Thursday, October 29, 2020

ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী: উৎপত্তি ও কারণ https://ift.tt/eA8V8J

শাহ আলম বাদশা
ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী বা সিরাতুন্নবী (সা.) ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের নিকট জনপ্রিয় একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যদিও এটি কোনো ইবাদাত নয়। তাই আরবি বা হিজরি সনের রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখটি ‘নবীদিবস’ হিসেবে জাঁকজমকপূর্ণ ও যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে থাকে। দিবসটি পালনের সাথে মুসলিমদের রাসুলপ্রেম এবং ইসলামি আবেগ জড়িত। দিবসটি বিশ্বের সকল মুসলিমদেশ বা মুসলিম এটি পালন না করলেও অনেকদেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে তা পালিত হয়। দিনটি বাংলাদেশে’ রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত হওয়ায় এদিন সরকারি সাধারণছুটিও ঘোষিত হয়ে থাকে। আর ‘মিলাদুন্নবী’ শব্দটির ব্যাপারে অনেকের আপত্তি থাকায় এদেশে কেউ-কেউ একে ‘সিরাতুন্নবী’ নামেও পালন করে।

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ‘ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী (আরবি: مَوْلِدُالنَبِيِّ‎‎ মাওলিদু এন-নাবী, আরবি: مولدالنبي মাওলিদ আন-নাবী, কখনো কখনো সহজভাবে বলা হয়مولد মাওলিদ, মেভলিদ, মেভলিট, মুলুদ আরো অসংখ্য উচ্চারণ; কখনো কখনো: ميلاد মিলাদ) হচ্ছে শেষনবীর জন্মদিন হিসেবে মুসলমানদের মাঝে পালিত একটি উৎসব। মুসলিমদের মাঝে দিনটি বেশ উৎসবের সাথে পালন হতে দেখা যায়। তবে উৎসব নিয়ে ইসলামি প-িতদের মাঝে অনেক বিতর্ক রয়েছে। হিজরি বর্ষের তৃতীয়মাস রবিউল আউয়াল-এর বারো তারিখে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশী মুসলমানরা এই দিনকে ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী বলে অভিহিত করেন। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কাছে এই দিন ‘নবীদিবস’ নামে পরিচিত।

মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ের সর্বশেষ নবী ও রাসুল মুহাম্মদের (সা.) একই দিনে জন্ম ও মৃত্যু হবার বিশ্বাস থেকেই ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর উৎপত্তি, যদিও তার জন্মের বছর, মাস এবং তারিখ সম্পর্কে ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই এবং থাকার কথাও নয়। কারণ তিনি রাসুল বা নবী হিসেবে মনোনীত হবেন, এ ব্যাপারটি আল¬াহ ব্যতীত অন্য কারুর জানার বাইরে থাকায় তা লিপিবদ্ধ হবার কারণ ঘটেনি। তাই তিনি অবিখ্যাত বা একটি সাধারণ শিশু হিসেবেই ৫৭০ বা ৫৭১ থ্রিস্টাব্দে মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। সে সময় কুরাইশ বংশের হাতে ছিল পবিত্র কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব থাকায় তার সম্ভ্রান্ত ও উচ্চবংশীয় হবার ব্যাপারে সন্দেহ নেই। মুহাম্মদের (সা.) জন্ম তারিখের ব্যাপারে পারিবারিক কিংবা নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকলেও অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, তার জন্ম হয়েছিল, পবিত্র কাবা শরীফ ধ্বংসের জন্য বাদশাহ আবরাহার নেতৃত্বে হস্তীবাহিনীর আগমন ঘটেছিল যে বছরে। তবে নবী হিসেবে ব্যাপক প্রভাবপ্রতিপত্তি ও জনপ্রিয়তার কারণে ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জুন বা ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে তার মৃত্যুর ব্যাপারটি ঐতিহাসিক ও সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সম্পূর্ণ বিতর্কহীন। ঐতিহাসিকদের মতে, ৫৭০ কিংবা ৫৭১ খ্রিস্টাব্দে রবিউল আউয়াল মাসের ৯ তারিখ সোমবারই হচ্ছে তার জন্মদিবস। কেননা ক্যালেন্ডারের হিসেবে ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে কখনোই সোমবার ছিল না বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। নিজের জন্মসন ও তারিখের উল্লে¬খ ব্যতীত স্বয়ং রাসুলও নিজের জন্মদিবসের ব্যাপারটা হাদিসে বর্ণনা করেছেন-

আবু কাতাদা আনসারি (রাদিআল্ল¬াহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-রাসূলুল¬াহকে (সা.) সোমবারে রোজা রাখার কারণসম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, এ দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এ দিনে আমাকে নবুওয়াত প্রদান করা হয়েছে অথবা এ দিনে আমার ওপর (অহি) নাযিল হয়েছে। (সহিহ মুসলিম-১১৬২)
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, “হিজরী ৪র্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর প্রচলন শুরু হয়। রাসূল, আলী, ফাতেমা, হাসান ও হুসাইন এর জন্মদিন, এসবের মূল প্রর্বতক ছিল খলীফা আল মুয়িজ্জু লি-দীনিল্ল¬াহ। এখানে উল্লেখ্য যে, মিশরের এইসব অনুষ্ঠানাদি তখনো মুসলিমবিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েনি। পরবর্তীতে যিনি ঈদে মিলাদুন্নবীকে মুসলিমবিশ্বের অন্যতম উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, তিনি হলেন, ইরাক অঞ্চলের ইরবিল প্রদেশের আবু সাঈদ কুকবুরী। সে হিসেবে জানা যায়, ৭ম হিজরি থেকে আনুষ্ঠানিক মিলাদ উদযাপন শুরু হয়। মিলাদের ওপর সর্বপ্রথম গ্রন্থ রচনা করেন আবুল খাত্তাব ওমর ইবনে হাসান ইবনে দেহিয়া আল কালবী।

রাসুল ও সাহাবাগণের কেউই নিজদের জন্ম-মৃত্যুদিন পালন না করলেও কিংবা পালন করতে না বললেও প্রচলিত ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর (সা.) মূললক্ষ্য হচ্ছে-রাসুলপ্রেমের বহি:প্রকাশ ঘটানো এবং তার জীবনের মিশন-ভিশনকে জনসাধারণ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করা। আর উদ্দেশ্য হচ্ছে-নিজেদের জীবনে তার আদর্শপ্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণাকে জাগরুক রাখা।

আইয়ামে জাহেলিয়াত বা আরবের অন্ধকার যুগ এর অবসান ঘটিয়ে তৌহিদের মহান বাণী অর্থাৎ শিকরযুক্ত ঈমান ও আমলের মিশন-ভিশন নিয়ে এসেছিলেন এ মহামানব। তিনি তার এবং তার সঙ্গীদের নিষ্কলুষ চরিত্রমাধুর্য দিয়ে প্রচার করেছেন শান্তিময় জীবনব্যবস্থা ইসলামকে। তাঁর আবির্ভাব এবং আল্ল¬াহকে পাবার জন্য বিভিন্ন মিডিয়া কিংবা দেব-দেবী ও মূর্তির কাছে ধর্না অর্থাৎ বহুত্ববাদের স্থলে একত্ববাদভিত্তিক ইসলামের শান্তি ও সাম্যের বাণীর প্রচার এবং মদীনাসহ বিভিন্ন দেশে ইসলামি খিলাফত বা রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তার কালজয়ী নেতৃত্ব ও আন্দোলন সারাবিশ্বেই আলোড়ন সৃষ্টি করে। আরব বিশ্ব যখন বহুত্ববাদসহ ব্যাপক অন্যায়-অত্যাচার, পাপচার, নারীনির্যাতন, বৈষম্য, বর্ণভেদ ইত্যাদি অপকর্মে ডুবে গিয়েছিল, তখন পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহান আল¬াহ তাঁর মনোনীত বিশ্বনবীকে (সা.) বিশ্বজগতের রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন-‘وَمَاأَرْسَلْنَاكَإِلَّارَحْمَةًلِلْعَالَمِينَ (হে নবী!) আমরা তো তোমাকে বিশ্বজগতের জন্য কেবলই রহমত বা অনুগ্রহ স্বরূপ পাঠিয়েছি।‘ (সূরা আম্বিয়া, ১০৭)। এর অর্থই হলো, তার পূর্বের লক্ষাধিক নবী-রসুল অঞ্চলভিত্তিক ইসলাম প্রচার করলেও মুহাম্মদকে (সা.) আঞ্চলিক বার্তা বাহক নয়, বিশ্বনবী করেই প্রেরণ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য যে, নবুয়ত প্রাপ্তির আগেও বিবেকবান ও মানবতাবাদী এ মহাপুরুষ মাত্র ১৭ বছর বয়সে সমমনা বন্ধুদের নিয়ে আরবের যুদ্ধবিগ্রহ ও অন্যায়-পাপাচারের মুলোৎপাটনে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক একটি আর্থসামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে মানুষের কল্যাণসাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। তার কাছে আল্ল¬াহর পথনির্দেশ না থাকলেও তিনি নিজেদের মনগড়া পন্থায় একটানা ২৩ বছর হিলফুল ফুজুলের মাধ্যমে আর্তমানবতার সেবায় যে, ব্যাপক কল্যাণমূলক কাজ করেছেন, তারই ফলশ্রুতিতে আরবের খারাপ মানুষেরাও তাকে ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বস্ত কিংবা ‘আস-সাদিক’ বা সত্যবাদী বলে উপাধি দেয়।
এরপর তিনি ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করে শুধু আরব নয়, বিশ্ববাসীর কল্যাণের জন্য আল্ল¬াহ প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা’ (ঈড়সঢ়ষবঃব পড়ফব ড়ভ ষরভব) ইসলামের পথে কাফির-মুশরিকদের মুক্তি ও শান্তির পথে আহ্বান জানান। ফলে মহানবী (সা.) ইসলামগ্রহণকারী সাহাবাদের দীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলনের ফলে মক্কা-মদীনাসহ অর্ধদুনিয়ায় ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জঘন্য চরিত্রের মানুষগুলো সোনার মানুষে রূপান্তরিত হয়ে যায়। তাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত চারখলিফা বা ‘খেলাফতে রাশিদা’ কর্তৃক আরো ৩২ বছর পর্যন্ত বিশ্বে মানবিক ও জনকল্যাণমুলক ইসলামি শাসনের অভূতপূর্ব নজির স্থাপিত হয়। এভাবে রাসুল সা. নবুয়তপ্রাপ্তির পর আবার সেই ২৩ বছরেই আল¬াহর বিধানদ্বারা বিশ্বে একটি নতুন জাতিগঠনছাড়াও কল্যাণমুলক ইসলামি শাসনের বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে গেছেন যে, মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞানবুদ্ধি ও মস্তিষ্কপ্রসূত মনগড়া জীবনব্যবস্থায় কখনো নিরপেক্ষ, সার্বিক ও ভারসাম্যপূর্ণ কল্যাণসাধন হতে পারে না। অবশেষে আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব-কর্তব্য অর্থাৎ রিসালতের মিশন সফল করে মহানবী (সা.) ৬৩ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।

বাংলাদেশে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যেমন মিডিয়ায় শুভেচ্ছাবাণী প্রচার করা হয়, তেমনই ধর্ম মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মহানবীর (সা.) ওপর আলোচনাসভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, মিলাদ ও দোয়ামাহফিল ইত্যাদি। এছাড়া সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি ভবন ও সশস্ত্রবাহিনীর সব স্থাপনায় জাতীয় পতাকোত্তোলন, জাতীয় পতাকা এবং ‘কালিমা তায়্যিবা’ লেখাসম্বলিত ব্যানার, ফেস্টুন ঢাকা মহানগরসহ সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ট্রাফিক আইল্যান্ড ও লাইটপোস্টে প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। এ উপলক্ষ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন পক্ষকালব্যাপী নবীজীবনের (সা.) ওপর আলোচনাসভা, মাহফিলসহ বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি মিডিয়াও যথাযোগ্য গুরুত্বসহকারে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে। এমনকি এ উপলক্ষ্যে দেশের সব হাসপাতাল, কারাগার, সরকারি শিশুসদন, বৃদ্ধনিবাস, মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে উন্নত খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা নেয়াও হয়ে থাকে।

The post ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী: উৎপত্তি ও কারণ appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/2Jf6Qlv

No comments:

Post a Comment