Thursday, October 29, 2020

কুরআন-সুন্নায় মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনদর্শন https://ift.tt/eA8V8J

মাওলানা মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ
২য় পর্ব:
হারবুল ফিজারে অংশগ্রহণ এবং হিলফুল ফুযুল গঠন: ইসলাম পূর্বযুগে আরবের লোকদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকতো এবং একাধারে তারা বছরের পর বছর যুদ্ধ করতো, তন্মধ্যে হারবুল ফিজারের যুদ্ধই ছিল সর্বপেক্ষা ভয়াবহ। ওকায মেলায় জুয়াখেলা, ঘোড়দৌড় ও কাব্য প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘ দশ বছর পর্যন্ত ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় এ যুদ্ধ স্থায়ী থাকে। মক্কার কুরাইশ ও কায়েস গোত্রের মধ্যে এ যুদ্ধ চলতে থাকে। এ যুদ্ধের সঙ্গে বংশের মান মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত ছিল বিধায় রাসুুল (সা.) কুরাইশদের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, আমি আমার চাচাগণের দিকে শত্রুদের ছুঁড়ে মারা তীর ও বর্শাগুলো কুড়িয়ে তাঁদের কাছে দিতাম। আল্লামা ইবনে হিশাম (রহ:) বলেন, মহানবী (সা.) কাউকে আক্রমণ করেননি। একাধিকক্রমে দশ বছরে এ যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। ফলশ্রুতিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কোমল হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে এবং তিনি অন্তরে ব্যাথা উপলব্ধি করেন। এসময় মানুষেরা জালিমের দ্বারা জুলুমের শিকার হচ্ছিল।

 

হারবুল ফিজারের যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, রাসুল (সা.) যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সন্ধি ও শান্তি চুক্তি কার্যকারিতার দিকে বেশি খেয়াল করেন। ফলাফল স্বরুপ মহানবী (সা.) তাঁর নবুওয়াত পূর্ব মাক্কী জীবনে মাত্র বিশ বছর বয়সে ৫৯০ খ্রি. মানুষের দু:খ-দশা দুর করা এবং মাজলুমকে সাহায্য করার নিমিত্তে মক্কার কতিপয় শান্তিপ্রিয় যুবকদের নিয়ে গঠন করেন হিলফুল ফুযুল। হিলফুল ফুযুল শব্দের অর্থ কল্যাণের শফত। তারিখের গ্রন্থ গুলোতে এসেছে যে, মহানবী (সা.) এর চাচা যুবায়ের ইবনে আবদুল মুত্তালিব ও আব্দুল্লাহ ইবনে জুদওয়ান সহ কতিপয় শান্তিপ্রিয় যুবকও ইতিমধ্যে রাসুল (সা.) এর হিলফুল ফুযুল গঠনের সাথে সহমত পোষণ করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে, ৫৯০ খ্রি. এর জুলক্বদ মাসে আব্দুল্লাহ ইবনে যুদওয়ানের গৃহে হিলফুল ফুযুল গঠনের শপথ করেন। আর এই শপথে অংশগ্রহণ করেন বনূ হাশিম, বনূ মুত্তালিব, আসাদ ইবনে আব্দুল উযযা, যুহরা ইবনে কিলাব ও তাইম ইবনে মুররা প্রমুখ সম্প্রদায়ের লোকজন। তারা এই মর্মে হলফ ও অঙ্গীকার করলেন যে, মক্কার স্থানীয় ও বহিরাগত যে কোন মযলুমকে তারা সাহায্য করবে। তারা যেই যুলুম করবে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এবং মযলুমের হক্ব ফিরিয়ে দেবেন। আর কুরইশরা এই দিনের অঙ্গীকারের নাম রাখলেন ‘হিলফুল ফুযুল’। আর এ দিনের কথা স্বরণ করে মহানবী (সা.) একদিন সাহাবীদেরকে বলেন, ঐ দিন তথা আব্দুল্লাহ ইবনে জুদওয়ান এর গৃহে যেদিন আমি শপথ করেছিলাম। সে দিনের শপথ আমার কাছে লাল উট গ্রহণ করার চেয়েও উত্তম। আজ ইসলামেও যদি এ জাতীয় অঙ্গীকারে আমাকে ডাকা হয় তবে অবশ্যই আমি তাতে সাড়া দেব।

সুত্র: সিরাত ইবনে হিশাম:ই.ফা.:১/১৩৮ পৃষ্ঠা, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৩/৮২-৮৫ পৃষ্ঠা, আল মুনতাজীম: ইবনুল কাউয়ুম, ২/৩০৮-১২, মিরাতুজ্জামান ফি তারিখী আইয়ান: সিবতু জাওজী ৩/৭৯।নবী হওয়ার পূর্বে বিশ্বনবী (সা.) যখন বিশ বছরের যুবক ছিলেন তখনই তিনি হিলফুল ফুযুল গঠন করে জামাআতবদ্ধ জীবন শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে চল্লিশ বছর বয়সে তিনি যখন নবী হলেন এবং ৬১০ খ্রিঃ যখন তাঁর উপর কুরআন নাজিল হওয়া শুরু হলো; সেই মহাগ্রন্থ আল কুরআনেও আল্লাহ তায়ালা জামায়াতবদ্ধ সংগঠনিক জীবন গঠনের আহব্বান জানিয়েছেন। যেমন আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে জামায়াতবদ্ধভাবে আঁকড়িয়ে ধর, এবং তোমরা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না’। সুরাহ ইমরান, আয়াত নং-১০৩। হাদিসে রাসুলেও একই কথা ইরশাদ হয়েছে-‘যে ব্যক্তি জামায়াতবদ্ধ জীবন-যাপন করা থেকে এক বিঘাত পরিমান দুরে থাকলো, আত:পর সে যেনো তার আপন ঘাড় থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলল। সুনানে আবু দাউদ, হা: নং-৪৭৫৮। অত্র কুরআন ও হাদিসের পরম শিক্ষা হলো মুসলিম হিসেবে মুহাম্মদ (সা.) এর দেখানো পথ ও তাঁর আদর্শ মোতাবেক জামায়াত বদ্ধ জীবন-যাপন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ।কেননা মুহাম্মদ (সা.) নবী হওয়ার পূর্বে ২০ বছর বয়স থেকে সংগঠনিকভাবে জামায়াত বদ্ধ জীবন যাপন শুরু করেছিলেন। হিলফুল ফুযুল সংগঠনটি যার উৎকৃষ্ট নমুনা।

মুহাম্মদ (সা.) এর আমানতদারিতা ও আম্মাজান খাদিজা (রাঃ) এর সাথে তাঁর বিবাহের প্রেক্ষাপট ও সন্তান-সন্তুতি: মহানবী (সা.) এর জীবনী গবেষকদের দিকপাল খ্যাত আল্লামা ইবনে ইসহাক (রহ:) বলেন-খাদিজা বিনতে খুওয়ায়লিদ ছিলেন সম্পদ ও মর্যাদার অধিকারি একজন ব্যবসায়ী মহিলা। তিনি তাঁর ব্যবসায়িক মালের লভ্যাংশের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে তথা মুদারিবা পদ্ধতিতে অন্যকে দিয়ে তাঁর ব্যবসা কার্য পরিচালনা করতেন। অত:পর রাসুল (সা.) ছিলেন তাঁর কথায় সত্যবাদি, আমানতদারিতায় চির বিশ্বস্ত, উত্তম চরিত্রের অধিকারী এসব খবর যখন খাদিজা (রা.) এর কাছে পৌছালো। তখন খাদিজা (রা.) রাসুল (সা.) এর কাছে একজন প্রতিনিধি পাঠালেন সিরিয়ায় তাঁর ব্যবসা কার্য পরিচালনার প্রস্তাব দিয়ে। এবং তিনি (খাদিজা রা.) অন্যদেরকে যা অর্থপ্রদান করেন তাথেকে বেশি প্রদান করবেন এবং সাথে তাঁর গোলাম মায়সারা কে দেবেন। অত:পর রাসুল (সা.) তাঁর প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। তারপর রাসুল (সা.) খাদিজা (রা.) থেকে ব্যবসায়িক কাফেলা নিয়ে সিরিয়ার উদ্দেশ্য বের হলেন এবং রাসুল (সা.) এর সাথে খাদিজা গোলাম মায়সারাও বের হলো এবং তারা সিরিয়ার উদ্দেশ্য বের হলো। এভাবে তাঁরা সিরিয়ার উপকন্ঠ পর্যন্ত চললো। অত:পর খ্রিস্টান গির্জার নিকটবর্তী একটি গাছের ছাঁয়ায় রাসুল (সা.) অবতরণ করলেন। অত:পর খ্রিস্টান পাদ্রী গোলাম মায়সারার কাছে আসল। এবং বললো যে, এই গাছের ছায়ায় যিনি অবস্থান করছিলেন তিনি কে? উত্তরে মায়সারা বললো এই ব্যক্তি কুরাইশ বংশের একজন লোক এবং হারামের অধিবাসি। তারপর খ্রিস্টান পাদ্রী মায়সারাকে বললো-এই গাছের নিচে নবী ছাড়া কেউ কোনো দিন বসেনি। অত:পর রাসুল (সা.) তাঁর ব্যবসায়িক পণ্য সামগ্রী বিক্রয় করলেন। এবং তিনি (মুহাম্মদ সা.) যা চাইলেন প্রয়োজন মতো পণ্য সামগ্রী ক্রয় করলেন। অত:পর মায়সারা কে সাথে নিয়ে বিশ্ব নবী (সা.) মক্কার উদ্দেশ্য প্রত্যাবর্তন করলেন। মায়সারা চিন্তা করছিল যখন সূর্যের প্রখর আলোক রশ্মি জমিনে বিস্তার লাভ করছিল।এ সময় মায়সারা দেখলো যে, দুজন ফেরেসতা সূর্যের প্রখর তাপ থেকে মুহাম্মদ (সা.) কে ছাঁয়া দিচ্ছে। তারপর বিশ্বনবী (সা.) যখন মক্কায় ফিরে আসলেন তখন গোলাম মায়সারা খাদিজা (রা.) এর কাছে এসে কাফেলা পথের সেই ঘটনা বর্ণনা করতে লাগলেন।তিনি খাদিজা (রা.) কে খ্রিস্টান পাদ্রীর ঘটনা এবং ফেরেসতাদের কর্তৃক ছায়া দানের কথা বর্ণনা করলেন। খাদিজা (রা.) ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়ী একজন ভদ্রমহিলা ও বুদ্ধিমতী সত্ত্বার অধিকারি। খাদিজা (রা.) এর সম্মানের জন্য আল্লাহ তায়ালা যা চাইলেন তাই হলো।গোলাম মায়সারা কর্তৃক উক্ত ঘটনা শুনে খাদিজা (রা.) অভিভ’ত হলেন যে, তিনি রাসুল (সা.) এর কাছে নি¤œরুপ বার্তা পাঠালেন-‘হে চাচাত ভাই! আপনার গোত্রের মধ্যে আপনার যে মর্যদাপূর্ণ অবস্থান, যে আত্মীয়তার বন্ধন সর্বোপরি আপনার বিশ্বস্ততা, চরিত্র মাধুর্যও সত্যবাদিতার যে সুনাম রয়েছে,তাতে আমি মুগ্ধ ও অভিভূত’।

 

এই বলে খাদিজা তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। কুরাইশদের মধ্যে তখন খাদিজা ছিলেন ধনে-মানে, মর্যাদায় ও বংশীয় আভিজাত্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মহিলা। তাঁর গোত্রে এমন কোনো পুরুষ ছিলো না যে তাঁকে বিয়ে করার অভিলাষ পোষণ করবে।চুড়ান্তভাবে খাদিজা (রা.) এর প্রস্তাব যখন রাসুল (সা.) নিকট পৌছালো তখন রাসুল (সা.) এ বিষয়টি নিয়ে তাঁর চাচাগণের সাথে আলোচনা করলেন। অত:পর রাসুল (সা.) কে সঙ্গে নিয়ে তাঁর চাচা হামজা (রা.) খুওয়ায়লিদ বিনতে আসাদের পরিবারে গেলেন তথা খাদিজা (রা.) এর বাড়িতে। এরপর রাসুল (সা.) খাদিজা (রা.) কে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন এবং তাকে বিবাহ করলেন। প্রখ্যাত সিরাত গবেষক আল্লামা ইবনে হিশাম বলেন-রাসুল (সা.) সুস¦াস্থ্যবান তরুতাজা বিশটি উট দিয়ে খাদিজা (রা.) এর দেনমোহর প্রদান করেন। আর খাদিজা (রা.) যতদিন জীবিত ছিলেন রাসুল (সা.) দ্বিতীয় কোনো স্ত্রী গ্রহণ করেননি। সিরাত গবেষকদের দিকপাল খ্যাত আল্লামা ইবনে ইসহাক (রহ:) বলেন-একমাত্র ইব্রাহিম ছাড়া রাসুল (সা.) এর প্রত্যেকটি সন্তান উম্মুল মুমীনিন হযরত খাদিজা (রা.) এর পবিত্র গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন। মহানবী (সা.) এর পুত্রগণ: কাশিম, তইয়িব, তাহের এবং কন্যাগণ: যয়নাব, রুকাইয়া, উম্মু কুলছুম, ফাতিমা। সুত্র: আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ইবনে কাছির রহ:, পৃষ্ঠা ৩/৮৬-৮৭, সিরাত ইবনে হিশাম: পৃষ্ঠাঃ ১/১৯০, সিরাত ইবনে ইসহাক: পৃষ্ঠা: ৯১। (চলবে)। লেখক: ইসলামী গবেষক

The post কুরআন-সুন্নায় মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনদর্শন appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/2GahvNj

No comments:

Post a Comment