ইসরাইল খান
অধ্যাপক আহমদ শরীফ তাঁর শিক্ষক কবি জসীম উদ্ দীন সম্বন্ধে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তিনি ছিলেন, ‘বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম পুরো এমএ পাস, নামকরা কবি।’
স্মরণীয়, তাঁর পূর্ব-পর্যন্ত সাহিত্য-সমাজে সৃজনশীল কিংবা মননশীল ধারায় যাঁরা আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, ক্ষেত্র ছোট করে যদি শুধু মুসলমান স¤প্রদায়ের মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখে নামকরা কবি-সাহিত্যিকদের নাম বলি, তাহলে প্রথমেই উচ্চারণ করতে হবে নজরুল ইসলামের নাম। তাপর বেগম রোকেয়া, কায়কোবাদ ও মীর মশাররফ হোসেনের নাম করতে হবে এবং তাঁদের কেউ এমএ পাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন না।
আবার যাঁরা নামকরা ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন যেমনঃ কাজী আবদুল ওদুুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহা হোসেন এমএ পাস ছিলেন, কিন্ত তাঁরা জসীম উদ্ দীনের ন্যায় নামকরা ছিলেন না। কবি হুমায়ুন কবির, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক বা আবুল ফজল জসীম উদ্ দীনের বয়োঃকনিষ্ঠ। আর মুসলমান সমাজের গৌরব ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ উভয়বঙ্গে পন্ডিত স্বীকৃতি লাভ করলেও জসীম উদ্ দীন যতো অল্প বয়সে কবিখ্যাতি লাভ করেন এবং বাঙলার সারস্বত সমাজে সর্বব্যাপ্তি লাভ করে সে-খ্যাতি,ৃ ততোটা শহীদুল্লাহ্ লাভ করেন আরও অনেক পরে।
বাংলা সাহিত্যে কল্লোল-যুগ মার্কসবাদী গণসাহিত্যের কাল, আর ত্রিশ চল্লিশের সময়কার ‘আধুনিক সাহিত্য’ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, গুরুত্ববাহী অধ্যায়সমূহ। এই পর্বগুলোতে বাঙালি মুসলমানের অন্তর্ভুক্তি বা অবদান থাকতোই না, যদি না নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্ দীন, হুমায়ুন কবির, আবদুল কাদির, আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল, মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, শামসুন্নাহার ( মাহমুদ) ঐ-কালে বাঙলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে আত্মপ্রকাশ না-করতেন!
এই সকল মনীষীকে মুসলমান বলে সাধারণতঃ বৃহত্তর বঙ্গ-সাহিত্যের ইতিহাসে অনাধুনিক বলে ‘অব’ বা ‘অপ’-মূল্যায়ন করা হতো বা বলা চলে, এখোনো করার চেষ্টা হয়ে থাকে। কিন্তু যে-কালে বাঙালি মুসলমানেরা বাঙলা সাহিত্যে ‘পশ্চাৎপদ’ বলে হীনচেখে বিবেচিত হতেন, এবং হীনমন্যতায় ভুগতেন…সেই কালে উপর্যুক্ত মনীষীগণ আধুনিক সাহিত্যের মুখপত্রগুলো, যথাঃ কল্লোল, কালি-কলম,ধূপছায়া, প্রগতির সূচিপত্র দখল করে মুসলমান সমাজের মান রক্ষা করেছিলেন। এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বও করেছিলেন।
বাঙলা তথা ভারতবর্ষব্যাপী কমুনিষ্ট ভাবধারার বিস্তারে যে শ্রমিক, কৃষক, গণমানুষের জাগরণের তথা মার্কসবাদী আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯২১ সন থেকে রাশিয়ার ১৯১৭ ‘র অক্টোবর বিপ্লবের ধারাবাহিকতায়…জসীম উদ্ দীন তার দ্বারাও প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত হন। এবং কৃষক, শ্রমিক, নিচুতলার মানুষদের নিয়ে সাহিত্যের উপজীব্য করে কাব্য, সাহিত্য রচনা করে জাগরণের সৃষ্টি করতে সক্ষম হন তাঁর অদ্ভূৎ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিভার দ্বারা।
সে-কালের সাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁরা কল্লোলীয় বা মার্কসবাদীয়, কিংবা ত্রিশ ও চল্লিশ দশকীয়–তাঁদের উপজীব্য হয়েছিলো প্রধানত শহর ও শহরতলীর নিচু শ্রেণির শ্রমিক, মজুর, খেটে খাওয়া মানুষ প্রভৃতি। কিন্তু জসীম উদ্ দীন বেছে নিয়েছিলেন সেই এলাকার মানুষদের জীবন ও জগতের চালচিত্র, যেখানে শত বৎসর পরে এখনও নাগরিক জীবনের ফুরফুরে হাওয়া এখনো ধাক্কা মারে নি।
বরঞ্চ দোল খায় কুমড়োর ডগা, কচি পাতা। ছোট্ট নদী, মাঠের রাখাল নদীতে ভাসমান বেঁদেনীর নৌকা। সাপুড়ের মেয়েকে নিয়ে জসীম উদ্ দীন যে অপূর্ব কাব্য-গাথা রচনা করেন, তাকে কেবলই পল্লীসাহিত্য আখ্যা দেওয়া বোকামি। তা যে কতোটা আধুনিক ছিলো–কে-কথা বুঝেছিলেন কেবল আধুনিক, প্রগতিবাদী ও প্রগতিপন্থী লেখক ও শিল্পীরা। তাই কবি নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘লাঙল’ পত্রিকার প্রচ্ছদ প্রণীত হয়েছিলো চন্ডীদাস ও জসীম উদ্ দীন প্রণীত দুটি কবিতার পঙক্তিমালা।
‘কল্লোল’ পত্রিকার চতুর্থ বর্ষ, ষষ্ঠ সংখ্যা, আশ্বিন ১৩৩৩ এ প্রকাশিত জসীম উদ্ দীনের ‘রাখালী’ কবিতার নিম্নোক্ত কতিপয় চরণ উদ্ধৃত করা হতো। যথা–
‘‘ রাখাল ছেলে ! রাখাল ছেলে ! বারেক ফিরে চাও,
বাঁকা গায়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও
ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ,
কলা পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা;
সেথায় আছে ছোট্ট কুটির সোনা পাতায় ছাওয়া,
সাঁঝ-আকাশের ছড়িয়ে-পড়া আবীর-রঙে নাওয়া;
সেই ঘরেতে একলা বসে ডাকছে আমার মা—
সেথায় যাব, ও ভাই এবার আমায় ছাড় না !’
[ উল্লেখ্য, ‘লাঙল’ এর প্রচ্ছদের উপরিভাগে মুদ্রিত হতো–কবি চন্ডীদাসের ‘শুনহ মানুষ ভাই–, / সবার উপরে মানুষ সত্য / তাহার উপরে নাই।’’ নিচের অংশে মুদ্রিত হতো ‘রাখালী’র প্রথম আট লাইন। এখানে আবারও একটা টীকা আবশ্যক, তাহলো ‘রাখালী’ নামের কবিতা দুটি হওয়ায় একটার নাম রাখা হয়,‘রাখাল ছেলে’।‘লাঙলে যে টা উদ্ধৃত হতো সেটি ‘সুচয়নী’তে আছে ‘রাখালী’ নামে। সুচয়নীর প্রথম কবিতার নাম ‘ রাখালী’ ; তার প্রথম চরণ–‘এই গাঁয়েতে একটি মেয়ে চুলগুলি তার কালো কালো’]
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদপুষ্ট, এদেশে কম্যুনিষ্ট ভাবধারার প্রচারের কাজে ‘লাঙল’-ই সম্ভবত প্রথম বাংলা সাময়িকপত্র। আর সেই সাময়িকীর প্রচ্ছদ হয়েছিলো জসমি উদ্ দীনের কবিতা দিয়ে।
অথচ পরিতাপের বিষয়, এদেশে আমরা একালের আধুনিকেরা তাঁকে কেবলমাত্র ‘পল্লী-কবি’র তকমা দিয়ে হেলায় পাঠ করি–‘নক্সীকাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’, আর ‘এক পয়সার বাঁশী’। তিনি যে গদ্য-গ্রন্থগুলো রচনা করেন–তার মূল্যও স্বীকৃত নয়। আমরা ভুলেই যাই বাংলা সাহিত্যের সমগ্র প্রেক্ষাপটটি।
জসীম উদ্ দীনের আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা জাতীয় গ্রন্থগুলো; ও ভ্রমণ কাহিনীগুলো ,আর গল্প ও উপন্যাসসমূহে যে সহজ-সুন্দর শিল্পরূপ লাভ করেছে..তাতে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উচ্চকিত হয়ে আছে তাঁর অতি আধুনিক মন-মনন-চিন্তা ও সামাজিক-দর্শন। গদ্যগুলোতে, বিশেষত জীবন-স্মৃতিতে যে-স্টাইলে তিনি দেশ-কাল-সমাজ-মানুষ ও জীবনচিত্র অঙ্কিত বা উপস্থাপিত করেছেন..তা কেবল ইউরোপীয় সাহিত্যেই মিলে।
তাঁর বাঙলা ভাষাবোধ বিচারের ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় শব্দ নির্বাচন, প্রয়োগ ও রচনারীতির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। বাঙলার শাশ্বত শব্দ ও রীতি তাঁকে আকৃষ্ট করে, লোক-সাহিত্য সংগ্রাহক ও গবেষকের কাজ করার কালে। জাতীয় বাংলা ভাষার শব্দ ও রীতির ব্যবহারে এবং বাঙলার মানুষের জীবনসমাজের শাশ্বত প্রাকৃত রূপের উপস্থাপনে তাঁকে বাঙলার জাতীয় শিল্পী, জাতীয় কবি ও জাতীয় ব্যক্তিত্বের মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
‘জাতীয় ব্যক্তিত্ব” কথাটা ব্যাখ্যা করা যাক। আর আপাতত আমাদের দীনতা স্বীকার করা যাক্ যে, জাতীয় সাহিত্য ¯্রষ্টাকে আমরা ‘পল্লীকবি’র গন্ডীতে আবদ্ধ করে রেখেছি।
১৯৪৭ সালের অব্যবহিত পরেই বাঙলা ভাষার দুঃসময়ে জসীম উদ্ দীনসহ বিশজন বিশিষ্ট নাগরিক পূর্ববঙ্গ সরকারের কাছে বাংলাকে ‘রাষ্টভাষা’ হিসাবে স্বীকৃতি দানের দাবি জানিয়েছিলেন।পাকিস্তান আমলে সরকারের বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংসের প্রতিটি ষড়যন্ত্রের কালে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিবাদকারী ও প্রতিরোধক। সরকারী চাকুরে হওয়া সত্তে¡ও প্রগতিশীল ও অসা¤প্রদায়িক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা জসীম উদ্ দীন ষাটের দশকের শেষের দিকে পাকিস্তান সরকার রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধের পদক্ষেপ নিলে সরকারি সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন।
বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক , বাঙলার শাশ্বত সাহিত্য-শিল্পরূপের ¯্রষ্টা , ‘জাতীয়-ব্যক্তিত্ব’ জসীম উদ্ দীনের প্রতি বাঙালি সমাজ অপরিশোধ্য ঋণের দায়ে আবদ্ধ।
The post জসীম উদ্দীন: এমএ পাস কবি appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3xQ8RbZ
No comments:
Post a Comment