এমএ রহমান, কেশবপুর (যশোর): ডায়ের খালের অপরিকল্পিত ক্রসবাঁধ এখন ভবদহ অঞ্চলের ২৭ বিলের চারিপাশের মানুষের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় দেড় মাস ধরে এ অঞ্চলের প্রায় ২ লক্ষাধিক পরিবার পনিবন্ধি হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তবে পানিবন্ধি মানুষের অভিযোগ, স্থানীয় চেয়ারম্যান পানি অপসারণ নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছেন।
মঙ্গলবার দিনভর ২৭ বিল এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এ বিলের চারিপাশের কেশবপুর ও মনিরামপুর এলাকার প্রায় অর্ধশত গ্রাম পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। মৎস্য ঘেরের মতো মানুষের বসতবাড়িগুলোও পানিতে থৈ-থৈ করছে। ঘেরের মাছ আটকাতে মালিকরা যেমন নেটের পর নেট নিয়ে মরিয়া হয়ে ছুটছে তাদের ঘেরের দিকে অন্যদিকে পরিবার-পরিজন ও বসতবাড়িগুলো বিশেষ করে কাঁচা ও আধাপাকা ঘর পানির হাত থেকে রক্ষা করতে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে পানিবন্ধি এলাকার মানুষেরা। অনেকের বসতঘর, রান্নাঘর ও গোয়াল ঘরে হাটু পানি লক্ষ করা গেছে। পারাপারের জন্য অনেকের উঠানে বাঁশের সাঁকো দেখতে পাওয়া যায়। হাঁটু পানি ভেঙে তলিয়ে যাওয়া রাস্তা দিয়ে হেঁটে পার হচ্ছে মানুষ। বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষের জন্য নৌকা ও তালের ডোঙা রাখা আছে রাস্তার ধারে। অধিকাংশ পায়খানা ঘর তলিয়ে গেছে। এক প্রকার পানির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে এ অঞ্চলের মানুষ ও গবাদি পশুগুলো। এদিকে জলাবদ্ধ এলাকায় সাপ,বিচ্ছু ও পানিবাহিত রোগের প্রদুর্ভুাব বৃদ্ধি পাওয়ার ভয়ে অনেকে বাড়ি ছেড়ে পরিবার-পরিজন ও গবাদি পশুর নিরাপত্তার কথা ভেবে আশপাশের আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া শুরু করেছে। পানির কবল থেকে রেহাই পায়নি এ এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। বাড়িঘর ও রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীর উপস্থিতি একে বারে শূন্যের কোঠায়।
জানা গেছে, অতিবৃষ্টি ও অপরিকল্পিত ডায়ের খালের ক্রস বাঁধ ও বিল খুকশিয়ার এইট ব্যান্ডের দায়িত্বপ্রাপ্তদের গাফিলাতির ফলে প্রায় দেড় মাস ধরে পানিবন্ধি হয়ে পড়েছে ২৭ বিলের কেশবপুর ও মনিরামপুর উপজেলার প্রায় ৫০টির মত গ্রামের প্রায় ২ লাখ পরিবার। পানিবন্ধি গ্রামগুলো হলো-কেশবপুরের গড়ভাঙ্গা, ডুঙাঘাটা, বেলকাটি, সাগরদত্তকাটি, বাগডাঙ্গা, মনোহরনগর, পাথর ঘাটা, পাঁজিয়া, বেতিখোলা, নারায়নপুর, আড়–য়া, কালিচরনপুর, সারুটিয়া, নরায়নপুর, কলাগাছি, কানাইডাঙ্গা, গৃধরনগর, কাাঁটাখালি, ময়নাপুর, সানতলা, মনিরামপুর উপজেলার-ভরতপুর, ঘঘুদা, ভারগরিয়া, পাড়ালা, ভাটুয়াডাঙ্গা, কুশুরীকোনা, দত্তকোনা, কামিনডাঙ্গা, রজিপুর, কোনাখোলা, ঝিকরডাঙ্গা, হরিনা, বাটবিলা, ডুর্বাডাঙ্গা, আশ্বাননগর, নারকেলবাড়িয়া, ভবানিপুর ও খাকুন্দিয়াসহ প্রায় ৫০টি গ্রাম।
সুফলাকাটি ইউনিয়নের নারায়নপুর-বেতিখোলা গ্রামের পানিবদ্ধি অসংখ্য মানুষের সাথে কথা হলে তারা তাদের দু:খ-দুর্দশার কথা তুলে ধরে বলেন, পানির কারণে আমরা আমাদের পরিবার নিয়ে ঠিকমত ঘুমাতে, রান্না করতে পারি না, সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছি গবাদি পশুগুলো নিয়ে। তাছাড়া গোরস্তানে এত পরিমান পানি যদি এই সময় কেউ মারা যায় তাহলে তাকে অন্য গ্রামে নিয়ে মাটি দিতে হবে। সামনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন তাই আমাদের চেয়ারম্যান পানি সরানো নিয়েও রাজনীতি শুরু করে দিয়েছে।
কালিচরনপুর, ময়নাপুর ও সানতলা গ্রামের পানিবন্ধি মানুষের সাথে কথা হলে তারা বলেন, আমরা খাদ্য চাইনা, টাকা চায়না, আমারা পানিবন্ধি থেকে মুক্তি চাই। ২৭ বিলের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র উপায় হল বিল খুকশিয়ার এইট ব্যান্ড। যদি জোয়ার-ভাটার সময় এইট ব্যান্ডের কপাট ঠিকমত উঠানামা করানো হতো তাহলে আমরা দীর্ঘ দেড় মাস পানি বন্ধি থাকতাম না। কিন্তু স্থানীয় চেয়ারম্যান রাজনৈতিক উদ্যেশে হাচিলে ডায়ের খালে অপরিকল্পিতভাবে ক্রসবাঁধ দিয়ে সেখানে পুরনো আমলের আঙ্গুরী প্রথা চালু করে ২৭ বিলের জলাবদ্ধতা নিরসনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
জলাবদ্ধতা নিরাসনে ২৭ বিল সেচ প্রকল্প কমিটির কোষাধক্ষ সাবেক চেয়ারম্যান এসএম মনজুর রহমান বলেন, যেহেতু এটা ২৭ বিলের সমস্যা, বৃহৎ অঞ্চলের ব্যাপার, তাছাড়া ২৭ বিলের জলাবদ্ধা একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। দ্রুত জলাবদ্ধতা নিরাসনে ডায়ের খালের ক্রসবাঁধ বা আঙ্গুরী প্রথা চালু করে বৃহৎ অঞ্চলের পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব নয়। জোয়ার-ভাটার সময় যদি এইট ভেন্ডের কপাট ঠিকঠাকভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে দ্রুত সময়ের মধ্যে ২৭ বিলের পানিবন্ধি মানুষ এই অভিশাপ থেকে মুক্ত পাবে ।
এব্যাপারে সুফলাকাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ সরদার জানান, ২৭ বিলের পানি বিল খুকশিয়ার এইট ব্যান্ড দিয়ে হরিনদী হয়ে নিষ্কাশিত হয়। কিন্তু হরি নদের তল দেশ উঁচু হওয়ার কারণে এইট ভেন্ড সম্মুখের ডায়ের খালের সংযোগ মাথাটি ক্রস বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যাতে করে জোয়ারের পানি ২৭ বিলে ঢুকতে না পারে। পাশাপাশি ঐ ক্রসবাঁধে ৩টি কাঠের আঙ্গুরী স্থাপন করা হয়েছে। এই কাঠের অঙ্গুরীর কপাট দিয়ে ভাটার সময় ২৭ বিলের পানি দ্রুত গতিতে হরি নদী দিয়ে নিষ্কাশিত হচ্ছে। আশা করি অল্প দিনের মধ্যে ২৭ বিলের মানুষের বাড়ি থেকে পানি নেমে যাবে। পানি অপসারণের নামে কোন রাজনীতি করার সুযোগ নেই।
এব্যাপারে কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এম. এম আরাফাত হোসেন বলেন, ২৭ বিল ভবদহ অঞ্চলের একটি অংশ। এ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা দীর্ঘদিনের সমস্যা। মানুষের বাড়ি-ঘরের পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য ডায়ের খালের স্থানীয় চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে ক্রস বাঁধে কাঠের আঙ্গুরী বসানো হয়েছে। আশা করি ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে মানুষের বসতবাড়ি থেকে পানি নেমে যাবে।
The post কেশবপুরে দেড় মাস পানিবন্ধি ২৭ বিলের ২ লাখ পরিবার ডায়ের খালের অপরিকল্পিত ক্রসবাঁধ এ অঞ্চলের জন্য এক বিষফোঁড়া appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/Cy1LQm
No comments:
Post a Comment