পত্রদূত রিপোর্ট: ঘড়ির কাটা সবে সন্ধ্যা সাতটার ঘর ছুঁই ছুঁই। শ্যামনগর উপজেলা সদরে দুরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস কাউন্টারে শত শত মানুষের ভিড়। সকলেই প্রায় অপেক্ষমান ঢাকা ও বরিশালগামী বাসের জন্য। বিশেষ একটি কোম্পানীর বাস কাউন্টারে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে লম্বা বেঞ্চের শেষ প্রান্তে বসা এগার/বার বছরের এক শিশু।
সামনে যেয়ে দাঁড়াতেই উৎসুক দু’চোখ মেলে তাকিয়ে তাকে ফ্যাল ফ্যাল করে। নাম জানতে চাইলে অনুমতির অপেক্ষায় পাশের বেঞ্চে বসা বছর ত্রিশের এক যুবকের পানে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বার নাম জানতে চাইলেও অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটে না।
এক পর্যায়ে পাশের বেঞ্চে বসা ঐ যুবকের শিখিয়ে দেয়া বুলি আওড়িয়ে শিশুটি নিজের নাম আবু সাইদ বলে জানায়। পিতার নাম জানতে চাইলে একই যুবকের দিকে ইঙ্গিত করে সে। শিশুটির একেবারে পাশ ঘেষে বসা অপর তরুন পাশের বেঞ্চে থাকা যুবককে শিশুটির পিতা বলে জানিয়ে দেয়। এসময় চটপটে স্বভাবের ঐ তরুন আরও জানায় পিতার সাথে শিশুটি ইট ভাটার কাজ করতে বরিশাল যাচ্ছে।
অবস্থান পরিবর্তন করে পাশের বেঞ্চে বসা যুবকের সামনে যেয়ে নাম জানতে চাইলে নিজেকে সামছুর রহমান পরিচয় দিয়ে বাড়ি শ্যামনগর উপজেলার কাঠামারি গ্রামে বলে জানায়। আবু সাইদকে নিজের পুত্র জানিয়ে তিনি বলেন কাঠামারির শ্রমিক সর্দার আব্দুল্লাহ আল মামুন বাবু ও ইউসুফ হোসেন মালিকের সাথে চল্লিশ হাজার টাকা চুক্তিতে শিশুটিকে ইট ভাটায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে।
পড়ালেখা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে সামছুর রহমান জানান তার ছেলে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। তবে শিশু আবু সাইদ জানায় ৮৬ নং পরানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেনীতে সে লেখাপড়া করে।
কথাবর্তায় দু’জনের বিস্তর গরমিল থাকায় এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায় শিশুটি নিজের নাম সঠিক বললেও শ্রমিক সর্দারের শেখানো বুলি আওড়িয়ে সঙ্গী হওয়া যুবককে পিতা হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। কাঠামারী গ্রামের মো. সোহরাব হোসেন শিশু আবু সাইদের প্রকৃত পিতা। দরিদ্র পরিবারের হওয়ায় স্থানীয় শ্রমিক সর্দার আব্দুল্লাহ আল মামুন বাবু ও ইউসুফ হোসেন সহজেই টোপ গেলাতে সক্ষম হয় পরিবারটিকে। মাত্র চল্লিশ হাজার টাকায় ইট ভাটায় যেয়ে ইট উল্টানোসহ পানি টানার কাজ করতে হবে তাকে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায় ২০১৯ সালে ৮৬ নং পরানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ন হয় সে। পরবর্তীতে শ্যামনগর উপজেলা সদরের শ্যামনগর হাফিজিয়া মাদ্রাসায় মিজান জামাত (৬ষ্ঠ শ্রেণি) এ ভর্তি হয় আবু সাইদ। তবে পারিবারিক অস্বচ্ছলতা আর সাংসারিক টানাপোড়নের শিকার শিশুটির পিতা-মাতাকে ফুঁসলিয়ে শ্রমিক সর্দাররা আবু সাইদকে ছয় মাসের জন্য ইটের ভাটায় কাজের জন্য মালিকের ‘হাওলা’ করে দিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে শ্রমিক সর্দার আব্দুল্লাহ আল মামুন বাবু জানান, শ্যামনগরের সকল শ্রমিক সর্দারই শিশুদের দেশের বিভিন্ন অংশের ইটভাটায় কাজে পাঠাচ্ছে। শিশু শ্রমিক তুলনামুলক সস্তা হওয়ার পাশাপাশি তারা কাজ নিয়ে খুব বেশী উচ্চবাচ্য করার চেষ্টা না করায় ভাটাসমুহে শিশু শ্রমিকের চাহিদা বেশি বলেও সে জানায়। আব্দুল্লাহ আল মামুন আর বলেন, ‘ভাই আমার নাম পরিচয় আর এ শিশুকে নিয়ে কিছু কইরেন না, তাহলে আমি আপনাকে আরও অন্তত পঞ্চাশ জনেরও বেশি শিশুকে ইটেরভাটায় পাঠানোর তথ্য দেব।’
শিশু আবু সাইদের বিষয়ে মালিকের সাথে মুল চুক্তি সম্পাদনকারী শ্রমিক সর্দার ইউসুফ হোসেন বলেন, বরিশালের মুলাদী উপজেলায় এক এসপি (পুলিশ সুপার) সাহেবের ইটেরভাটায় পাঠাইছি তাকে। ‘কয়েক দিন পরে ফিরে আসবে’-উল্লেখ করে ইউসুফ হোসেন আরও বলেন, ভাই আমি পরের টিপে যখন শ্রমিক পাঠাবো শ্যামনগরে যেয়ে আপনার সাথে বসে চা খাবো’।
তবে শুধু আবু সাইদ নয়। বরং প্রতিদিনই শ্যামনগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা কৌশলে শত শত শিশুকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইটের ভাটায় কাজ করতে পাঠাচ্ছে নিরাপদ দুরত্বে থাকা শ্রমিক সর্দাররা। অনেক সময় প্রশাসনের চোখ এড়াতে রিজার্ভ বাসের পরবির্তে ভিন্ন কৌশলে এসব শিশুকে নিয়ে পৌছে দেয়া হচ্ছে নির্দিষ্ট ইটের ভাটাসমুহে।
এদিকে ইটের ভাটায় শিশু শ্রমিক নিযুক্ত করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে সিডিইও ইয়ুথ টিমের পরিচালক আল ইমরান জানান, এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। প্রশাসনের চোখ এড়াতে ভিন্ন ভিন্ন পরিবহনে কৌশলে শিশুদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ইটেরভাটায় শিশু শ্রমিক প্রেরণ নিরুৎসাহিত করতে হলে বিভিন্ন এলাকার ইটেরভাটায় প্রশাসনের আকস্মিক অভিযান পরিচালনার বিকল্প নেই।
The post ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রকে ইটভাটার কাজে নিয়ে গেলেন শ্রমিক সর্দার বাবু ও ইউসুফ appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/2Jyb7Rr
No comments:
Post a Comment