জি এম রুহুল আমিন
সে রাতে শফিকের ঘুমাতে বেশ খানিকটা দেরি হলো। কী কারণে যে ঘুমপরীরা তার দু’ চোখের পাতায় সোনার কাঠি ছোঁয়াতে বিলম্ব করেছিলো তা আজ স্মরণে নেই। তবে প্রচÐ ভ্যাপসা গরমের রাত ছিলো সেটা মনে আছে। ঘুমটা তখনও ভাল আঁটেনি। হঠাৎ ক্রিংক্রিং ধ্বনিতে টেলিফোন বেজে উঠলো। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় তার অলস শরীরটা কিছুতেই সায় দিচ্ছিলো না মশারি উঁচিয়ে টেবিলে গিয়ে ফোনকলটা রিসিভ করতে। কয়েকবার রিং বেজে থেমে গেলো। কিন্তু বড় কষ্টে আসা ঘুমটা তার নষ্ট হলো।
আবারো দু’ চোখের পাতা এক করার চেষ্টা করছে শফিক। কিছুক্ষণ পরে ঠিকই আবার রিং বাজতে শুরু করলো। দেয়াল ঘড়িতে রাত একটা বাজার ঘন্টা বাজলো। সে ভাবলো এত রাতে কে ফোন করছে? গতকাল বিকেলে আম্মা ফোন করে জানিয়েছিলো তোর বড় ফুফু খুবই অসুস্থ। ক্রনিক অ্যাজমার রোগী। দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। তবে কোন দুঃসংবাদ নয় তো?
আড়মোড়া ভেঙ্গে রিসিভারটা তুলে ‘হ্যালো’ বলতেই নারীকণ্ঠের আওয়াজ,–ভাইয়া কি ঘুমাইছো? ভাল আছো তোমরা? ভাবীকে একটু ফোনটা দাও তো।
–ভাবীকে দেবো মানে? কে আপনি? কোথা থেকে বলছেন?
–আমি লাভলী, আমার কথা বুঝতে পারছো না ভাইয়া? একটা কাপড় কাটবো কামিজের জন্য কিন্তু মাপটা ঠিক বুঝতে পারছি না। ভাবীকে দাও না প্লিজ।
শফিকের বুঝতে বাকি নেই কলটা রং নম্বরে চলে এসেছে। মেজাজটাই বিগড়ে গেল। একটু রাগের সুরেই বললো–আরে ম্যাডাম, রং নম্বর। এখানে কোন ভাবী-টাবী নেই। আমি একাই থাকি। এত রাতে ফোন করে বিরক্ত করবেন না প্লিজ।
কেবলমাত্র মশারির ভিতরে ঢুকেছে শফিক। আবারও রিং বাজতে লাগলো। ভাবলো, ঘুমের বারোটা যখন বেজেছে এবার একটা গালি দেই। পরক্ষণে ভাবলো, না একটু দুষ্টুমি করে দেখি কোথাকার কোন্ লাভলী।
–হ্যালো, এটা ৭১২১৩৩ নম্বর না?
–লাভলী ম্যাডাম বলছেন? আপনি আবারও ভুল নম্বরে ফোন করেছেন।
–ডিসটার্ব করার জন্য সরি ভাইয়া। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি রাজশাহীর লোক। খুলনায় কি কোন জব করেন?
–হ্যা, মাস তিনেক হলো এখানে ডাক বিভাগে অ্যাসিস্ট্যান্ট পোস্ট মাস্টার জেনারেল হিসেবে জয়েন করেছি। আপনিও তো মনে হয় রাজশাহীর লোক। তা কোথায় থাকেন আপনি?
–রাণীবাজারে আমাদের বাসা। আমার বড় ভাইয়া খুলনা সদর থানার ওসি মোঃ ফরিদুজ্জামান। গত মাসে খুলনায় বদলি হওয়ার পরে সপ্তাহখানেক হলো ফ্যামিলি শিফট করে নতুন বাসায় উঠেছে ওরা। ভাবী তো আমাকে এই নম্বরটাই দিলো।
কথার স্বর শুনে শফিকের বুঝতে বাকি রইলো না মারুফ স্যারের আদুরে সেই ছোট মেয়েটা লাভলী সে।
শফিক এবার একটু উৎসুক হয়ে পরিচয় দিয়ে বললো,–আমাদের বাসা গণকপাড়ায়। বাবা পিএন গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বছরখানেক হলো উনি রিটায়ার করেছেন। আমার নাম শফিক। খুলনা সদর থানার ওসি ফরিদ ভাইয়ার বাসার টেলিফোন নম্বর ৭১২৩৩১। যদি চিনতে ভুল না করি, তুমি সম্ভবত উনার ছোট বোন লাভলী, তাই না? তোমার ভাইয়ার বাসার নম্বর হয়তো শুনতে বা লিখতে ভুল করেছো। একটু ওলটপালট হয়েছে নম্বরটা এই যা। গতকালই তো সন্ধ্যায় তোমার ভাবীর সাথে আমার অনেকক্ষণ কথা হলো। আর যে বাসায় উনি ভাড়ায় উঠেছেন সেটা আমার একজন সিনিয়র কলিগের শ্বশুরবাড়ি।
ফোনের ও প্রান্ত থেকে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন–ও, আপনি শফিক ভাইয়া? ভাই-ভাবীর সাথে আপনার পরিচয় হয়েছে তাহলে? কতদিন পরে আপনার সাথে কথা বলছি! কেমন আছেন ভাইয়া? নতুন চাকরিতে ঢুকেছেন, খুলনায় পোস্টিং পেয়েছেন, কিছুই তো জানি না।
–হুম, চিনতে পেরেছো তাহলে! এটা আমার বাসার টেলিফোন নম্বর। ইচ্ছে হলে পরে কথা বলো। এখন খুব ঘুম পাচ্ছে। আর হ্যাঁ, আন্টির শরীর ভালো আছে তো? ফরিদ ভাইয়ার কাছে শুনেছি আন্টির কী যেন একটা মেজর অপারেশন হয়েছে।
–হ্যাঁ, আম্মার শরীর এখন ভালো আছে।
–তোমার কি অনার্স শেষ হয়েছে?
–ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো মাত্র। রেজাল্ট যে কবে হয়! বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটে প্রায় ছয় বছর লেগে গেলো অনার্স শেষ হতে।
আর কোন কথা না বাড়িয়ে ফোনকল শেষ করে ঘুমোতে গেলো শফিক।
লাভলীর বাবা মারুফ সাহেব একসময় পি এন গার্লস স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক ছিলেন। খুবই বদমেজাজি তবে আদর্শবান শিক্ষক। শফিকের বাবারও তিনি সিনিয়র। প্রায় ছয় বছর আগে রিটায়ার করেছেন। পৈতৃকভূমি নাটোর হলেও চাকরিসূত্রে বহু বছর রাজশাহী থাকায় এখন রাজশাহীতে সেটেল হয়েছেন। শফিকরা রাজশাহীর আদি বাসিন্দা।
লাভলীরা চার ভাই ও এক বোন। সবার বড় ফরিদ ভাই। স্বভাবে খুবই দুষ্টু ছিলেন। বেশ লম্বা ও গাট্টাগোট্টা গড়ন। পড়ালেখায় তেমন মনোযোগী ছিলেন না। ফুটবল খেলায় খুবই পারদর্শী ছিলেন। তাকে সবাই ম্যারাডোনা বলে ডাকতো। ডিগ্রী পাশের পর এএসআই পদে পুলিশ বাহিনীতে ঢোকেন। পদোন্নতি পেয়ে এখন পুলিশ ইন্সপেক্টর। লাভলীর অন্যান্য তিন ভাই সবাই টিচার। ভাইদের মধ্যে ছোট নাজমুল শফিকের ক্লাসমেট। সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক। একমাত্র বোন লাভলী সবার ছোট। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তবু এখনো সেই আদুরে নরম স্বরে কথা বলে। একেবারে শান্তশিষ্ট আর মৃদুভাষিণী।
সকালে ঘুম থেকে জাগার পরে ফ্রেশ হয়ে কেবলমাত্র নাস্তার টেবিলে বসেছে শফিক। তখনই ফোন বেজে উঠলো। রিসিভ করার সাথে সাথেই মিসেস ফরিদ অর্থাৎ নাজমা ভাবী গতরাতে তার ননদের রং নম্বরে টেলিফোনের ঘটনা বলছেন আর হাসছেন। শুনলাম বেশ ঝাড়ি দিয়েছো। নম্বরটা আমিই ওকে দিয়েছিলাম ভাই। তোমার ফোন নম্বরের সাথে গুলিয়ে ফেলেছিলাম।
তার কথা শেষ হতেই শফিক বললো,–ভাবী লাভলীর কি বিয়ে হয়েছে?
–না রে। ভাবছি অনার্স শেষ হওয়ার সাথে সাথে বিয়ে দিয়ে দেবো। তোমার হাতে কোন ছেলের সন্ধান থাকলে বলো।
–আচ্ছা। আমার পাত্রী খোঁজার দায়িত্বও কিন্তু আপনাকে দিয়েছি। মনে থাকে যেন।
এক সপ্তাহের একটা প্রশিক্ষণে ঢাকায় এসেছে শফিক। আজই শেষ হলো প্রশিক্ষণ। বাংলাদেশে মোবাইল ফোন চালু হয়েছে প্রায় দুই বছর। ইচ্ছে ছিলো চাকরি পেলে একটা মোবাইল সেট কিনবে। বন্ধুরা অনেকে কিনেছে। ওসি ফরিদ ভাইয়ের হাতে একটা সুন্দর সিমেন্স সেট দেখেছে। ওটাই কিনবে ভেবে বায়তুল মোকাররমের দিকে পা বাড়ালো সে।
সন্ধ্যায় ডরমিটরিতে ফিরে পরিচিত কয়েকজনের সাথে মুঠোফোনে কথা বললো শফিক। ফরিদ ভাইয়ের নম্বরে কথা বলেও নতুন মোবাইল সেট কেনার খবর বললো। তিনি বললেন–তোমার ভাবী তো তোমাকে গরু-খোঁজা খুঁজছে। কোথায় তুমি?
–একটা প্রশিক্ষণে ঢাকায় এসেছিলাম। কাল সকালেই খুলনায় ফিরবো।
–আচ্ছা। পরশু সন্ধ্যায় বাসায় এসো। বড় ছেলেটার জন্মদিন। এখানে তো পরিচিত তেমন কেউ নেই। তুমি আসলে ভালো লাগবে।
ভাইপোর জন্মদিন উপলক্ষে চার দিন আগে লাভলী এসেছে রাজশাহী থেকে। আসার পর থেকে সে ভাবীর কাছে শফিকের অফিস কোথায়, বাসা কোথায় জানতে চেয়েছে। শফিক তো লাপাত্তা। প্রশিক্ষণে ঢাকায় গেছে সে খবর তো আজই নাজমা জেনেছে তার ভাইয়ার কাছ থেকে।
সকালে নাস্তার টেবিলে লাভলীকে তার ভাবী বললো,–শোন্ তোকে আর কষ্ট করে শফিককে খোঁজা লাগবে না। আজই সন্ধ্যায় ও আমাদের বাসায় আসবে। বুঝেছি তো, কেন এত শফিক শফিক করছিস! ঠিকই মনে ধরেছে ওকে, তাই না? তোর ভাইয়াকে বলবো নাকি?
–না রে ভাবী। সে রাতে ভুল করে যখন উনার নম্বরে দুই তিনবার ফোন দিয়েছিলাম উনি আমার উপর সে কী মেজাজ গরম করে কথা বলেছিলো! আমি খুব অপমানিত বোধ করেছিলাম। সে কথাগুলো আমার মনে আছে।
–তুই কি তার প্রতিশোধ নিতে চাস? বাসায় আসলে যেন আবার উল্টাপাল্টা কিছু বলিসনে। আজ কিন্তু শফিক মেহমান।
The post রং নম্বর appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3jd5wPY
No comments:
Post a Comment