Friday, July 30, 2021

জোছনার বালিয়াড়ি https://ift.tt/eA8V8J

ভাস্বতী গোস্বামী
জ্যোৎস্নার রাত এলে মিতুর তেষ্টা বেড়ে যায়। আকণ্ঠ ‘জ্যোৎস্না -মাধবীতে’ সে তার তৃষ্ণা মেটায়। এসময় তার দু-চোখ ভরে ঘুম আসে। ঘুমের ভিতর টের পায় শিরায় শিরায় জড়ানো চাঁদ, ধীরে ধীরে তার পোশাক খুলে নিচ্ছে। চোখ খুলে দেখতে পায় পুকুরের জলে, গলা-কাটা পূর্ণিমা ভাসছে। নগ্ন মিতু পুকুরে নেমে পূর্ণিমাকে জড়িয়ে ধরে। পূর্ণিমার জলোভাব শরীর হাতড়ে হাতড়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করে। বারবার ব্যার্থ হয়ে মাথা তুলে আকাশ দ্যাখে। ঠিক এসময়েই খিলখিল হেসে ওঠে পূর্ণিমা। জলের সারেঙ্গীতে ওর গান শোনে মিতু Í

‘ইস্ দুনিয়া কা সঙ্গ্ না চাহু
না ম্যাঁয় ঝুমকা, কঙ্গন না চাহু
য্যায়সে ভি হো, জিৎনা ভি হো রং পিয়া কে রঙ্গনা চাহু’

রেখায় রেখায় ফুটে ওঠে পূর্ণিমার কিন্নর শরীরের মানচিত্র। দুধসাদা ঢেউমালা, বালি-আকাশ আর চিনচিনে মৃত্তিকার স্পর্শ পায় মিতু। ফেনার ‘শাহতুষে’ জড়ানো পূর্ণিমার শরীরে টলটল করছে একমুঠো জল। নিজের আকাশী বসন টেনেটুনে পা আড়াল করে ব’সে পড়ে মিতু। আর তখনই দ্যাখে তার আকাশী বসন বদলে সেখানে সফেদ আকাশ। ভিজে উঠছে বসন প্রান্ত। মনে পড়ে, তার ঋতুমতী হওয়ার সময় এটা। দু-পায়ের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে চ্যাটচেটে জ্যোৎস্নার রেখা। রক্তফুলকে, শ্বেতপদ্ম হতে দে’খে, ভয়ার্ত মিতু চাঁদ দ্যাখে। জলের বুকে লেপটে যাওয়া পূর্ণিমা খোঁজে। চাঁদের রাজ্যে তখন স্তরে স্তরে স্ফটিকের রাজপ্রাসাদ উঠেছে। উঁচু উঁচু স্তম্ভের গায়ে তার ছায়া পড়ে। নিজেকে দেখে চমকে ওঠে সে। তার শরীরের ভার লাঘব হয়ে গেছে। পা-দুটি, মাটি থেকে অনেকটা ওপরে। মেঘের মতো স্তন, কুয়াশাজড়ানো কেশ।ফিনফিনে কাপড়ের এখানে সেখানে স্পষ্ট জ্যোৎস্নার ছোপ। মিতুর মনে পড়ে, কিছুক্ষণ আগেই তার ঋতুচক্র শুরু হয়ে গ্যাছে। আবার মনে পড়ে, শ্বেতফুলের ঝরে যাওয়া, সে আগে কখনো দ্যাখে নি।
রাতের দ্বিতীয় প্রহরের শেষভাগে নীলম দেখতে পায় মাটির ওপর দিয়ে জ্যোৎস্নার কাপড় পরা পরীটি উড়ে যাচ্ছে। সঙ্গে কিন্নর। অপূর্ব মমতায় কিন্নর আর পরী পরস্পরকে ধরে রেখেছে আলিঙ্গনে। নিশি না পরী এই ধন্দ কাটে রঘুরামের বাড়ির ‘নেলির’ ডাকে। শহর থেকে রঘুরামের ছেলে জয়রাম, একটা সাদা তুলো তুলো কুত্তা নিয়ে এসেছে। আদর করে নাম রেখেছে ‘নেলি’। সারাদিন-রাতের বেশিরভাগ সময়ই আলসেমিতে কাটে তার।বাদ, ওই পূর্ণিমার রাতগুলো। চন্দ্রালোক যতো বাড়ে, ততো তার কুঁই কুঁই কান্নার সঙ্গে পাড়ার সমস্ত সারমেয় পুঙ্গবরা ‘হুঁউউউউ’ ‘ঘ্রাঁ আ আ আ উ’, ‘ঘৌ ঘৌ’ ইত্যাদি যতোরকম ভাষায় সম্ভব, তাকে আশ্বাস দিতে থাকে। গত দুমাস ধরে এইরকম রাতগুলোয় নীলমের নৈশ অভিসার শুরু হয়েছে। রামলীলা ময়দানে, রাবণ পোড়ানোর দিন, বুকে ব্যাজ এঁটে মানুষের ভীড় সামলাচ্ছিল ‘সে’৷ । ‘তার’ হাতের ইশারামতো জায়গাতেই দাঁড়িয়েছিল নীলমদের পুরো পরিবার। রাবণ-পোড়ার র সময় একটা উঁচু আতসবাজি ‘হুইশ’ করে রাবণের বুক ছুঁতেই তুমুল উল্লাসের মধ্যে নীলমের কানে আসে

‘ইস্ বার জরুর হো জায়েগা’
‘ক্যায়া?’ বলে ঘাড় ফেরাতেই নীলম দ্যাখে বুকে ব্যাজ আঁটা সে-ই ভলাণ্টিয়ার।
‘আরে কুছ্ নহীঁ ছোড়ো ক্যায়া তুম্ রওশনি হো?’
‘নহীঁ নীলম কিঁউ?’ চটে উঠে মুখ ঘুরিয়ে নেয় নীলম
‘এ্যায়সে হি ম্যাঁয় হুঁ শশাঙ্ক শশাঙ্ক মতলব জানতি হো? চন্দা’
বলেই গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে,

‘নীলে নীলে অম্বর পর
চান্দ যব আয়ে

বাঃ বেশ গায় তো! অতো আলো, বাজির আওয়াজ, মানুষের উল্লাসের মধ্যেও মনে হয় নীলমের।
তারপরের কোজাগর পূর্ণিমার সন্ধেয় ঘরের বাইরে আলপনা দিতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল নীলম। বাড়ির উল্টোদিকের পোস্টের লাইটটা কেটে গ্যাছে পুজোর আগেই। তার পিছনের ‘ছত্তিস নাম্বার’ খালি প্লটের ঝুঁঝকো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছেলেটা। বাইকে হেলান দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে হাসছে আর আকাশের চাঁদ আটকে আছে তার শার্টের পকেটে। নীলম দাঁড়িয়ে পড়তেই বাইক ছেড়ে এগিয়ে এলো শশাঙ্ক্। পকেট থেকে চাঁদটা খুলে নীলমের আলপনার ওপর গড়িয়ে দিলো। পায়ের নীচটা আলো হয়ে উঠতে উঠতে নীলম শুনলো শশাঙ্ক গাইছে

‘তেরে হোঠোঁ পে হ্যায়/ হুস্ন কী বিজলিয়াঁ
তেরে গালোঁ পে হ্যায়/ জুলফ কী বদলিয়াঁ

আশপাশের বাড়ি থেকে সেদিন যারা নীলমকে দেখেছিলো তারা প্রত্যেকে বলেছিলো কোজাগরের আলোস্নান ক’রে সপসপে নীলম নাকি উজ্জ্বল গ্রিক গডেস ভেনাসের মতো হয়ে উঠেছিল। কিন্তু শশাঙ্কের কথা কেউই কিছু বলে নি। তারপর থেকে প্রতি পূর্ণিমার রাতে নীলম, চাঁদনীর সিঁড়ি বেয়ে শশাঙ্কের সঙ্গে অভিসারে বেরোয়। তখন তাকে দেখতে পায় শুধুমাত্র জয়রামের সাদা কুকুর নেলি আর কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে কাঁদে।

সেদিন ছিল অঘ্রাণ মাসের পূর্ণিমা। গুরু নানক দেবের মর্ত্যে পদার্পণ তিথিটি। মধ্যরাতে, আলোয়-আতসবাজিতে ভেসে উঠছিলো জসপ্রীত-জসলীনদের বাড়িটা। ভিকি-সোনুর কচি কচি গলা কানে আসছিলো অঘ্রাণের হিম কুয়াশার তাঁবু পেরিয়ে। নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে গুরুদ্বার থেকে প্রবাহিত কীর্তন ছড়িয়ে পড়ছিল শান্ত শীতালু চরাচরে। এক প্রশান্ত নির্লিপ্তির আবেশ যেন। চাঁদ, সে রাতে দেরি করে উঠেছলো Í না, রাস্তা পার ক’রে ঢুকে পড়েছিল ‘তাম্রলিপ্ত সিটি’-র চব্বিশতলা অর্ধ-সমাপ্ত টাওয়ারগুলোয়, তা আর খেয়াল করে নি কেউ। শুধু রাতের খানা শেষ ক’রে কম্বলে সেঁধোবার আগে ‘তা¤্রলিপ্ত সিটির’ সিকিউরিটি সুপারভাইজার মকবুল, চাঁদকে নাকি দিল্লি-মেরঠ এক্সপ্রেসওয়ে ধ’রে তীরবেগে ছুটে যেতে দ্যাখে। তার রূপোলি চুন্নি থেকে বাষ্পর ধোঁয়া উঠছিলো। আর, বাষ্প থেকে আকাশে উড়ছিলো অগুনতি সাদা কাক। মকবুলের বিশ্বাস, কাকগুলো সব বোবা ছিল। কারণ, সে সাইট থেকে তাদের দিকে এলোপাথাড়ি ইঁট ছুঁড়লেও তারা কোনরকম শব্দ করে নি।তারপরেই শুরু হয় নেলির কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে ভয়ার্ত কান্না। চলতেই থাকে অনন্তের পথ ধরে। নেলির গোঙানি কখন থেমেছিলো, শীতের ওমভরা বিছানা থেকে খেয়াল করে নি কেউ।

তার পরদিন যা ঘটেছিলো তার জন্য প্রস্তুত ছিলো না রাস্তার এপারে থাকা চান্দেরিয়া,বরখাপুর, মুনারগাঁও, ঝিঙ্গোলা, খেরি-বাওলি বস্তির মানুষজন। এক অশৈলি ঘটনার সাক্ষী হয়ে তারা ভয়ে কুঁকড়ে উঠেছিল। অন্যান্য দিনের মতোই সেদিনও ভোরবেলাতে শুরু হয়েছিল গ্রামের জীবন। বরখাপুরের নীলম আর খেরি-বাওলির মিতু, ঘুম থেকে উঠলে সবিস্ময়ে তাদের বাড়ির লোকজন দ্যাখে, তাদের দীর্ঘ বিনুনি মাঝখান থেকে কেউ শাণিত কাঁচি দিয়ে কেটে নিয়েছে। কর্তিত অংশটার কোন চিহ্ন কোথাও নেই। খুব দ্রুত এ খবর ছড়িয়ে পড়েছিল নিস্তরঙ্গ গ্রাম গুলোয়। আর, চান্দেরিয়া গ্রাম থেকে জয়রাম, লখন, মহেশরা সকালেই বেরিয়েছিল নেলির খোঁজে। ভোর থেকেই নেলিকে দ্যাখে নি কেউ। অবশষে দিল্লি-মেরঠ এক্সপ্রেসওয়ের ওপর নেলির প্রাণহীন দেহটা খুঁজে পায় তারা। নেলির কানের পিছনে, কষের দু পাশে ছিল শুকিয়ে যাওয়া রক্তধারা।

কিছুদিন আলোড়িত হলেও এই ঘটনা শুধু শহরের প্রান্তে থাকা ওই গ্রামগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। তারপর, সংবাদমাধ্যম, শান্তি কমিটি, প্রশাসনিক ফাইল আর মানুষের ফিসফাস থেকে দূরে এক শুকনো জ্যোৎস্নার ওপর সময়ের ধুলোর পর্দা নেমে আসে ধীরে।

The post জোছনার বালিয়াড়ি appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3lffDFe

No comments:

Post a Comment