‘ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন –” এই যে তকমা এঁটে দেওয়া, লেবেল সেঁটে দেওয়া, এরা কি একদিন কবিতার পক্ষে রক্ষাকবচের কাজ করবে? আমরা তো বরং একসময়ের চিহ্নিত করণের যে প্রচলন ছিল –প্রেমের কবি, প্রকৃতির কবি, বিদ্রোহী কবি, প্রতিবাদী কবি–তা থেকে সরে এসেছি অনেক, খসিয়ে দিয়েছি কবির নামের আগে এসে হাজির হওয়া এইসব অকিঞ্চিতকর যাবতীয় বিশেষণ। পরিচয় তো তাঁর একটাই — তিনি খাঁটি অর্থে কবি কিনা। তাহলে তাঁরাই কবিতার আগে কেন তার আগাম চরিত্র ঘোষণা নিয়ে এত আয়োজন, এত মাতামাতি, এত নীরস আনুষ্ঠানিকতা? ধরা যাক, কুলপরিচয় দেওয়ার পর প্রতি কবিতার সূত্র হিসেবে নির্দেশিত হল কয়েকটি অনুজ্ঞা, গোটা আটেক কিংবা অধুনান্তিক কবিতার সূত্র সংখ্যা দাঁড়ালো ডজন খানেক। যুগপৎ ধরা যাক এটাও, একজন কবি দাঁড়ালেন এ দুয়ের একটি ঘরাণার নির্দেশনামার সামনে। কী করবেন তিনি। দেখবেন কি এটাই যে ওই ধরাকাটের মধ্যে আবদ্ধ থেকেই তিনি লিখে উঠতে পারছেন কি না তাঁর প্রত্যাশিত কবিতাটি…। ”

এটাই বড়ো কথা — কবি তাঁর প্রত্যাশিত কবিতাটি লিখতে পারছেন কি না। না হলে এখনকার ভাষার যা ট্রেন্ড বাজারজাত করা হচ্ছে, তার মধ্যে সবই তো দেখা যাচ্ছে ‘অসাধারণ ‘ ‘ বাহ ‘ ‘ দারুণ ‘ ‘ ফাটাফাটি ‘ ইত্যাদি।
বোধহয় এখন নিজস্ব কাব্যভাষা এগুলোই। না হলে ফটাফট এতো ‘ ফাটাফাটি ‘ সৃষ্টি হতো না…।

The post ‘আমার চোখেও চোখ রেখেছে কবিতা’ appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/2ZIWEu5

No comments:

Post a Comment