মাওলানা মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ
(পর্ব ষষ্ঠ)
মুহাম্মদ (সা.) একজন সতর্ককারী ও রাসুল মাত্র: মানবতার মুক্তির সর্বশেষ প্রেরিত দূত হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মানুষের জন্য একজন সতর্ককারী রাসুলমাত্র। কাউকে প্রতিঘাত সৃষ্টিকরে জোরপূর্বক দ্বীনের মধ্যে ঢুকানো রাসুলের জন্য শোভনীয় নয়। বিশ্বনবী (সা.) গোটা ২৩ বছরের নবুওয়াতী সময়ে ইতিহাসের কোন গ্রন্থে মিলবে না যে তিনি কাউকে জেরপূর্বক জবরদখল করে ইসলামের গন্ডিতে প্রবেশ করিয়েছেন। বরং তিনি ছিলেন জাহান্নামের আযাবের ভয়প্রদর্শন কারী ও জান্নাতের সুসংবাদকারী। যেমন সুরাহ হুদের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন-‘তোমরা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারো ইবাদত তথা গোলামী/দাসত্ব/উপসানা করবেনা। মুহাম্মদ সা. বলেন- ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্য (আল্লাহ তায়ালার) পক্ষ থেকে আযাবের ভয় প্রদর্শনকারী ও (জান্নাতের) সুসংবাদদানকারী মাত্র।’ সুত্র: প্রাগুক্ত, আয়াত নং-০২।
আরবী ভাষাতত্ত্বের দৃষ্টিকোন থেকে বিশেষ্যপদ হিসেবে রসুল শব্দের অর্থ হলো-দূত, বার্তাবাহক, সাংবাদবাহক, প্রেরক। আর ক্রিয়াপদ হিসেবে বাবে তাফয়িল থেকে অর্থ হলো-ধীরে ধীরে স্পষ্ট করে পাঠ করা। সুতরাং স্পষ্টভাবে প্রতিয়মান হয় যে, কুরআনের বাণীগুলো স্পষ্ট সহকারে পাঠ করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াই হলো রাসুলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সুরাহ ইমরানের ১৪৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সেকথারই ঘোষণা দিয়েছেন ঠিক এভাবে-‘আর মুহাম্মদ হলেন তোমাদের শুধুমাত্র একজন রাসুল।’ উপরে আরবী ভাষাতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে রসুল শব্দের অর্থ আমরা জেনেছি। মুহাম্মদ (সা.) মানব জগতের জন্য একজন সতর্ককারী এ কথার ঘোষণা এসেছে সুরাহ ফোরকানে-‘কত বরকতময় তিনি (আল্লাহ তায়ালা), যিনি তাঁর বান্দার উপর (সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী এই) ফোরকান নাজিল করেছেন যাতে তিনি (রাসুল সা.) বিশ্ববাসির জন্য সতর্ককারী হতে পারেন।’ সুত্র: সুরাহ ফোরকান, আয়াত নং-০১। প্রত্যয়দীপ্ত কন্ঠে বিশ্বনবী (সা.) মানুষের কাছে তাওহীদের বাণী ঘোষণা দিয়েছেন এবং সেই সাথে পরকালের জবাবদিহিতার বিষয়ে সতর্কবাণী প্রচার করেছেন।
যেমন আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-‘(হে নবী এদের) বলো, আমি তো (জাহান্নামের) একজন সতর্ককারী মাত্র, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি একক, তিনি মহাপরাক্রমশালী। *(তিনি) আসমান ও জমিনের মালিক, আর এই দুয়ের মাঝে যা কিছু তারও, তিনি প্রচুর ক্ষমতাশালী ও ক্ষমাশীল।’ সুত্র: সুরাহ ছোয়াদ, আয়াত নং-৬৫-৬৬। তারপরও যারা বক্র হৃদয়ের অধিকারী তারা মুহাম্মদ (সা.) আল-কুরআনের আলোকে কল্যাণমুখী জীবন ব্যবস্থার যে দাওয়াত দিয়েছেন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফলশ্রুতিতে এই পাষাণ হৃদয় গুলো নিজেদের জাহান্নামে যাওয়ার পথ নিজেরাই রচনা করেছে। কারণ কিয়ামতের মাঠে আল্লাহ তায়ালা যখন তাদেরকে পাকড়াও করবেন তখন তারা নিজেরা অস্বীকার করবে তাদের কৃতকর্মের কথা। উক্ত সময়ে আল্লাহ তায়ালার রাসুলগণ দুনিয়াতে তাদেরকে যে সতর্ক করেছিল তার রেকর্ড তাদের সামনে হাজির করা হবে। তখন তারা নিজেরা লজ্জিত হবে। এই মহামুছিবত ও বিপদের সময়ে কোন মানুষ তাঁর স্বপক্ষে না পাবে কোনো অভিভাবক, আর না পাবে কোনো হিতাকাঙ্খী ও সুপারিশকারী। আর এ সময় এসকল বদনসিব মানুষদের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে এবং তাদের হাত ও পা তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করবে।আর এ কথার ঘোষণা সুরাহ ইয়াসিনের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন ঠিক এভাবে-‘আজ (হিসেব-নিকেশের জন্য) আমি তাদের মুখ সমুহকে (সিলগালা) বন্ধ করে দেবো এবং তাদের হাতগুলো তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে থাকবে। এবং (পাপিষ্ঠদের) পাগুলো তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ তায়ালার দরবারে সাক্ষ্য দিতে থাকবে যে কৃতকর্ম দুনিয়াতে তারা করেছিল।’ সুত্র: সুরাহ ইয়াসিন, আয়াত নং-৬৫। এক পর্যায়ে তারা আফসোস করে দুনিয়ায় আসার ইচ্ছা পোষণ করবে কিন্তু তাঁদের আর দুনিয়ায় আসার কোনো সুযোগ থাকবে না। সুতরাং প্রতিটি মনুষ্য হৃদয়কে ঈমানের আলোয় আলোকিত হয়ে মুহাম্মদ (সা.) এর আনীত দ্বীনকে পরিপূর্ণরুপে ব্যক্তি জীবন থেকে জাতীয় জীবনের সকল স্তরে অনুসরণ ও অনুকরণ করতে হবে। আর এ কথারই ঘোষণা এসেছে সুরাহ বাকারার ২১ নং আয়াতে-‘হে মানব মন্ডলী! তোমরা মহান আল্লাহ তায়ালার ইবাদত/দাসত্ব স্বীকার করো,যিনি তোমাদের এবং তোমাদের আগে যারা ছিল তাদের সকলকে সৃষ্টি করেছেন। আশা করা যায় তোমরা (যাবতীয় সংকট থেকে) বেঁচে থাকতে পারবে।’
মুহাম্মদ (সা.) এর দায়িত্ব ও কর্তব্যের পরিসীমা: যুগে যুগে পথহারা মানুষদের সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁর বাছাইকৃত বান্দাদেরকে কিতাব সহকারে কখনো গোত্র বিশেষ আবার কখনো নিদ্দিষ্ট কতিপয় সম্প্রদায়ের কাছে এবং সর্বশেষ মুহাম্মদ (সা.) কে সমগ্র মানবমন্ডলীর জন্য রাসুল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ (সা.) কে পাঠালেন এমন এক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে যে সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে পাপাচার আর জুলুমাতে ছিল ভরা। সমাজের মানুষের মধ্যে বৈষম্যর এক পাহাড় রচিত হয়েছিল। মানবাধিকার বলে কোন সভ্যতার বিকাশ সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল না। এমন এক পাপাচার, অনাচার, বর্বর, পাপিষ্ট ও মানবতাহীন সমাজের ব্যবস্থাপনাকে পরিবর্তন করে সুবিচার এবং কল্যাণমুখি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ তায়াল বিশ্ববাসির রহমাত স্বরুপ মুহাম্মদ (সা.) কে এই ধরার বুকে পাঠিয়েছিলেন। উপরের মৌলিক আলোচনা থেকে আমরা অবগত হলাম যে, বিশ্বনবী (সা.) এর আগমন পূর্ব সময়ে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপট কী ছিল। এখন প্রশ্ন হলো এমন সমাজ ব্যবস্থার উপর মুহাম্মদ (সা.) এর দায়িত্ব ও কর্তব্য কী?। আর আমাদের এই মৌলিক প্রশ্নের জওয়াব স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনে দিচ্ছেন ঠিক এভাবে-‘রাসুল দায়িত্ব (হেদায়াতের বাণী তথা আল কুরআনের আহকাম সম্পর্কিত বাণী) পৌছে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়, আর তোমরা যা কিছু প্রকাশ করো আর যা কিছু গোপন রাখো,আল্লাহ তায়ালা তা সবই জানেন।’ সুত্র: সুরাহ মায়েদা, আয়াত নং-৯৯।
রাসুলের দাওয়াত থেকে শুধুমাত্র তারাই উপকৃত হবে যাদের হৃদয়ে তাওহীদ বদ্ধমূল আছে। এবং যারা আল্লাহ তায়ালাকে একমাত্র সার্বভৌমত্বের মালিক মনে করে কেবলমাত্র তাকেই ভয় করে শুধু এই শ্রেণির মানুষরাই পরকালে উপকৃত হবে। আর যারা রাসুলের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মানুষের তৈরী করা দ্বীন ও বিধানকে অনুসরণ করবে এবং একই সাথে মুহাম্মদ (সা.) এর দেখানো কল্যাণমুখি ইসলামের পথ ও তাঁর বিধানের সাথে বৈরী আচরণ করবে তারা পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-‘হে নবী! এই কুরআন আমি (আল্লাহ) আপনার উপর এজন্য নাজিল করেনি যে আপনি (এর দ্বারা) কষ্ট পাবেন। *(এ কুরআন তো হচ্ছে কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি উপায়) কেবলমাত্র নসীহত/উপদেশ সে ব্যক্তির জন্য যে (আল্লাহ তায়ালাকে) ভায় করে।’ সুত্র: সুরাহ ত্বহা, আয়াত নং:২-৩। মুহাম্মদ (সা.) শুধুমাত্র একজন উপদেশকারী এবং কাউকে লাঠি ব্যবহার করে জোরপূর্বক দ্বীনের মধ্যে শামিল করা তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য নয় বরং তিনি শুধুমাত্র দ্বীনের প্রচারক ও উপদেশক।যেমন সুরাহ গাশিয়ার মধ্যে ইরশাদ হয়েছে-‘(হে নবী!) তুমি তাঁদের এই (দ্বীনের) কথাগুলো স্মরণ করাতে থাকো। তুমি তো শুধুমাত্র একজন উপদেশদানকারী মাত্র। *তুমি তাদের উপর বলপ্রয়োগকারী (দারোগা) নও।’ সুত্র: প্রাগুক্ত, আয়াত নং: ২১-২২। সমস্ত বিশ্বজগতের উপর আল্লাহ তায়ালার একক আধিপত্য বিদ্যমান। তিনি হলেন সকল ক্ষমতার একমাত্র উৎস। তিনি যেটা চান মুহূর্তের মধ্যে সেটা বাস্তবায়িত হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা তাঁর আপন সৃষ্টিকূলের মধ্যে মানুষ ও জ্বীনের ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রদান করে এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এক্ষেত্রে যদি মানুষ ও জ্বীন জাতি তাঁদের দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা না পেতো বরং আল্লাহ তায়ালা কেবলমাত্র তাঁর মনোনীত দ্বীন ইসলামকে তাঁদের উপর চাপিয়ে দিতেন। তাহলে আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট হক্ব ও বাতিলের মধ্যে এবং সত্যকে গ্রহণ ও মিথ্যাকে পরিত্যাগের ব্যাপারে কোনো পার্থক্য থাকতো না।
আর আল্লাহ তায়ালা দ্বীন গ্রহণ করার ব্যাপারে তাঁদেরকে যদি স্বাধীনতা না দিতেন তাহলে পরীক্ষা স্বরুপ দুনিয়াতে প্রেরণ করার কোনো উদ্দেশ্যই থাকতো না। সুতরাং জান্নাতী হৃদয় সত্য দ্বীনকে কবুল করবে আর জাহান্নামী বক্র ও কুটিল হৃদয় সত্যদ্বীন থেকে বিমুখ হয়ে তাগুতি দ্বীন তথা বাতিলের পক্ষাবলম্বন করবে।সর্বশেষ বার্তাবাহক করে সমগ্র বিশ্ববাসির জন্য আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ (সা.) কে নবী ও রাসুল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। রাসুলের দায়িত্ব ও কর্তব্য শুধুমাত্র সত্য দ্বীনের উপদেশকারী হিসাবে, জান্নাতের সুসংবাদ দাতা এবং জাহান্নামের সতর্ককারী রুপে অন্য কোন কারণে নয়। আর মুহাম্মদ (সা.) এর দায়িত্ব বলপ্রয়োগ করে দ্বীন (ইসলাম) বুঝানোও নয় বরং দ্বীনকে স্পষ্ট সহকারে মানুষের কর্ণকুহরে পৌছিয়ে দেওয়াই হলো তাঁর মুল দায়িত্ব।
তারপরও মক্কার কাফেররা আল কুরআনের দাওয়াতকে অস্বীকার করেছে।যেমন আল কুরআনে এসেছে-‘তোমার জাঁতির লোকেরা এই (কুরআন)কে অস্বীকার করেছে, অথচ তাই একমাত্র সত্য; তুমি তাদেরকে বলে দাও, আমি তোমাদের উপর কর্মবিদায়ক নই। *প্রতিটি (দ্বীনের দাওয়াতের) বার্তার (প্রমাণের) জন্য (পরকালে) একটি সুনিদ্দষ্ট দিনক্ষণ প্রস্তুত আছে এবং তোমরা অচিরেই তা জানতে পারবে।’ সুত্র: সুরাহ আনয়াম, আয়াত নং: ৬৬-৬৭। উল্লিখিত কুরআনের বার্তাগুলো আমাদের এই মর্মে সংবাদ প্রদান করছে যে,মুহাম্মদ (সা.) এর দেখানো আল কুরআনের পথ থেকে দুরে থাকলে পরকালে আল্লাহ আমাদেরকে পাকড়াও করবেন এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।অতএব সময় থাকতে দুনিয়ার জীবনেই আমাদেরকে মুহাম্মদ (সা.) এর কুরআনিক আদর্শকে অনুসরণ ও অনুকরণ করতে হবে। তাহলে আল্লাহ তায়ালা পরকালে আমাদেরকে মুক্তি দিয়ে জান্নাত দান করবেন। হে আল্লাহ! আমাদের সকলকে তোমার পাঠানো সত্য দ্বীন ইসলামের উপর আমরণ টিকে থাকার তাওফিক দান করুন, আমিন (চলবে…)। লেখক: ইসলামী গবেষক
The post কুরআন-সুন্নায় মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনদর্শন appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/2HEYlQh
No comments:
Post a Comment