অরূপ কুমার দেবনাথ
‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো-ইনশাল্লাহ্’-৭ মার্চ ১৯৭১ খ্রি:। ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিকামী বাঙ্গালির উত্তাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আর সে ঘটনা টা ঠিকই ঘটেছে। ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ খ্রি:। মাত্র ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে জাতিবিদ্বেষী অগণতান্ত্রিক ও অসামাজিক শোসন-জুলুম-দু:শাসনে ভরা সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি পরাধীনতা থেকে মুক্তি অর্জন করেছি আমরা। আর যা সহজে আসেনি। এর জন্য গুনতে হয়েছে অকল্পনীয় চড়া মূল্য যার মধ্যে রয়েছে-ত্রিশ লাখ তাজা প্রাণ, কয়েক লক্ষ মা-বোনের অমূল্য সম্ভ্রম, লুটপাটে যথাসর্বস্বহারা কোটি মানুষের দেশান্তর, হাজার হাজার হিন্দুর জবরদস্তি ধর্মান্তর, এক সাগর রক্ত ।
মূলত: আমাদের মাতৃভাষা ‘বাংলা’র মর্যাদা রক্ষার অসাম্প্রদায়িক গণআন্দোলনের সাফল্য থেকে শুরু হওয়া ধারাবাহিক প্রতিবাদী আন্দোলন ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল অনুপ্রেরণা। আর ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতিয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারাবদ্ধ এ মহাযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখেছি পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামীলীগ, কমিউনিষ্ট পার্টি, ন্যাপ, কংগ্রেস প্রভৃতি দলের অসাম্প্রদায়িক নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ মরণপণ সক্রিয় ভুমিকা। বলাবাহুল্য যে, স্বাধীনতা নয়-স্বায়ত্বশাসনকামী কিছু আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মী আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে কেবল বিরত ছিলেন না-তারা পাকিস্তান কায়েম রাখতে ঘরে-বাইরে নিরেট পাকিপ্রেমি ভুমিকায় সক্রিয় ছিলেন।
২৫ মার্চ ১৯৭১ খ্রি:। গভীর রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বাঙ্গালি নিধনযজ্ঞ শুরুর পরপরই ২৬ মার্চ শুরুর রাতেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এদিন শেষরাতে হানাদারদের হাতে বন্দি হলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত হল সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ-এর নেতৃত্বাধীন ভারত প্রবাসী স্বাধীনবাংলা সরকারের উপর। তবে এলাকা ভিত্তিক কমান্ডার পদে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া পাকিস্তানি আর্মির দলত্যাগী বাঙালি অফিসারদের কয়েকজনের সাথে স্বাধীনবাংলা সরকারের মাননীয় মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের যৌথ স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্ত ফাঁস হলে পর তাদেরকে বিশেষ নজরদারীতে রাখা হয়। সাথে সাথে ভারতের সমরবিশারদ ও স্বশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যক্ষ সাহায্য-সহযোগীতায় মুক্তিবাহিনীর সমান্তরালে তাৎক্ষণিকভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বাধীনে গঠন করা হয় সশস্ত্র মুজিব বাহিনী। এরপর এ বাহিনীকে পাক হানাদার বিরোধী মুক্তিযুদ্ধে দেশের সকল রণাঙ্গনে দ্রুত মোতায়েন নিশ্চিত করেন দেশ বরেণ্য নজরুল-তাজ উদ্দীনের স্বাধীনবাংলা সরকার। আর যার মূখ্য ভুমিকায় ছিলেন স্বাধীন বাংলা সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ স্বয়ং। ভেস্তে যায় মোস্তাক গং-এর স্বাধীনতা বিরোধী প্রথম ষড়যন্ত্র।
০৩ নভেম্বর ১৯৭১ খ্রি:। ভারতের বিরুদ্ধে সর্বহারা কোটি বাঙ্গালির ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেয়া, কুটনৈতিক আক্রমনে বিশ্ব দরবারে পাকিস্তানকে বিব্রত ও কোনঠাসা করে ফেলা, স্বাধীন বাংলা সরকারকে নিরাপদ আশ্রয় দেয়া, বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও সামরিক সহায়তা দেয়া ইত্যাদি অভিযোগ তুলে দেশটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল পাকিস্তানী শাসকজান্তা। এ দিন রাতের আঁধারেই দেশটির উপর হামলা শুরু করল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যেমনটা করেছিল ২৫ মার্চ’৭১ আমাদের দেশে।
৪ নভেম্বর ১৯৭১ খ্রি:। পাল্টা সামরিক জবাব শুরু করল ভারতীয় স্বশস্ত্র বাহিনী। পূর্ব-পশ্চিম উভয় রনাঙ্গণে ভারতীয় বাহিনীর প্রচন্ড আকাশ, নৌ ও স্থল আক্রমণে দেখতে দেখতে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল। সে যুদ্ধ শুরুর মাত্র ১২ দিনের মাথায় ১৬-ডিসেম্বর আমাদের স্বদেশীয় রাজাকার, মুজাহিদ, আলবদর, পিস কমিটি ইত্যাদি শত্রুবাহিনীসহ এ দেশীয় অগণিত বেঈমান পাকিস্তানপ্রেমির ভরসার বাতি নিভিয়ে দিয়ে বেঁচে থাকা সকল কমান্ডিং অফিসারসহ ৯০,০০০ নাস্তানাবুদ পাকিস্তানী আর্মি ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে নতশিরে আত্মসমর্পণে বাধ্য হল। প্রতিষ্ঠিত হলো কাক্সিক্ষত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। তবে এর পরও থেমে থাকেনি কুটকৌশলে পূনর্বাসিত হওয়া স্বাধীনতাবিরোধী বেঈমানদের প্রতিশোধের লিপ্সা ও রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ খ্রি:। পাকিস্তানী বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন ও দিল্লী হয়ে স্বাধীনবাংলায় ফিরে এলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের দায়িত্বভারও হাতে নিলেন। আর এ বছরেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দেশের জন্য লাখ শহিদের একান্ত আকাঙ্খা স্বাধীনতাসংগ্রামের মৌলিক চেতনাভিত্তিক জাতীয় সংবিধান রচনা ও তা প্রতিষ্ঠা করেন। তবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে স্থান পাওয়া মাননীয় মন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক ও তার সাম্প্রদায়িক অনুসারিদের ছলাকলায় সম্মোহিত হয়ে ভুল করে নিজের অজান্তেই স্বাধীনতার মৌলিক চেতনায় বিশ্বাসী একান্ত অনুগত দের দূরে ঠেলে দিয়ে নিজের ও তাঁর পরিবারের এমনকি দেশের জন্যও ভয়ানক পরিণতির পথ সুগম করলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানি হিন্দুবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক কালাকানুন ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ বাতিলের পরিবর্তে ‘অনাবাসী ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি আইন’ বলবৎ করে হিন্দুর ভাগ্যবিড়ম্বনা বাড়ানো হলো। অন্য ধর্মাবলম্বিদের চাহিদা বাদ রেখে কেবল ‘ইসলামি ফাউন্ডেশন’ গঠন করা হলো। শুধুমাত্র আরবি ও ইসলামধর্মীয় শিক্ষা বিস্তারে স্বতন্ত্র মাদ্রাসা বোর্ড গঠন করা হল। ধর্মনিরপেক্ষ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ‘ও.আই.সি.’-এর সদস্য হলো। উপরন্তু লাখ শহিদের রক্তে ভেজা মাটি শুকাতে না শুকাতে, সম্ভ্রমহারা হাজারো মা-বোনের বেদনা প্রশমিত হতে না হতে ৭১-এর মুক্তিপাগল কোটি মানুষকে হতবাক করে সংগঠনটির মিটিংয়ে যোগ দিতে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু গেলেন পাকিস্তানে। ৭১-এ বাঙালি নিধনযজ্ঞের অন্যতম হোতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ কুশল বিনিময় সবই করলেন তিনি। এতসবের পরও আমাদের স্বাধীনতার মৌলিক চেতনা বিরোধী পাকিস্তানি মদদপুষ্ট মোস্তাক গং- এর হাত থেকে নিস্তার পাননি কিন্তু বঙ্গবন্ধু। ঘটে গেল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর অবিস্মরণীয় ট্রাজেডি! মূলত তৎকালিন সময়ে বঙ্গবন্ধু বাদে অন্য কারুর পক্ষে যে কাজটা করা সম্ভব ছিল না পর্যায়ক্রমে সেটুকু হাসিলের পর পথের কাঁটা দুর করতেই তাঁকে হত্যা করা। যে ভুট্টোকে বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন উষ্ণ আলিঙ্গণ সে-ই ইসলামের মৌলিক আদর্শে বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধুকে ইসলামের শত্রু আখ্যাদিয়ে তাঁর অইসলামিক হত্যাকান্ডকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন অকপটে। এরপর পাকিস্তানের পরামর্শে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার স্বপ্নকে দু:স্বপ্নে পরিণত করতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করা হল মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিচালক দেশবরেণ্য চার জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জমান ও ক্যাপটেন মনসুর আলীকে। শুরু হলো মহান মক্তিযুদ্ধের চেতনা ও তার ধারকদের নির্মূল অভিযান যা এখনও বহমান।
বয়সের ভারে হোক বা দলীয় স্বার্থ বিবেচনায় হোক বা ক্ষমতা ধরে রাখার প্রশ্নে হোক আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা হয়তো সে ইতিহাস ঠিকমত স্মরণে রাখতে পারছেন না। আর তাই হয়তো দেশে সক্রিয় ৭৫-এর ঘাতকচক্রের উত্তরসুরী ইসলামি মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দল/গোষ্ঠির অব্যাহত সংখ্যালঘু নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হত্যা, ধর্ষণ, লুট-পাট, অগ্নিসংযোগ, মন্দির, প্রতিমা, পূরাকীর্তি গুড়িয়ে দেয়া, পূজাপার্বনে বাধা দেয়া ইত্যাদি মানবতাবিরোধী জঘণ্যতম অপরাধ দমনে ক্ষমতাসীন তাঁর দল ও সরকার দেখা দৃষ্টে যথেষ্ট উদাসীন। তবে ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা চলতি বছরে বিশেষকরে শ্রীশ্রী দূর্গাপূজা অনুষ্ঠানকালীন ইসলামী মৌলবাদীদের বিভীষিকাময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনাপ্রবাহকে স্বীকার করে বলেছেন তিনি তাঁর পিতার ভুলের পূনরাবৃত্তি হতে দেবেন না-সকল ঘৃণ্য জঘণ্য অপরাধের সুষ্ঠু তদন্তসহ দ্রুত বিচার নিশ্চিত করবেন। পক্ষান্তরে দেশের মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় শোনালেন উল্টো নিরাশা ও আতঙ্কের বাণী। তার ভাষায় সবকিছু বানোয়াট, মিডিয়ার সৃষ্টি অতিরঞ্জিত অপপ্রচার ও দেশ বিরোধি চক্রান্ত। আবার এবারের সংঘটিত নারকীয় সাম্প্রদায়িক হামলা, খুন, ধর্ষণ, লুট, জ্বালাও-পোড়াও চলাকালিন হিন্দুরা বর্তমান সরকারের অন্যতম কৃতিত্ব অপরাধ দমন ও জননিরাপত্তা দ্রুত নিশ্চিতের প্রশ্নে চালু করা ‘৯৯৯’ সেবা না পাওয়া প্রসংঙ্গে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় শুনালেন এ সেবার অধিকতর সংস্কার ও দ্রুত উন্নয়নের কথা। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামার বিষয়ে মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-হিন্দু নির্বিশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী অন্যদের সাথে দেশের খোদ সরকারদলীয় কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান মাননীয় মন্ত্রী-এমপি, নেতানেত্রী, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রকাশ্য অভিযোগের আঙ্গুল কমবেশি নিজদল ও সরকারের দিকেই। তাঁদের কথায় বিগত এক দশকে সাতক্ষীরার ফতেপুর, রামু, নাসির নগর, শাল্লা, কুমিল্লা, নোয়াখালি, চাঁদপুরসহ সারাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর যে সকল পরিকল্পিত আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে সেসবের বিচার না হওয়াসহ ধামাচাপা দেয়ার অব্যাহত অপচেষ্টার কারণে পবিত্র ইসলাম ধর্মের মৌলিক আদর্শ ও শিক্ষা বিরোধি ক্ষমতাসীনদলের বেশকিছু নেতা-কর্মীসহ মৌলবদী মুসলিমস মাজ আজ দেশে এমন অঘটন ঘটাতে উৎসাহিত হচ্ছে। এখন দেশের এ অসাম্প্রদায়িক ঐক্যের অভিন্ন দাবী ৭২-এর সংবিধান পূনর্বহাল যা করার জন্য দেশের উচ্চ ন্যায়ালয়েরও নির্দেশ রয়েছে। আর লাখো শহিদের সপ্নের সোনারবাংলা গড়ার প্রশ্নে এটাই বিকল্পহীন একমাত্র সোপান।
এখন দেখার বিষয়, স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায় যেভাবেই হোক না কেন যে বা যারা জননিরাপত্তা ও সংবিধানের মৌলিক ধারা অক্ষুণœ রাখতে ব্যর্থ এবং সরকারী দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে গাফিলতি করেছেন বা মিথ্যাচার করছেন অথবা শপথ ভঙ্গ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে সরকার ও বিচারবিভাগ কী ব্যবস্থা নেন। পাশাপাশি তাঁর পিতা ও আমাদের জাতির পিতা যে ভুলের নির্মম বলি হয়েছেন তার পূনরাবৃত্তি রোধে আমাদের দেশনেত্রী শেখ হাসিনা কী পদক্ষেপ নেন তাও দেখার অপেক্ষায় আছি আমরা।
The post স্বাধীন বাংলায় অবরুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ! appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3p2PJ7V
No comments:
Post a Comment