Friday, July 30, 2021

বয়েস বাড়ছে বাতাসের দেশে https://ift.tt/eA8V8J

মো. আরিফুল হাসান
ভোরের আলো তখনও সবখানে ছড়িয়ে পড়েনি। কলিমুদ্দি ঘুম থেকে উঠে। পেটটা ভারিরকম চাপ দিয়ে আছে। সোজা সে ছুটে বাথরুমের দিকে। যেতে যেতে আর ধরে রাখতে পারে না। লুঙ্গিটা নষ্ট হয়। কলিমুদ্দি কোনরকম বাথরুমের দরজা ভেজিয়ে কমোডে বসে। শালার পেট খারাপ হওয়ার আর সময় পাইল না! মনে মনে খিস্তি ছাড়ে সে। ঘরে তার বৌ। এখন সে খেয়ে কাজে যাবে। কী কাজ করবে কলিমুদ্দি? সে এখন নিজেও জানে না নতুন সকাল তার জন্য কি কাজ নিয়ে আসবে। সে ঘর থেকে বের হবার সময় পাঁচ-সাতশো টাকাও পকেটে রাখে। সুযোগমতো হলে যেকোনো ব্যবসা শুরু করতে পারবে। এই অল্প টাকাতেও ব্যবসা হয়। বুদ্ধি খাটাইলে এই টাকা থেকেও দুতিনশো টাকা লাভ করা যায়। কলিমুদ্দি প্রায়ই এককাদি কলা কিনে কান্দিরপাড় মোড়ে হেঁটে হেঁটে বিক্রী করতে থাকে। পুলিশ অবশ্য দৌড়ানি টৌরানি দেয়, মাঝে মধ্যে পিটাও দেয়। কিন্তু কি করার? কাজ না থাকলে তাকে তো একটা না একটা কিছু করে দুচার টাকা উপার্জন করতে হবে। জোরে একটি কোঁৎ দেয় কলিমুদ্দি। মনে হয় পেটের ভেতরের নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে যাবে। কলিমুদ্দি মনে করতে পারে না, গতকাল কি এমন খতিকর খেয়েছিলো সে যার জন্য তার আজ পেট খারাপ? গতকালতো সে কাজ পেয়েছিলো। একটা ভাঙা ভবনের রাবিশ সরানোর কাজ করছিলো ওরা সতেরোজন। গায়ে খেটেছে, দুপুরে গরম ভাতের সাথে ডিম ভাজি খেয়েছে। তারপর একটা বিড়ি হাতে আবার লেগে গেছে কাজে। ওরা সতেরো জন। কে কোথাকার তা জানার উপায় নেই। কন্টাক্টর সারাক্ষণ জোকের মতো লেগে থেকে কাজ আদায়ের চেষ্টা করছে। কাজ শতভাগ আদায় হলেও কন্টাক্টরের উনাপেনা শেষ হচ্ছে না। অবশ্য টাকাটাও সাথে সাথে দিয়ে দিয়েছে। ফেরার পথে যখন একটা একহাজার টাকার চকচকে নোট কন্টাক্টার তার চোখের সামনে মেলে ধরলো, তখন প্রায় চোখে জল চলে আসছিলো কলিমুদ্দির।
গ্রামছাড়া শহরে আসা মানুষ কলিমুদ্দি। গা খাটা জীবন তার একরুমের একটি বাসায় বৌ আর নিজের বিপর্যয় ভবিষ্যতের টানাপোড়েন আর লজ্জায় বেচে থাকা। তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে আর কলিমুদ্দিরা জানে যে তারা মানুষ নয় তাই তাদের স্বপ্ন নেই। ফেরবার পথে পাঁচশো গ্রাম খাসির মাংস নিয়ে ফেরে কলিমুদ্দি। বৌ অবশ্য রাধেনি। বলেছে, পত্থম রোজার দিন রাইন্দাম। কলিমুদ্দি কিছু বলেনি। কলমি শাক ছোলার ডালদিয়ে রান্না করা হয়েছে। কলিমুদ্দি তাই খেয়ে শুয়ে পড়ে। সারাদিন বেশ ধকল গিয়েছে তার। একেকটা সময় মনে হয়েছে পিপাসায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু ঘনঘন পানি খাওয়া কন্টাক্টরের বারণ। সে বলেছে, চা নাস্তাপানি একসাথে করবা। কাম ফাঁকি দিয়া পানি বিড়ির নাম কইরা উইঠ্যা গেলে টাকা কম পাইবা। তাই কেউ সহজে উঠতে চায়নি। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই নিজেদের মধ্যে একটি দুটি কথা বলেছে ওরা। কলিমুদ্দির ডান পাশে যে লোকটি কাজ করছিলো তার নাম মমিনউদ্দিন, বাড়ি নোয়াখালি। কলিমুদ্দিন ঝুড়িতে রাবিশ তুলতে তুলতে প্রশ্ন করেছিলো, বাড়ি কই ভাই? নোয়াখালি। কোন জায়গায়? হেনি। ও, আইচ্ছা; আমি কুমিল্লার, বাড়ি মুরাদনগর। মমিনউদ্দিন চোখ না তোলেই জিগায়, বাসা কনে? ধর্মপুর। ধর্মপুর? আইও তো ধর্মপুর থাহি। তারপর আর কোনো কথা হয় না তাদের। কলিমুদ্দিই কথা আগায় না। ঘরে তার নতুন বিয়া করা বৌ আছে। বাসার পদপরিচয় সে যারে তারে দিতে ভয় পায়।

কলিমুদ্দির বৌয়ের নাম জরিনা। গেরস্তঘরের কন্য হইলেও তার বাপের আর গেরস্তি অবশিষ্ট ছিলো না। এখন শেষদশায় এসে নিরুপায় হয়ে মেয়েকে গাখাটা শ্রমিকের কাছে বিয়ে দিতে হয়েছে তাহেরউল্লাহকে। না হলে গেরস্তের মেয়ে অন্তত গেরস্তঘরেই বিয়ে দিতে পারতো। দেখতে শুনতে খারাপ না জরিনা। সুকেশ, চিক্কন দেহ, উন্নত নিতম্ব, দাড়িম্ব স্তনÑ সবই আছে। চোখের ভ্রুতে কাজম জলদ, চোখদুটো তার ডাগর ডাগর, ঠোঁট দুটো তার কমলার কোয়াÑ সবই আছে। শুধু নেই তার পিতার সঙ্গতি। না হলে সবাই বলে, এমন মেয়ে জজ ব্যরিস্টারের বৌ হইলে মানাইতো। শুনে কলিমুদ্দি মুচকি মুচকি হাসে। আবার ভয়ও হয়। সত্তিই যদি কোনো জজব্যরিস্টারের নজরে পড়ে যায় জরিনা, তার আদরের জরিনা, তাহলে সে বাঁচবে? দুজনকে দুজন মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। স্বামীর আর্থিক অবস্থার দৈন্যতা এতটুকু পীড়া দিতে পারে না জরিনার মনে। বরং সারাক্ষণ একটা সুখের হাসি ফুটে থাকে গোলাপ হয়ে, চন্দ্রমল্লিকা হয়ে তার ঠোঁটে ঠোঁটে। স্বামীর যা উপার্জন, তা থেকেই দুটো টাকা সঞ্চয় করার চেষ্টা করে জরিনা। বলে, একদিন আমাগো সব হইবো। সে স্বামীর মাথায় হাত বুলায়। আয়েশে কলিমুদ্দির ঘুম চলে আসে। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছে আজ। জরিনা বুঝতে পারে। সেও ঘুমিয়ে যায়।

বাথরুম থেকে বের হয়ে জরিনাকে ডেকে সবকিছু বলে কলিমুদ্দি। একবারের বাথরুমেই তার শরীর অনেক কাহিল হয়ে গেছে। কাজে যাবার সাহস পাচ্ছে না। তবুও কলিমুদ্দি জানে, কাজে তাকে যেতেই হবে। জরিনা হাতে পায়ে ধরে বারণ করে। কলিমুদ্দি নিষেধ শোনে না। যাবার জন্য তৈরি হয় সে। দেরশো টাকায় কেনা টেট্টনের শার্টটি গায়ে দেয়। গামছাটা কাঁধে চাপায়। ওরা কোদাল নিতে যাবে এমন সময় তার পেট আবার মোচড় মারে। গামছাটা ফেলে আবার দৌঁড়ায় বাথরুমের দিকে। বাথরুমটা ঘরেরই এককোনায় দেয়ালঘেষা। খট করে বাথরুমের ছিটকিনি খুলে ঝড়ের মতো প্রবেশ করে কলিমুদ্দিন। আহারে! এই লুঙ্গিটাও বরবাদ হইলো। করুণ আর্তনাদ ভেসে আসে কলিমুদ্দির কণ্ঠে। এবার সে বের হয় বৌয়ের উড়না পেঁচিয়ে। ওরস্যালাইন আনতে হবে। প্যান্ট পড়তেও ভয় পাচ্ছে সে, যদি এটিও নষ্ট হয়ে যায়! তাহলে তো বিপদ আপদে পড়ার মতো কিছু থাকবে না। কোনোকিছু না ভেবেই সে জরিনাকে বলে তার জন্য স্যালাইন কিনে আনতে এবং এই বলা তার জন্য শেষে কালশাপ হয়।

গ্রামের মেয়ে জরিনা। শহরে এসেছে ছমাসের মতো হলেও স্বামীর সাথে একদুদিন ছাড়া সে কখনো বাসার চৌকাঠ ডিঙায়নি। গলির মোড়ে ওষুধের দোকান থাকলেও সেটি খুঁজে পেতে জরিনার মনে হয় তাকে বিস্তর হয়রান হতে হবে। শেষ পর্যন্ত পেয়ে যায় ওষুধের দোকান। একটি ফর্সা ছেলে বসে আছে দোকানে। বয়েস তার স্বামীর মতোই হবে, ছাব্বিশ কি সাতাশ। কেনো যেনো চোখ ফেরাতে পারে না জরিনা। ওষুধ বিক্রেতা ছেলেটিও অপলক তাকিয়ে থাকে জরিনার দিকে। এই মহল্লায় সে দোকানদারি করছে তিনবছর যাবৎ। এর আগে এতো অপরূপ রূপবতী কাউকে সে কখনো দেখেনি। নিকটেই ভিক্টোরিয়া কলেজ। কতো মেয়ে আসে যায় রোজ। কিন্তু ওষুধ বিক্রেতা ছেলেটির কাছে মনে হয় এর আগে সে এমন রূপসী আর দেখেনি। সে যেচে জরিনার সাথে আলাপ জমাতে চেষ্টা করে। জরিনাও যেনো আলাপ করতে মুখিয়েই ছিলো। স্যালাইন বিনিময় কালে দুজনের অবাধ্য আঙুল ছোঁয়াছুঁয়ি করে ফেলে। এক তড়িৎ ঝড় দুজনের মধ্যেই প্রকম্পিত হয়।

স্যালাইন খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে কলিমুদ্দি। দিনের একটার দিকে তার পেট ধরে যায়। ইতিমধ্যে শুকিয়ে যাওয়া লুঙ্গিটা পরে সে। শার্টের পকেটে একটা পাঁচশো টাকার নোট, দুটো বিশ টাকার নোট ও একটি একশো টাকার নোট নিয়ে সে বের হয়। আজ আর কোনো কাজ পাওয়া যাবে না। কিছু একটা বেচাবিক্রি করেই চলতে হবে। বাসা থেকে হাঁটতে হাঁটতে কলেজ মোড় এসে কলিমুদ্দি দেখে এক জেলে কিছু মাছ নিয়ে বসে আছে। বলছে নদীর মাছ। আসলে নদীর মাছ না, এগুলো প্রোজেক্টের মাছ। কলিমুদ্দি বুঝে, আর এও বুঝে যে পাব্লিকেও এসব মাছ নদীর মাছ বলে কিনবে না। মানুষ এখন এত বেকুব না। কলিমুদ্দি জেলেকে হাক দেয়Ñ মাছ কতো? ষোল্লো শো। কলিমুদ্দি বুঝে, তার গ্যাঁটে এ ব্যবসা কুলোবে না। তবুও একটা বাড়ি মেরে দেখে, পজেক্টের মাছ এতো দামে কেউ কিনবো? ট্যাকা চাইরশো দিবানি। জেলে খিস্তির মতো কিজানি বলে। কলিমুদ্দি দমে না, শেষমেষ ছয়শো টাকা দিয়ে সে মাছগুলো কিনতে চায়। কিন্ত জেলে দিতে চায় না। এমন সময় এক লোক এসে মাছগুলো একহাজার টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যায়। কলিমুদ্দি বিরসবদনে পথ চলে। রেলগেটের কাছে এসে কলিমুদ্দি একবার রেলস্টেশনটা ঘুরে যেতে চায়। ওদিকে অনেককিছু বিক্রি বাট্টা হয়। তার মতো পার্টটাইম ব্যাবসায়ীদের একটা বড় সুযোগ থাকে এখানে দুচার পয়শা উপার্জন করার। কলিমুদ্দিন রেললাইনের কংক্রিটে পা দিয়ে লাত্থি দিতে দিতে চলে। তার মতো লোকের বাঁচার অভাব হয় না। কলিমুদ্দি জানে, পুরুষ মানুষের কোনো কাজের অভাব নেই। তাই সে সময়ের সাথে সাথে যেকোনো কাজেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। একবার বাথরুম পরিষ্কারের কাজেও কিছুদিন নিয়মিত গিয়েছে সে। এখন তো শহরে প্রায়ই ড্রেন পরিষ্কারের কাজে যেতে হয়। এসব এখন গা সওয়া হয়ে গেছে তার।

স্টেশানে সে ছোটখাটো একটা ব্যবসা হাতাতে পারে। এক লোক মাথায় করে একঝাঁকি বড়ই নিয়ে এসেছে বিক্রির জন্য। কলিমুদ্দি সেগুলো তিনশো টাকায় কিনে ফেলে। ঝুড়ির জন্য আরও পঞ্চাশ টাকা দিতে হয় তাকে। অবশ্য দিন শেষে সে ঝুড়িটাও বিক্রি করে যাবে। সুতরাং তার কোনো লস নাই। একটা বড়ই মুখে দেয় কলিমুদ্দি। আহ! রসালো। মিষ্টি যেনো অমৃত! কলিমুদ্দি কাছাকাছি একটা মুদির দোকানে যায়। পনেরো টাকার পলিথিন কিনে দোকানেই মেপেমেপে প্রতি পলিথিনে এককেজি করে ভরে সে। আটটি পলিথিন হওয়ার পর আরও কিছু বড়ই থেকে যায়। কলিমুদ্দি সেগুলো দুইটা পলিথিনে মুড়ে ঝরিনার জন্য রেখে দেয়। আবার সে স্টেশনে চলে আসে। একশো বিশ টাকা কেজি বড়ই হাঁকায়। দুয়েকজন চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা দাম তুলে। কলিমুদ্দি বলে, একটা খাইয়া দেখেন; ট্যাকা দুই শো দিতে মন চাইবো। লোকজন কেউ কেউ ফাও খেতে চায়, কলিমুদ্দি এসব এড়িয়ে চলে। দেখতে দেখতে রেলস্টেশনে কলিমুদ্দির তিন প্যাকেট বড়ই বিক্রি হয়ে যায় একশো টাকা কেজি দরে। তারপর কলিমুদ্দি বাকি বড়ইগুলো নিয়ে রওয়ানা দেয় কান্দিরপাড়ের দিকে। একশো পঞ্চাশ টাকা দাম হাঁকায় এবার।

বিকেল পড়ছে। জরিনার কেনো যেনো মনে হয় তার আবার ফার্মেসিতে যাওয়া দরকার। এবার সে সুন্দর করে সাজে। কপালে একটা টিপ দেয়। এবং অপেক্ষাকৃত সুন্দর জামাটি পরে বের হয়। বরাবরের মতোই দোকানদার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, সেও পলক ফেলতে পারে না। এবার জরিনা দোকানে আসার কোনো নির্দিষ্ট কারন ব্যাখ্যা করতে পারে না। একবার বলে মাথা ধরেছে, একবার বলে পেটের ডানপাশে চিনচিনে ব্যাথা। ওষুধ বিক্রেতা ছেলেটি বুঝে যে কোনো কারন ছাড়াই জরিনা এসেছে তার সাথে দেখা করতে। সে একটি সিভিট ট্যবলেট এগিয়ে দেয় জরিনার দিকে। তারপর বলে, এক্ষুনি খেয়ে ফেলেন। জরিনা পাতা ছিড়ে ট্যাবলেটটি মুখে দেয়। টক–মিষ্টিতে তার মুখ ভরে উঠে। সেদিন আরও অনেক কথা বলে তারা দু’জন। জরিনা বলে, তার একটা বাবুর দরকার। স্বামীর ট্যাকা নাই বলে চিকিৎসা করাতে পারছে না। ওষুধ বিক্রেতা ছেলেটি তাজ্জব হয়ে শোনে। কেমন যেনো একটা অনুরণন টের পায় নিজের ভেতর।

ছেলেটির নাম সোলায়মান। বাড়ি চৌদ্দগ্রামের দিকে। কুমিল্লায় এসে ভিক্টোরিয়ায় ভর্তি হলেও পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে এই নগরবঞ্চিত ক্ষুদ্র আয়ের মানুষদের পশ্চিম ধর্মপুরে একটি গলির মুখে ছোট্ট একটি ফার্মেসি দিয়ে বসেছে। তিনমাসের এলএমএএফ কোর্স করে সে টুকটাক ডাক্তারি বিদ্যার কিছু শিখে নেয়। নিজের কাকার দোকানে ওষুধ বিক্রির কাজ করেও সে কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করে। সঙ্গতি এবং সামর্থের বিচারে সে কলিমুদ্দি থেকে একটু উপরে আর সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে আরেকটু উপরে। জরিনা কী দেখে পাগল হলো বলা যায় না। হয়তো গাঁয়ের মেয়ে সাফসুতরা শাদা ত্বকের রূপ দেখে মজে থাকতে পারে। এমনিতেও সোলায়মান পছন্দ করার মতোই ছেলে। তার দোকানের মালিক তবারক মিয়াঁ অবশ্য আঁড়েঠাঁড়ে জানতে চায় সোলায়মানের গ্রামের বাড়ির অবস্থা সম্পর্কে। সোলায়মান তবারক মিয়ার কথার উদ্দেশ্য বুঝে। কিন্তু সে তবারক মিয়ার মেয়েকে বিয়ে করতে চায় না। কালা ধুমসি মেয়েকে সোলায়মান কেনো বিয়ে করতে চাইবে।

সেদিন কলিমুদ্দি এক অদ্ভুত কাজ করে বসে। জরিনার জন্য রাখা বড়ইগুলো সে একটা মাগীকে দিয়ে আসে। নিজের লাভের তিনশো টাকা এবং পুঁজির দুইশো টাকা মিলিয়ে মোট পাঁচশো টাকা সে গুঁজে দেয় বারনারীর বুকের ভাঁজে। এ কাজ সে কেনো করেছে সে জানে না। শুধু জানে, আজ তার দেখা হয়েছিলো সেদিনের সেই নোয়াখালির শ্রমিক মমিনউদ্দিনের সাথে। তারপর দুজনে দুটো রিক্সায় যার যার দেহবিতান নিয়ে ছুটেছিলো দুদিকে। এই কুমিল্লায় কলিমুদ্দি থাকছে সবমিলিয়ে তিনবছর। বৌ নিয়ে এসেছে তাও হয়ে গেছে ছ’মাস। অথচ এ কাজ সে এর আগে কোনোদিন করেনি। কান্দিরপাড়ে মাগি সস্তা। দুশো তিনশো টাকা দিয়েই পাওয়া যায়। একটু সুন্দরীর দিকে ঝুঁকলে পাঁচ-ছয়শো খরচ হতে পারে। কলিমুদ্দি একটি রিক্সায় চেপে রাজবাড়ী দুধবাজার গেট দিয়ে একটা অন্ধকারমতো কোথায় যেনো ঢুকে যায়। তারপর যখন বেরিয়ে আসে তখন কলিমুদ্দির মেজাজ ফুরফুরে না হয়ে একধরণের ভয় ও পাপবোধ আক্রান্ত হয়। সে নিরুদ্দেশের মতো হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে রেলস্টেশনে এসে দশটাকার বিনিময়ে গণ সৌচাগারে নিজেকে ভালোমতো ধৌত করে সে। কিন্তু তার গায়ের ময়লা যেনো দূর হয় না। আসার সময় দশ টাকা দিয়ে একটি সাবান কিনে এনেছে, প্রায় সবটা ঘষে ফেললেও তার মনে হতে থাকে তার গায়ে লেগে আছে থোকা থোকা ময়লা। সকালের বাথরুমের কথা তার মনে হয়। মনে হয়, পরপর দুটি লুঙ্গি ভরে গিয়ে এখন যেনো থোকা থোকা মল তার দেহে অমোছনীয় হয়ে সেঁটে রয়েছে। বাইরে থেকে কেউ দরাম দরাম দরজায় ধাক্কাচ্ছে। সম্বিৎ ফিরে পায় কলিমউদ্দি। দিগম্বর দেহটা গামছায় মুছে লুঙ্গিটা পরে বেরিয়ে আসে। তারপর স্টেশনের একটি চায়ের দোকানে রাত বারোটা পর্যন্ত বসে থেকে বাসায় ফেরে।

পরদিন সকালে প্রথম রমজানে রান্না করার জন্য রেখে দেয়া আধা কেজি ছাগলের মাংস রান্না করে ফেলে জরিনা। কলিমুদ্দি তাজ্জব হলেও মনে মনে খুশি হয়। সাধারণত বৌয়েরা ভালোমন্দ কিছু রান্না করে তার স্বামির প্রতি ভালোবাসার বহিপ্রকাশ থেকেই। কলিমুদ্দি মনে মনে নিয়ত করে, রমজানের আগে সে আবারও আধাকেজি খাসির মাংস কিনে আনবে। আজ পেটপুট সব কিলিয়ার। কোনো গ-গোল নাই। কলিমুদ্দি খুশি মনে ভাত খেতে বসে। কিন্তু খেতে বসে কলিমুদ্দির মনে হয় তার স্ত্রী তাকে ঠিকমতো মাংসটা তুলে দিচ্ছে না পাতে। মুখ ফুটে বলতে গেলেও লজ্জা পেলো কলিমুদ্দি। সে ঝোল–আলু মিলিয়ে কোনোরকম ভাত খেয়ে উঠলো। মনে মনে ভাবলো, হয়তো তার স্ত্রীর সংযমী পরিকল্পনা তরকারিটা দিয়ে দুতিনদিন চালিয়ে দিবে। মনে মনে একপশলা খুশিও হলো সে। যা হোক, নিজের মনের পাপবোধ, তরকারি সংক্রান্ত দ্বিধা, আর কাজে যাবার তাড়াহুড়া তাকে জরিনার কাছ থেকে বিদায় নিতে ভুলিয়ে দেয়। এই প্রথম সে ঘর থেকে বের হলো জরিনাকে না বলে। জরিনার অবশ্য এ জন্যে কোনো মন খারাপ হয়নি। সে দুপুরের জন্য সোলায়মানকে আমন্ত্রণ করে রেখেছে।

সেদিন দুপুরে জরিনা ও সোলায়মান একসঙ্গে খেলো। তবে তারা ভাত কিংবা তরকারী কিছুই খায়নি। আদিম পাপের বাহন যে গন্ধম, সেদিন দুপুরে তারা দুজন সেই ফুলে সর্বনাশ হয়ে গেলো। তারপর রাত করে বাড়ি আসলে কলিমুদ্দি কড়াইয়ের ঢাকনা খোলে সবটা তরকারি দেখতে পেয়ে স্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় মনে মনে। আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। মহল্লার কেউও এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ করে না কারন ডাক্তার তো যে কারো ঘরেই আসতে পারে। তাছাড়া ঠিক দুপুরের সময় সোলায়মান কার ঘরে প্রবেশ করলো, কে কার ঘরের দরোজা খুলে দিলো এসব দেখার খুব কম অবসরই এখন মানুষের আছে। তারও সাতদিন পর, চৌদ্দদিন পর, যখন রাত পোহালেই প্রথম রোজা আর একদিন, সেই দিন রাতে কলিমুদ্দি জরিনাকে আদর করতে উদ্যত হলে জরিনা না করে। সে জানায়, ডেইট অভার হইছে তিনদিন। কলিমুদ্দি হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না। তবে জরিনা বুঝতে পারে, বৈধ হোক আর অবৈধ হোক, পেটের মধ্যে একটাকিছুর বয়েস বাড়ছে বাতাসের দেশে।

The post বয়েস বাড়ছে বাতাসের দেশে appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/2WCUxGu

No comments:

Post a Comment