Friday, July 31, 2020

কুরআন-সুন্নাহর আলোকে কুরবানির হাকিক্বাত https://ift.tt/eA8V8J

মাওলানা মো. ওবায়দুল্লাহ
কুরবানির পরিচয়: কুরবানির আরবী প্রতিশব্দ উদহিয়া।যার শাব্দিক অর্থ কুরবানির পশু, কুরবানি, উৎসর্গ, ত্যাগ ইত্যাদি (মু’জামুল ওয়াফি, ড. ফজলুর রহমান)। উদহিয়া বলা হয় কুরবানির ঐ পশুকে যা ঈদের দিন তথা জিলহজ্ব মাসের দশ, এগার, বারো তারিখে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য জবেহ করা হয়। আশ্্ শাফী গ্রন্থের গ্রন্থকার আল্লামা কাজী ইয়াজ (রহ.) বলেন-এই নামকরণের কারণ হলো সময়ের বিবেচনায়। কেননা পশু জবেহ করার কাজটি দ্বিপ্রহরের সময় সংগঠিত হয়। আর দু’হা অর্থ সূর্য উঁচু হওয়া ও দিনের আলো প্রখর হওয়া।
শরীয়তে কুরবানির বিধান: কুরবানির শরঈ সম্মত হওয়ার বিষয়টি কুরআন, হাদিস, ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। কুরআনে এই বৈধতা ও আদেশ এসেছে সুরা আল কাউসারে।ইরশাদ হচ্ছে-“ফা’ছল্লিলি রব্বিকা অনহার” (সুরাহ কাউসার, আয়াত নং-০২)। মুফাসসিরগণ বলেছেন, এ আয়াতে ঈদের দিনে নামাজ আদায় করার পর কুরবানির আদেশ করা হয়েছে। আর সুন্নাত হচ্ছে-হাদিসে এসেছে হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত-রাসুলুল্লাহ (সা.) দুটি শিং বিশিষ্ট কালো ও সাদা মিশ্রিত দুম্বা জবেহ করেন। তিনি জবেহ করার সময় তাকবীর ‘আল্লাহু আকবার’ বলেন এবং ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ করেন।
কুরবানির বিধান: কুরবানি মুসলিম মিল্লাতের পিতা খলিলুল্লাহ হযরত ইব্রাহিম (আ.) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি সুন্নাত যা উম্মাতে মুহাম্মাদির উপরও আল্লাহ তায়ালা জারি রেখেছেন। আর উম্মতের মধ্যে এর বিধানগত বিষয়ে কতিপয় মতভেদ আছে। যেমন: ইমাম শাফেয়ী, আহমাদ এবং এক রেওয়াত অনুযায়ী ইমাম মালেক (রহ.) এর মতে, কুরবানি করা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদা। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন- কুরবানি শরীয়াত ও দ্বীনের অংশ হওয়ার ব্যাপারে কোন মতোভেদ নেই। ইমাম শাফেয়ী ও জমহুর ফকিহগণের মতে, কুরবানী করা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদায়ে কিফায়া। শাফেয়ী মাযহাবের কারো কারো মতে, তা ফরজে কেফায়া। আর ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, সক্ষম মুকিম ব্যক্তির জন্য তা ওয়াজীব। ইমাম মালেক (রহ.) থেকে ও অনুরুপ বর্ণনা পাওয়া যায়। (সূত্র: ফাতহুল বারি, ১০ম খন্ড, ইবন হাজার রহ.)। হানাফি মাযহাবের বিখ্যাত ইসলামী আইন শাস্ত্রের কিতাব ‘হেদায়া’ গ্রন্থকার বলেন-“সকল সক্ষম স্বাধীন মুকিম ব্যক্তির ওপর জিলহজ¦ তথা ঈদুল আযহার দিন নিজের ও নিজের শিশু বাচ্চার তরফ থেকে পশু কুরবানি করা ওয়াজিব”।
কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার দলিল: কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে রাসুল (সা.) এর সুন্নাহ দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত। সুনানে ইবনে মাজাহ এর সহীহ হাদিসে স্পষ্ট বর্ণিত আছেÑ “সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানি করলো না,সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে” (সুত্র: ইবনে মাজাহ হাদিস নং-৩১২৩,মুসনাদে আহমাদ হাদিস নং-৮২৭৩,মুস্তাদারকে হাকিম হাদিস নং-৭৫৬৫)।এই ধরনের কঠোরতা ও নিষেধাজ্ঞা কেবলমাত্র ওয়াজীব বিধান ছাড়া অন্য কোন বিধান এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সুনানে তিরমিযির একটি হাসান হাদিসে বর্ণিত আছে যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা.) হতে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় দশ বছর থেকেছেন এবং প্রত্যেক বছরই তিনি কুরবানি করেছেন। (তিরমিযি হাদিস নং-১৫০৭, আবু ঈসা বলেন, হাদিসটি হাসান)।হানাফি মাযহাবের বিখ্যাত ফকীহ আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (রহ.) বলেন- রাসুল (সা.) এর দশবছর অবিচ্ছিন্নভাবে এই আমল দ¦ারা প্রমাণ হয় যে, কুরবানী একটি ওয়াজীব আমল।
কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলী ও চামড়ার হুকুম: কুরবানি স্বাধীন মুকিম মুসলমান যার উপর কুরবানির দিনে ৭.৫০ তোলা স্বর্ণ বা ৫২.৫০ তোলা রৌপ্য বা এর সমমূল্যের নগদ অর্থ অথবা ব্যবসার মাল কিংবা প্রয়োজন অতিরিক্ত সামানপত্র থাকে, তাহলে তাঁর উপর কুরবানি ওয়াজিব হবে (অর্থাৎ যা বর্তমান রৌপ্যের বাজার মূল্যে হিসাবে ৫৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা যদি কারোর মালিকানায় থাকে, তাঁর উপর কুরবানি করা ওয়াজীব)। যাকাতের ক্ষেত্রে যেমন সম্পদ একবছর মালিকানা থাকা শর্ত থাকে কিন্তু কুরবানির ক্ষেত্রে তা নয়।এককথায় যে পরিমাণ সম্পদের অধিকারি হলে ঈদুল ফিতরের দিনে ফিতরা ওয়াজীব সেই পরিমাণ সম্পদ কুরবানির দিনে তথা যিলহজ্ব মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে সম্পদ হস্তগত হলেই তাঁর উপর তিন দিনের যেকোন দিনে কুরবানি করা ওয়াজিব। একবছর বয়েসের একটি বকরি, কিংবা দুই বছর বয়সের গরু বা মহিষ সাত ভাগের অন্তত এক ভাগ অংশে শরীক হয়ে কুরবানি করা ওয়াজিব। আবার, একা একটা পশু কুরবানি করা অধিক উত্তম যা সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আর কুরবানির চামড়ার হুকুম হলো, এটি পাকা করে নিজে ব্যবহার করা যায় বা অন্যকে হাদিয়াও দেওয়া যায়।তবে চামড়া বিক্রয় করলে তার মূল্য গরিব-মিসকিনকে তাঁর টাকা দান করে দিতে হবে।(সুত্র: হিদায়া, ১ম খন্ড, ২৩২ পৃষ্ঠা)।
উট বা গরু সাতজনের পক্ষ থেকে এবং মেষ-ছাগি একজনের পক্ষ থেকে হবে: আর এ বিষয়ে ছিয়া ছিত্তার চারটি হাদিস গ্রন্থে একযোগে নস এসেছে। বিশিষ্ট হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, হুদায়বিয়ার বছরে আমরা রাসুল (সা.) এর সাথে কুরবানির পশু জবেহ করলাম উট সাত জনের পক্ষ থেকে এবং গরু সাত জনের পক্ষ থেকে। (সুত্র: সহীহ মুসলিম হাদিস নং-১২১৩, ১৩১৮, আবু দাউদ হাদিস নং-২৮০৯, তিরমিযি হাদিস নং-১৫০২, ইবনে মাজাহ হাদিস নং-৩১৩২)।
কুরবানির মাসনুন তরীকা: আর এ বিষয়ে সহীহ আল বুখারির কুরবানি অধ্যয়ে চমৎকার রুপে বর্ণিত আছেÑ “হযরত বারা রাঃ হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুল (সা.) বলেছেন, আমাদের এই দিনে আমরা সর্বপ্রথম যে কাজটি করবো, তাহলো সালাত আদায় করবো। এরপর ফিরে এসে আমরা কুরবানি করবো। যে ব্যক্তি এভাবে তা আদায় করলো সে আমাদের নীতি অনুসরণ করলো। আর যে ব্যক্তি নামাজের আগেই জবেহ করলো তা এমন গোশতরুপে গণ্য, যা সে তার পরিবার পরিজনের জন্য আগাম ব্যবস্থা করল। (একথা শুনে), রাসুল (সা.) সাহাবী হযরত আবু বুরদা ইবনু দিনার (রা.) দাঁড়ালেন, আর তিনি ঈদের নামাজের আগেই জবেহ করেছিলেন।তিনি (সাহাবী) বললেন- আমার নিকট একটি বকরির বাচ্ছা আছে, রাসুল (সা.) বল্লেন, তুমি তাই ই জবেহ করো। তবে তোমার পরে তা আর কারোর জন্য যথেষ্ট হবে না। মুতররাফ, বারা (রা.) হতে বর্ণনা করেন, নবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সালাতের পর জবেহ করলো তার কুরবানি পূর্ণ হলো এবং সে মুসলমানদের রীতি পালন করলো। (সুত্র: সহীহ আল বুখারি, হাদিস নং-৫১৭২)।
কুরবানির গোস্তের বন্টন: কুরবানি দাতার জন্য কুরবানির গোস্ত বন্টন করার মুস্তাহাব পন্থা হলো তিন ভাগ করে, একভাগ নিজের জন্য, একভাগ আত্মীয় স্বজনদের জন্য হাদিয়া দিবে, আরেক ভাগ গরিব মিসকিনদের দান করবে। এটা মুস্তাহাব বা উত্তম। (সুত্র: আদ্্দুররুল মুক্তার, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা-৩২৮)। কুরবানির দাতার জন্য কুরবানির গোশত বিক্রি করা হারাম, (ফাতাওয়া শামী-৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা-৩১৩)।
কুরবানি প্রদানকারীর মর্যাদা: এ বিষয়ে আম¥াজান আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হতে সহীহ সনদে বর্ণিত আছে যে, “রাসুল (সা.) বলেছেন, কুরবানির দিনে আদম সন্তান যত কর্ম করে তন্মধ্যে আল্লাহর নিকট প্রিয়তম কর্ম হলো রক্ত প্রবাহিত করা। কুরবানির পশু কিয়ামতের দিন তার শিং, খুর ও পশমসহ উপস্থিত হবে। আর কুরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর নিকট মর্যাদার স্থানে স্থিত হয়। অতএব তোমরা আনন্দচিত্তে কুরবানি করো (সুত্র; ইবনে মাজাহ হাদিস নং-৩১২৬, সুনানে তিরমিযি হাদিস নং-১৪৯৩, মুস্তাদারকে হাকিম হাদিস নং-৭৫২৩)। সুরাহ হজ্বের মধ্যে কুরবানির গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন যে, “আল্লাহ তায়ালার কাছে তোমাদের কুরবানির রক্ত, গোশত কিছুই পৌছায় না বরং আল্লাহ তায়ালার কাছে তোমাদের তাকওয়া তথা অন্তরের ইখলাছপূর্ণ নিয়ত বা উদ্দেশ্য পৌছায়” (সুরাহ হজ্ব-আয়াত নং-৩৭)। লেখক: বি.এ অনার্স, এম.এ, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

The post কুরআন-সুন্নাহর আলোকে কুরবানির হাকিক্বাত appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/2XgK1SB

No comments:

Post a Comment