উত্তম বিশ্বাস
ঘাম আর অশ্রæ একসাথে শুষে নিয়ে শীতলের মা বলে উঠল,“বহুদিন পর বাছাটার মুখে এট্টু হাসি ফুটেছে, এ যে কতবড় শান্তি!”
“শেতল কাজ পেয়েচে বুঝি?”
আল্পনার মা ভ্রু ভেঙে আরও একবার জিজ্ঞাসা করল।
বড় একটা বেদানা ফাটিয়ে অর্ধেকটা আল্পনার মাকে দিয়ে বলল,“নেও খাও!”
“কী গো বললে না তো শেতল কী কাজ পেয়েচে?”
একগাদা লেখাপড়া শিখেছে শীতল। এ নিয়ে কোনোদিন গর্ব করতে পারেনি। এমনকি পথের ধারে টাইমকলে জল আনতে গেলেও কুণ্ঠায় কুঁকড়ে থাকত বিমলা। ভাবত ওই বুঝি পড়াশুনা নিয়ে টোনটিপ্পনী শুরু হল!
কিন্তু আল্পনার মাও কম দুয়েবাজ না! সেও শীতলকে ভালোকরে বাজিয়ে নিতে চায়! এমন একটা ঘরে সম্পক্ক করবে, একটু বাজিয়ে নেবেনা, তাই বললে হল?
এবার বিমলা একা একাই বলতে শুরু করল, “পড়াশুনা করে খালিখালি এতগুনু বছর মাটি কল্লে! এখন নিত্যনতুন ফল পাকড় নিয়ে মাকে খাওয়াচ্চে! নিয়তক কত খাওয়া যায় বলো দিকিনি!”
খানিক থেমে গিয়ে আল্পনার মাকে তাগাদা দিয়ে বলল,“কী গো দিদি, খাও! এতে করুনা নেই গো! আমি অনেকবার সাবান স্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে নিয়েচি! আগে অ্যাম্বুলেন্স থেকে আনত, তা খেয়েও তো মরিনি! এখন তো ও নিজের গাঁটের পয়সায় কেনে!”
অ্যাম্বুলেন্সের কথা শুনে আল্পনার মা তো আড়ষ্ট হবার জোগাড়,“মানে! বলচ কী?”
“একেবারে আড় হয়ে পড়লে যে! মনে হচ্ছে মোটে কিছু জানো না তাইনা? আমাদের এতো ভালো একটা ব্যাওসা বেচে ওই শুয়োরের হাতে দিলাম!”
“কে সুকুমার?”
“তা নয় তো কী!”
“ও মাগো ও তো শুনি মড়া টানে!”
“হুম! দেখো গিয়ে দালান কদ্দুর উঠেছে! আমারও অভিশাপ আছে না! ভোগে হবেনা ওই কুঠাবাড়ি!
একই পাড়ায় পিঠোপিঠি বড় হয়ে উঠেছে শীতল আর সুকুমার। ওরা এক কলেজে না পড়লেও আজকাল একসাথে ফর্ম তুলত, চাকরির পরীক্ষা দিতো। স্বপ্ন দেখত, রাত জেগে জি-কে প্রাক্টিস করত, বিফল হলে একসাথে একছন্দে কপাল চাপড়াত! হঠাৎ সুকুমার কেমন যেন উঠেপড়ে লাগল, “কাকিমা, নাগা সাধুরা যেভাবে নাচানাচি শুরু করেছে! এরপর আসছে ইলেকশান! মানুষ ¯্রফে মাছির মতো মরবে, মিলিয়ে নিও!”
“আমাকে তুই কী করতে বলিস বল!”
শীতল খেকিয়ে উঠল, “বাবাকে বোঝাও, প্লাটফর্মের ওপর দোকানটা বেকার বেকার রেখে কী লাভ?”
“ওমা সেকী রে? দোকান বেচলে তোর বাবা কী নিয়ে থাকবে?”
“মানুষ ইহকালে আর নিজের মুখ দেখাতে পারবে কিনা ঠিক নেই! কে মাখবে বাবার স্নো পাউডার!”
“পজিশনটা বেচেই দিলাম!”
এগিয়ে আসে আল্পনার মা, “দুদিন পুলিশ এসে ঘুরে গেল দেখলাম!”
“শকুনের শিথেনে সবাই মানত রাখতে আসে গো দিদি!”
“তা শীতলকে ছাড়িয়ে আনলে কেন?”
এবার অনেকটা কাঁদল বিমলা, “ওকে কতবার বলেছি, ও সুকুমার, তোমার কাকু কিন্তুক কিডনির পেশেন্ট! শীতলকে দিয়ে যেনো বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করিও না! কী বলব দিদি! মড়া ঘেঁটে ঘেঁটে বাছাডা আমার খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেলে! অথচ খবরে শুনি একটা দেহ প্লাস্টিকে মুড়িয়ে তুলতে পারলেই তেরো চোদ্দ হাজার! তুমি তো থাকো ফুলবাবু হয়ে! কই টাকা দেওয়ার বেলায় তোমার সেকথা মনে থাকেনা?”
এবার অনেকখানি অবজ্ঞা উগরে দিল আল্পনার মা,“এতটা লেখাপড়া শিখিয়ে শেষমেশ কিনা এই!”
“আজকাল কোনও কাজই আর হেলাচ্ছেদ্দা করা যাচ্ছেনা দিদি! যাও। যেয়ে দেখো একবার যদুর ঘরে! কে কোমনে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছে দেখো গিয়ে! বিএপাশ এমএ পাশ ছেলেরাও ওর উঠোনে কাগজ নেবে বলে ভোর থেকে কীভাবে কামড়া কামড়ি শুরু করেছে দেখো গিয়ে! বলি ওর বউটা ল²ীমতি! ভাগ্য্যিস ছিল, নইলে আজ আমার শীতল কোথায় কনে ভেসে যেত!”
কাগজের কথা এমনভাবে বলল বিমলা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আল্পনার মায়ের,“মানে? কোই দেখি কী কাগজ!”
এবার বিমলা ছোট্ট একটা চামড়ার ব্যাগ থেকে কিছু চিরকুট বার করল, “এগুলো দেখো। কাউকে বলোনা!”
“এগুলো কী গো দিদি?”
“টোকেন, যদুর বউ দিয়েছে! অর্ধেকটা হাসপাতালের আর অর্ধেকটাৃ!” বলতে বলতে বাকি কথাটা সাপের জিভের মতোই পেটের মধ্যেই টেনে নিল বিমলা!
বেদানার বিচিগুলো সব একটা একটা করে বেছে বাটিতে রাখল আল্পনার মা।
“কী গো খেলেনা?”
অভিমানে ভার হয়ে আসে আল্পনার মায়ের আকাশ, “মেয়ের মা বলে একেবারে ফেলনা ভাবো নাকি দিদি! আদৌ সে আর বে থা করবে কিনা জানিনে। তবু সবাই ঝ্যাকন বলাবলি করচে শীতল নাকি ভালো পয়সা কামাচ্চে! তাই এট্টু যেচে এলাম। তুমি তো দেখি মোটে খোলসা করচ না!”
“পেটে তো আমারও পচন ধরেছে আল্পনার মা! কিন্তুক হাঁ করার উপায় নেই! যদুর দয়ায় যাও বা লুকিয়েচুরিয়ে যা দু পয়সা আনছে ওদের কানে গেলি সেটাও আর থাকবেনা!”
“কারা? রেড ভলেটিয়ার?” অনেকটা রহস্যের হাসি হাসল আল্পনার মা!
সহসা ঝরঝর করে ঝরে পড়ল উষ্ণ দুফোঁটা অশ্রæ, “আল্পনার মা রে, তুই হলে কী খেতে পারবি এই ভাত? ছেলে এখন শ্মশানে লাইন রাখে! সকালে এক শিফটে হাসপাতালে ভ্যাকসিনের লাইন রেখে এয়েচে। এবার দুটো নাকেমুখে গুঁজে দিয়েই যাবে অন্যথা! তোমার মেয়েও শুনছিলাম রেড ভলেন্টিয়ারিতে নাম লিখিয়েছে? সত্যি?”
এবার আকাশ থেকে পড়ল আল্পনার মা, “কী সর্বনাশ! কোই আমি তো শুনিনি!”
ভেতরের ইমারত থেকে একটা একটা করে ইট খসে পড়তে থাকে আল্পনার মায়ের! অনেক আদর যতেœ মেয়েকে বড় করেছে সে। আর পাঁচটা মায়ের মতো সেও চায় একটা শিক্ষিত কর্মক্ষম ছেলে তার জামাই হবে। কিন্তু এ কী! এবার আল্পনার মা মানস চক্ষে দিব্যি দেখতে পাচ্ছে তার জামাই কুপন নিয়ে বসে আছে শ্মশানে! পার্টির কাছে আরও একটা কুপন আছে। হয়ত তারা তাঁদের বাবা মাকে লাইনে রেখে বাড়িতে বিশ্রাম করতে গেছে কিম্বা অন্য কোনও কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিম্বা মৃত্যুভয়কে অতিক্রম করার জন্যে নিরাপদ দূরত্বে বসে আছে! আর সেটা যাতে কুকুরে না খায়, সৎকারে কোনোরকম ত্রুটি না থাকে, অস্মমানিত না হয় এটা দেখার দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে শীতল! আর তার আল্পনা বেনারসি পরে বাসরঘরে অঝোর নয়নে কাঁদছে! বাইরে তুমুল বৃষ্টি! তবু শীতল ঘরে আসছেনা। একের পরে এক চুল্লির মুখ আলগা হচ্ছে! লাশের পরে লাশ পড়ছে! আর সেগুলোর নাম্বার মিলিয়ে তার জামাই পার্টির কাছ থেকে কড়কড়ে নোট গুনে নিচ্ছে!
বিমলা এবার আল্পনার মায়ের হাত দুখানি জড়িয়ে ধরে,“মেয়ে যেন খবর্দার এসব লাইনে না যায়! গাঁটের কড়ি ভেঙে হাটবাজার করে মানুষকে দুবেলা খাওয়াচ্ছে, ওষুধ পাতি কিনে দেচ্ছে, অক্সিজেন সিলিÐার নিয়ে দৌড়াচ্ছে, সব ভালো! কিন্তু এরপরেও মানুষের মেটে চেনা যাচ্ছে দিদি? মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অপরাধে ওরাও কী কম মার-গুঁতো খাচ্ছে! তাই বলি কী দরকার! সেদিন অনুকূলের ছেলেকে কত করে বুঝালাম, হেই, সরকারের এতো এতো লোক থাকতে তোরা এই বোঝা টেনে মরছিস কেন? দিল তো মাথাডা ফাটিয়ে?”
“হ্যাঁ এখন তো দেশ সেবার হিড়িক লেগে গেছে!”
“আমিও সেদিন ওকে এই কথাটাই বলতে চেয়েছিলাম! ছুড়া আমার বলে কী জানো? বলে কিনা ওরা আমাদের কাজ কেড়ে নিলে নিক। কাজের কী অভাব আছে! এবার গঙ্গায় ঝাঁপাবো! হিম্মত থাকলে ওদেরও নাবতে বলো! একবার ভাবো দিদি! কী মরণ মন্ত্রণা ওরা নিয়েছে! একি কচুরিপানা যে আঁকশি বাধিয়ে টেনে তুললাম আর হয়ে গেল! আমি তো শীতলকে বলিচি, এমন এনজিও থেকে একশ গজ!”
ওরা কেউই জীবনে গঙ্গা দেখেনি। পুণ্যস্নানে যাবার সৌভাগ্যও কারও হয়নি! শুধু হাঁড়িতে ভাত সেদ্ধ করতে করতে, হেঁসেল ঠেলতে ঠেলতে টিভিতে খবর শুনেছে, গঙ্গায় উপচে পড়ছে লাশ। পলির পাঁকে প্রিয়জনকে পুঁতে রেখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ!
গঙ্গার দুঃখে দুজনেই কাঁদল! দুকূল উপচে একসময় দুপুর গড়িয়ে এল। এবার আল্পনার মা উশখুশ করে উঠল,“তা তোমার ছেলেডা কই? একবার চোখের দেখা দেখেই যাই!”
“কনে গেলি ও মানিক?”
পায়ে পায়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল আল্পনার মা। ঘরে ঢুকেই ওর চোখ মোটা মোটা হয়ে এল! দুটো ঘরে দুখানা নতুন চৌকি! শীতলের বাপের খাটে ফুলছাপা মশারী। এলিডি টিভি, মিটসেফ, ঠাকুরের জন্যে পাথরের সিংহাসন সবই কিনে ফেলেছে শীতল!
শীতল আসছেনা দেখে এবার আল্পনার মা অস্থির হয়ে উঠল,“কী রে বাপু! বেটাছেলে হয়ে এমন লজ্জা! আমাদের লালার চেয়েও লাজুক!”
এবার গায়ে পড়েই অনেকগুলো কথা শুনিয়ে দিল আল্পনার মা, “লালা আমার ছোট দেবরের ছেলে গো! এক্কেবারে মেয়েদের এক কাঠি ওপরে! ঘরের বাইরে এক পাও ফেলবে না! সেদিন পাশেই এক শ্রাদ্ধবাড়ি নিমন্ত্রণ ছিল। পাঁচ পঞ্চায়েতের লোক এসে খেয়ে গেল! বাড়ির বউটা এসে পর্যন্ত কী সাধা সাধল! কিন্তু বাচাধন কিছুতেই গেলনা! সেই আমাকেই গামলাভরে ভাত চেয়ে এনে দিতে হল! উনি কুনায় বসে বসে খেলেন!”
বিমলার পিত্তি জ্বলে উঠল, “কী রে বাবু কোই রে? ঘোমটা দিয়ে বসে থাকলি কোথায়? হ্যাঁ না যাহোক এট্টা বলে যা! বাইরে আয়!”
এমন সময় পেছনের প্রতিবেশিনী যদুর বৌ চিৎকার করে উঠল,“ও কাকি, শিগগির এসো শীতল ঠাকুরপো আজ আবারো ঝাঁকে ঘা দিয়েছে! এক্ককেবারে ঝেঁকে ধরেছে!”
বিমলা দেখল আজও সেই একঝাঁক হলুদ বোলতা ওর সারা শরীরে হূল ফুটিয়ে সেঁটে আছে! আল্পনার মা আকুল আর্তনাদ করতে শুরু করল, “ওরে তুরা কে কনে আছিস এট্টু ধুঁয়া দে!”
কেউ এলনা। বিমলা উঠোন ঝাঁটানো মুড়ো ঝাঁটা এনে বিষাক্ত পোকাগুলোকে একটা একটা করে মারল!
উঠোনে দড়ির খাটিয়ায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে শীতল। সর্বাঙ্গে দাগড়া দাগড়া ক্ষত! অথচ ওর চোখেমুখে এমন একটা জ্যোতি যেন অজ্ঞাত এক অসুখ থেকে এই সবে আরোগ্য লাভ করেছে সে! খাটিয়ার এক মাথায় বসে কালো জাম খাচ্ছে যদুর বউ। একটা শিক্ষিত ছেলে খুঁজে হয়রান হচ্ছে আল্পনার মা। কিন্তু এসব কী! বউটা বলছে কী! কথাগুলো কানে আসতেই কানের লতি লাল হয়ে উঠল আল্পনার মায়ের, “উজবুক কোথাকার! আসল মধু কীসে সেটুকুও জানোনা! উনি নাকি শুনি ডিগ্রি পাশ! এবার বলো আঙুরফল টক!”
এঁটো জামের আঁটি ছুড়ে শীতলকে সমানে উত্তেজিত করতে লাগল যদুর বউ! এমন বেহায়াপনা আর নিতে পারল না আল্পনার মা! সে আক আক করে উঠল, “এই তুমি কাদের বৌ গা? জামের কষে কী আর সব জাতনা যায়? যাও এট্টু চুন এনে দাও তো দেখি!”
আল্পনার মায়ের কথায় যদুর বৌয়ের হাসি পেল খুব! সে ঠোঁট কামড়ে সরে পড়ল।
বউটাকে দাঁতের ওপর ফেলে পিষে ফেলতে ইচ্ছে হল আল্পনার মায়ের! মনে মনে এই আশঙ্কাই বুঝি করতে লাগল, “ঘরে ঘরে সব ঢেমনি পুষে রেখে দিব্যি দেখছি মানুষ আজকাল পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে আছে! তাই বলি, কেন বাচাধন বাইরে আসছে না!”
সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আল্পনার মায়ের মুখে অন্ধকার নেমে আসে! এতক্ষণ ধরে বুড়োটা ঘরের কোণায় শুয়ে খক্খক্ করে কাশছিল। ছেলেকে বোলতায় কামড়েছে শুনে সেও শ্বাস টানতে টানতে বাইরে বেরিয়ে এল। উনার চোখেমুখেও সেই একই নিরাসক্ত ভাব, যেন কিছুই হয়নি! আল্পনার মা আর ধৈর্য রাখতে পারল না! সে গোখরো সাপের মতো ফণা উচিয়ে উঠে দাঁড়াল, “এমন ঝাড়ফুঁক বাপের জন্মে দেখিনি বাপু! বল ও শীতলের মা, তোমার ছেলে তো শুনি খুব শিক্ষিত! রোজ রোজ কি তাহলে এভাবেইৃ?”
উত্তর দিতে গিয়েও বিমলার গলা শুকিয়ে এল! এবার আল্পনার মায়ের কোল থেকে বাটিটা টেনে নিয়ে, সে তার ধ্বস্ত শরীরে বেদানার বিচিগুলো সব একটা একটা করে টিপে, রস বার করল। এরপর বাটি উপুড় করে নিজেই চুমুক দিল।
আল্পনার মা দেখল বিমলার দুই গালসি বেয়ে বেদানার নির্যাস নয় যেন কালো বিষ বেয়ে নামছে!
The post হেমলক appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/35VzyzU
No comments:
Post a Comment