পত্রদূত রিপোর্ট: অপপ্রচার করে গত ৭ আগস্ট বিকেলে খুলনার রুপসা উপজেলার ঘাটভোগ ইউনিয়নের গোয়াড়া মহাশ্মশানমন্দির, শিয়ালী গ্রামের ১১টি মন্দির, মন্দিরের প্রতিমা, দু’টি বাড়ি, সাতটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও একটি ক্লাব ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ঘটনার পরবর্তী র্যাব ও পুলিশ ১৭জনকে গ্রেপ্তার করলেও আওয়ামী বিরোধী রাজনৈতিক দলের কিছু কর্মী সমর্থক ওই এলাকার হিন্দুদের হুমকি দেওয়ায় অনেকেই মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
এ অবস্থায় শুক্রবার সন্ধ্যায় শ্রম প্রতিমন্ত্রি মন্নুজান সুফিয়ান ক্ষতিগ্রস্ত শিয়ালী গ্রামের ভাঙচুর করা মন্দির, বসত বাড়ি, ক্লাব ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শণ করেছেন। কথা বলেছেন ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিবারের সদস্যদের সাথে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় শিয়ালী মল্লিকপাড়া রাধাগোবিন্দ মন্দির প্রাঙ্গনে উপস্থিত থাকা শ্রম প্রতিমন্ত্রীর কাছে কর্ণধর মল্লিক, অশোক ধর রীতা মল্লিকসহ কয়েকজন জানান, মহামারী করোনা ও গ্রামে সম্প্রতি কয়েকটি অপমৃত্যুর ঘটনা নিয়ে গত ২ আগস্ট রাতে স্বপ্ন দেখেন তাদের গ্রামের কৃষ্ণ ব্যাপারির স্ত্রী শিলা ব্যাপারী। তিনদিন ধরে এলাকায় হরিনাম সংকীর্তণ করলে করোনা ও অপমৃত্যুর হাত থেকে গ্রামের মানুষ রক্ষা পাবে বলে স্বপ্নাদেশ হয়। সে অনুযায়ি ৫ আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর মল্লিকপাড়ার ২৫-৩০ জন নারী ও পুরুষ হরিনাম করতে করতে মধ্যপাড়া হরিমন্দির থেকে বের হয়ে শিয়ালী বাজারের পাশে গোয়াড়া-শিয়ালী মহাশ্মশানের দিকে রওনা হন। শিয়ালী বাজারের নিকটে এসে দাইপাড়ার সামনে রাস্তায় পৌঁছালে দাইপাড়ার মাসুম, দুরুল ইসলাম, লিটনসহ কয়েকজন তাদেরকে হরিনাম গাইতে মানা করে। এ নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এরপর রণজিৎ মজুমদারের বাড়িতে মহাপ্রভুর মালসা ভোগের অনুষ্ঠানে যান তারা। সেখান থেকে বাড়ি ফিরে বিষয়টি উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শক্তি পদ বসু, ইউপি সদস্য মনি মালাকারসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অবহিত করা হয়।
পরদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে শক্তিপদ বসুর নেতৃত্বে ৩০-৪০ জন হরিনাম সংকীর্তণ করতে দাইপাড়ার সামনের রাস্তায় গেলে আবারো দাই পাড়ার কয়েকজন তাদেরকে কীর্তণ বন্ধ করতে বলে। এসময় উভয়ের মধ্যে হাতহাতি হয়। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে শিয়ালী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক লিটনকে জানানো হয়। তিনি এসে উভয়পক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। কথা বলেন ছুটিতে থাকা রুপসা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে। একপর্যায়ে ৮ আগস্ট রোববার উভয়পক্ষকে নিয়ে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলোচনায় বসার দিন ধার্য করেন। রাতে পার্শ্ববর্তী চাঁদপুর হাইস্কুল মাঠে কয়েকজন একত্রিত হয়ে মল্লিকপাড়ায় হামলার পরিকল্পনা করে। বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করা হয়। ৭ আগস্ট শনিবার বিকেল তিনটার দিকে চাঁদপুর গ্রামের ও পার্শ্ববর্তী এলাকার দেড় হাজারের বেশি লোক শিয়ালী বাজারে আসে। এসময় তারা নিপুন ধর ওরফে শিব ধরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপ্রপচার দেয়। তাদের হাতে দা, কুড়াল, লোহার রড, বাঁশের লাঠিসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র ছিল। এ সময় তারা আঠারবাকি নদীর ধারে মহাশ্মশানের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ বাঁধা দেয়। পুলিশের বাঁধা উপেক্ষা করে তারা শ্মশান মন্দিরের দরজা ভেঙে প্রতিমা ভাঙচুর করে। লুটপাট করা হয় মন্দিরের জিনিসপত্র ও প্রণামীর টাকা। এরপর তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ দিয়ে শিয়ালী গ্রামের মধ্যপাড়ার মধু মল্লিকের হরিমন্দিরে এসে হামলা চালায়। ভাঙচুর করা হয় মন্দিরের দরজা ও প্রতিমা। এরপর হামলাকারিরা নিপুন ধর ওরফে শিব ধরের খুন করতে হবে এমন কথা উল্লাস করতে করতে পূর্বপাড়ায় আসার পথে একে একে প্রভাষ মল্লিকের মুদি দোকান, গণেশ মল্লিকের ঔষধের দোকান, অনির্বাণ হীরার চায়ের দোকান, প্রীতম মজুমদারের ম্যাশিনারিজের দোকান, পূর্বপাড়া সার্বজনীন দুর্গা মন্দির, তারণ্য দীপ্ত একতা সংঘ, সার্বজনীন কালীমন্দির, দুর্গা মন্দির, হরিমন্দির (২) ও রাধা গোবিন্দ মন্দিরসহ ১১টি মন্দির ও মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করে। ভাঙচুর শেষে লুটপাট করা হয় মোট সাতটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ও একটি ক্লাবে।
শিয়ালী মল্লিকপাড়ার শেফালী ধর জানান, বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে মধ্যপাড়ার কয়েকটি মন্দির, ক্লাব ও দাকান ভাঙচুর শেষে হামলাকারিরা তাদের বাড়ির দিকে আসছে এমন খর পেয়ে তার বড় ছেলে নিপুন ধর ওরফে শিবু, তার স্ত্রী পলি ধর ও ছেলে গোপালকে তড়িঘড়ি করে পার্শ্ববর্তী বিনয় ঋষি ও তার ভাইয়ের বাড়ির শৌচাগারে লুকিয়ে রাখা হয়। হামলাকারিরা আসার আগেই তিনিসহ ছোট ছেলে নিশিথ ধরসহ বাড়ির অন্যরা বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আত্মগোপন করেন। একপর্যায়ে হামলাকারিরা তার স্বামীর সমাধি, পারিবারিক রাধাগোবিন্দ মন্দির, শৌচাগার, টিউবওয়েল ও বসত ঘরের গ্রীলের তালা ও দরজা ভেঙে ঘরের মধ্যে ঢোকে। আলমারির ভেঙে তারা ড্রয়ারে থাকা এক লাখ ৬৪ হাজার টাকা ও ছয় ভরি সোনার গহনা লুট করে। কবুতরের বাক্স ভেঙে ৫৫ জোড়া কবুতর নিয়ে যায় তারা। মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর শেষে ঘরের মধ্যে থাকা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র লুট করে তারা। ভাঙচুর করা হয় একটি মোটরসাইকেল। পরে ছেলে শিব পালিয়ে আছে ভেবে তাদের পিছনের শীতল বাড়–ই এর বাড়ি ভাঙচুর করে হামলাকারিরা।
তারণ্য দীপ্ত একতা সংঘের সাধারণ সম্পাদক মনোজিৎ বিশ্বাস, সুধাময় মালাকার, ইউপি সদস্য মনি মালাকার, গায়াড়া-শিয়ালী মহাশ্মশান পরিচালনা কমিটির প্রচার সম্পাদক অপূর্ব হালদার, ঘাটভোগ ইউপি চেয়ারম্যান সাধন অধিকারীসহ কয়েকজন জানান, এক স্কুলের দপ্তরী শিব ধরের বাড়ি, মন্দির ও তার বাবার সমাধি ভাঙচুর করেছে। যেভাবে মন্দির, প্রতিমা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ক্লাব ও বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়েছে তা যে কোন মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। তারা আরো জানান, গত ৯ আগস্ট খুলনায় অবস্থানরত ভারতীয় ডেপুটি হাই কমিশনারের প্রথম সেক্রেটারী রাজেশ রায়নাসহ খুলনা জেলা প্রশাসক, খুলনা পুলিশ সুপার, খুলনা রেঞ্জের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক ড. খন্দকার মুহা: মুহিতউদ্দিন, নেপালের সাবেক রাষ্ট্রদূত নিম চন্দ্র ভৌমিক তাদের এলাকা পরিদর্শন করেছেন। গত বৃহস্পতিবার ধর্মপ্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক, সাংসদ আক্তারুজ্জামান বাবু, সাংসদ সালাম মুর্শিদ, সাংসদ নারায়ণ চন্দ্র চন্দসহ কয়েজন রাজনৈতিক নেতা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পুলিশ টহলে থাকার পরও তারা সন্ধ্যার পর এলাকার বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। মামলা করার পর বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে সংগৃহীত ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে ৭৪ জনের নাম তারা জানতে পেরেছেন। যাদের নামে নতুন করে সম্পুরক মামলা দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তারা সাহস পাচ্ছেন না।
প্রতিমন্ত্রির সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন, খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুজিত অধিকারী, আওয়ামী লীগ নেতা পলাশ, ঘাটভোগ ইউপি চেয়ারম্যান সাধন অধিকারীসহ বিভিন্ন সংগঠণের নেতৃবৃন্দ। প্রতিমন্ত্রি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন যাতে ন্যায় বিচার পান সেজন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবেন বলে জানান।
এব্যাপারে জানতে চাইলে রুপসা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) সিরাজুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় শক্তিপদ বসু বাদি হয়ে চাঁদপুর গ্রামের ২৫ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১৫০ জনের বিরুদ্ধে গত ৮ আগষ্ট থানায় মামলা দায়ের করেছেন। এ পর্যন্ত ১৬জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৩ জনের প্রত্যেককে সাত দিনের রিমা- আবেদন করে দু’দিন করে মঞ্জুর হয়। জিজ্ঞাসাবদ শেষে তাদেরকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। সর্বশেষে আটককৃত তিনজনকে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন জানিয়ে এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। সর্বশেষ আরো একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারেরর চেষ্টা চলছে। রিমা-ে জিজ্ঞাসাবদ শেষে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে।
রুপসা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বলেন, পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। এলাকায় পুলিশ টহল অব্যাহত রয়েছে।
The post আজও থমথমে খুলনার রুপসা থানার শিয়ালী গ্রাম শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের ঘটনাস্থল পরিদর্শন appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3DmA1uD
No comments:
Post a Comment