মৌচাকে ঢিল।।
গত ১ জুন আমার স্ত্রীর করোনা শনাক্ত হয়। দীর্ঘ ২০ দিন বাড়িতেই আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নেওয়ার পর ২০ জুন সে করোনা মুক্ত হয়।
এর মাত্র ১০ দিন পর ১ জুলাই আমার করোনা শনাক্ত হয়। বর্তমানে বাড়িতেই আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করছি।
অসুস্থ শরীর নিয়ে লিখতে বসেছি আমাদের দুজনের করোনা আক্রান্ত হওয়া, পরীক্ষা করা এবং বর্তমানে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য লকডাউন প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু উপলদ্ধি শেয়ার করার জন্য।
আসলে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য চলমান ‘লকডাউন প্রক্রিয়া’র মাধ্যমে আম জনতাকে ঘরে রাখার প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা বোধ হয় উল্টো পথে হাটছি এবং এই উল্টো পথ সোজা করতে না পারলে হয়তো করোনা সংক্রমণ কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
একটু সহজ করে বাস্তবতার নিরিখে বললে বুঝতে সুবিধা হবে।
আমার স্ত্রীর ৩১ মে নাকের ঘ্রাণ চলে যায় এবং অসুস্থতা বোধ করতে শুরু করে। আমরা ১ জুন ইজিবাইকে করে করোনা পরীক্ষা করতে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যায়। টিকিট কেটে লাইনে দাড়িয়ে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে দুপুর ১টা নাগাদ আবার লাইনে দাড়িয়ে স্যাম্পল দিতে সক্ষম হয়। ৩ জুন মোবাইলে ম্যাসেজ পায় পজিটিভ।
করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিয়ে ইজিবাইকে করে হাসপাতালে যাওয়া, তারপর তার জন্য আমি নিজেই অন্যান্য করোনা রোগীদের সাথে লাইনে দাড়িয়ে তাকে স্যাম্পল দেওয়ায়। একজন করোনা রোগী কতজনকে আক্রান্ত করতে পারে, তা আপনাদের নিশ্চয় জানা*** (মার্কড)।
এবার আসি, আমার নিজের কথায়। ৩০ জুন দুপুরের পর থেকে হঠাৎ শরীরে জ¦র জ¦র অনুভব করি। সঙ্গে কাশি। এলার্জিজনিত কাশিটা আমার দীর্ঘদিনের। কিন্তু এবারের কাশির ধরণটা কষ্টদায়ক, কাশির সঙ্গে বুকে যেন চাপ অনুভব করতে থাকলাম। বিকালেই বাড়িতে বিষয়টি শেয়ার করে আইসোলেশনে গেলাম এবং ১ জুন সকালে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে গিয়ে র্যাপিড এন্টিজেন পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে করোনা আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হলাম। এসময় প্রচুর মানুষকে দেখেছি যারা দূর দূরান্ত থেকে করোনা টেস্ট করাতে এসেছেন রাস্তার যানবাহন চড়ে, যা করোনা আক্রান্ত বা সুস্থ অগণিত মানুষ ব্যবহার করছে প্রতিদিন।
যাইহোক, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী যাবতীয় ওষুধপত্র কিনে বাড়ি পৌঁছে নিজের জন্য নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশ করে সেখানেই আছি এবং নিয়মিত ওষুধ সেবন, গরম পানির গড়গড়া ও মসল্যা পানির ভাব নিচ্ছি।
রাস্তার গাড়িতে করে করোনা পরীক্ষা করতে যাওয়া, অন্যান্যদের সাথে মিশে ওষুধপত্র কিনে রাস্তার গাড়িতেই বাড়ি ফেরা *** (মার্কড)।
করোনার উপসর্গধারী ও করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য বাড়ির বাইরে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা রেখে আম জনতাকে ঘরে থাকতে বলার কোন মানে নেই।
বাড়ি থেকে নরমালি না বের হলেও বাজার সদায়দের জন্য একবার হলেও বের হতে হচ্ছে। যারা বাজারের বিক্রেতা তাদের প্রতিদিন বের হতে হচ্ছে। ঘরে রাখার চেষ্টা করলেও ভ্যান রিক্সা ইজিবাইক চালকরা পেটের দায়ে বের হচ্ছে।
আবার তারা বের না হলে যারা করোনা পরীক্ষা করতে যাচ্ছে তারাই বা কিসে চড়ে হাসপাতালে যাবে। মানে করোনা উপসর্গধারী বা আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে ভ্যান রিক্সা ইজিবাইক বা অন্যান্য যানবাহনের চাহিদা ও যোগানের সম্পর্কও বিদ্যমান।
তাই আগেই বলেছি করোনার উপসর্গধারী ও করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য বাড়ির বাইরে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা রেখে আম জনতাকে ঘরে থাকতে বলার কোন মানে নেই। তাতে সংক্রমণ কমার কোন সুযোগ নেই। বরং বাড়ছে বহুগুণে। আর লকডাউন যে মানুষ আর মেনে পারছে না, তাও নিশ্চয় আপনারা বুঝে গেছেন। কারণ পেটের জ¦ালা বড় জ¦ালা। বউ বাচ্চা নিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষগুলো কিভাবে জীবন ধারণ করছে, তা নিশ্চয় অনুমেয়।
এবার আসি মূল কথায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রমণ রোধে আসলে কি করা উচিত?
প্রথমত, করোনার উপসর্গধারী বা আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে পরীক্ষা করাবে কিভাবে?
জেলা শহরে ১৫-২০টি, উপজেলা শহরগুলোতে ১০টি করে মাইক্রোবাস বা প্রাইভেট কার বা মাহিন্দ্রা রিকুইজিশন দিয়ে পর্যাপ্ত র্যাপিড এন্টিজেন কীট (দৈনিক ২০০০) স্টকে রাখুন। জেলা শহর এবং উপজেলার জন্য একাধিক হটলাইন নাম্বার প্রচার করুন। ফোন পাওয়া মাত্র বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ ও তাৎক্ষণিক পরীক্ষার ফলাফল দিন। রোগীকে নির্দিষ্ট চিকিৎসকের নাম্বার দিন, ম্যাসেজের মাধ্যমে ব্যবস্থাপত্র ও স্বেচ্ছাসেবকদের ফোন নাম্বার দিন। রোগীকে স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে নিজ খরচে ওষুধ ক্রয়ের জন্য উৎসাহিত করুন। ইতোমধ্যে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা অক্সিজেন সরবরাহ করে দৃষ্টান্ত রেখেছে। আমার বিশ^াস তারা ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী রোগীর পরিবারের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ পূর্বক ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যদি ক্রয় করে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারবে।
প্রশ্ন থাকতে পারে, যাদের হাসপাতালে নিতে হবে, তাদের ক্ষেত্রে কি হবে? সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রোগী তার ব্যবস্থাপত্র করে দেওয়া চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত বাড়ি থেকে বের হবেন না। এবং হাসপাতালে যাওয়ার ক্ষেত্রেও সরকারি ব্যবস্থা অর্থাৎ অ্যাম্বুলেন্স বা আলাদা যে কোন রিজার্ভ গাড়ি ব্যতীত হাসপাতালে যাবেন না। অর্থাৎ রোগীকে যেন রাস্তার গাড়ি ব্যবহার না করতে হয়।
এখনও পর্যন্ত একটা বড় অংশ করোনা রোগী তো বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছে। এখন শুধু করোনার উপসর্গধারী বা আক্রান্ত রোগীদের বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে।
এটা করা সম্ভব হলে, করোনার উপসর্গধারী বা আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে বাইরের কেউ আর আক্রান্ত হবে না। এটা নিশ্চয় আপনারা জানেন যে, করোনার উপসর্গধারী বা আক্রান্ত ব্যক্তি ব্যতীত কারো দ্বারা তো কেউ করোনা আক্রান্ত হয় না।
এই উদ্যোগ নিতে হবে অত্যন্ত বড় পরিসরে। কেউ যেন হট নাম্বারে ফোন করে বিজি না পায়, ফোন করার আধাঘণ্টার মধ্যে রোগীর বাড়িতে মেডিকেল টিম চাই। এই মহামারী রোধে স্বাস্থ্যবিভাগকে ফাটা কেস্ট হওয়ার বিকল্প নেই।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, এখন করোনা আক্রান্ত রোগীদের বাড়ি লকডাউন করা হচ্ছে, রোগী হাসপাতালে গিয়ে স্যাম্পল দিয়ে পজিটিভ হওয়ার পর। ততক্ষণে কতজনকে যে আক্রান্ত করছে, তার হিসাব থাকছে না।
দ্বিতীয়ত, সবকিছু (বাজার) চালু রেখে লকডাউন কার্যকর হবে না। এছাড়া সারাবছর লকডাউন চললে তা আম জনতাকে মানানোও কঠিন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের গাড়ির হুইসেল শুনে শার্টার বন্ধ করা, গাড়ি চলে গেলে, আবার খুলে রাখার খেলা চলছে বহুদিন। দৈনিক শত শত অভিযান চালিয়েও বিধি নিষেধ কার্যক্রর করা যাচ্ছে না। মানুষ ঘরে খাবার না থাকায় প্রশাসনের কোন কথা শুনতে চাচ্ছে না।
বেচাবিক্রি কমলেও তারা দোকান খুলে বসতে চায়। যদি দু’টাকার বেচাকেনা হয়, সেই আশায়।
এমতাবস্থায় করোনার উপসর্গধারী ও করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে লকডাউন দিন মাত্র এক সপ্তাহের। তবে, এই লকডাউন হবে স্কুল-কলেজ বন্ধের মতো লকডাউন। অর্থাৎ সববন্ধ- প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা উইং এবং স্বাস্থ্য বিভাগ ব্যতীত সব বন্ধ।
বাজার খোলা থাকলে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিও যে বাজার করতে যায়, তাতো সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি হওয়ার পর প্রমাণ পেয়েছিলেন, তাই না?
অর্থাৎ বর্তমানে করোনা সংক্রমণ রোধের প্রাথমিক শর্ত, বাড়ি বাড়ি যেয়ে স্যাম্পল ক্যালেকশন, ফলাফল ও চিকিৎসাপত্র প্রদান এবং স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে ওষুধপত্র সরবরাহ। দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত শর্ত, স্বল্প সময়ের জন্য (এক সপ্তাহ) স্কুল কলেজ বন্ধের মতো বাজার বন্ধ করে দেওয়া, তাহলে যদি লকডাউন কার্যকর হয়, সংক্রমণ কমে?
(মৌচাকে ঢিল, লেখকের ছদ্মনাম)
২.৭.২০২১
The post করোনা সংক্রমণ কমবে না, যদি…………. appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3dyiFje
No comments:
Post a Comment