মাসুদুর রহমান
যে কোনো একটা দেশ উন্নত করতে হলে সব থেকে বেশি প্রয়োজন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার। আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ। আমাদের দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় সড়ক যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেই সাথে নৌপথ, রেলপথ ও আকাশ পথও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সরকার রাজধানীর সাথে জেলা, জেলার সাথে উপজেলা, উপজেলার সাথে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত একটি উন্নত সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের দেশ ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে যোগাযোগ ও যাতায়াত মানুষকে কর্মসংস্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ করে দেয়।
নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হলে সড়ক ব্যবহারকারী সকলকে এ সংশ্লি¬ষ্ট আইন ও বিধি মেনে চলতে হবে। এছাড়াও সড়কের নকশা, সড়ক তৈরির মান, যানবাহনের ফিটনেস, চালক ও হেলপারের প্রশিক্ষণ, চালক ও হেলপারের পর্যাপ্ত বিশ্রাম সুবিধা, নিয়ম মেনে যাত্রী ও পথচারীদের চলাচল নিশ্চিত করা, ট্রাফিক সিস্টেম আধুনিকায়ন, সড়কের পাশে নির্ধারিত দূরত্বের পর পর দুর্ঘটনাকবলীত মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। বর্তমান সরকার এক্সিডেন্ট প্রবন জায়গাগুলো চিহ্নিত করে বিশেষজ্ঞ দিয়ে এক্সিডেন্টের কারণ ও এর প্রতিকার চিহ্নিত করে সে মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং করছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ সাল থেকে জুন ২০২০ পর্যন্ত ৬ হাজার ৩৫৮ কি. মি. এর বেশি মহাসড়ক মজবুতিকরণ করা
হয়েছে। এ কাজটি চলমান রয়েছে। ৫ হাজার ২২৩ কি. মি. এরও বেশি মহাসড়ক প্রশস্তকরণ করা হয়েছে। ১ হাজার ২০৯টি সেতু, ৫ হাজার ৫৮১টি কালভার্ট নির্মাণ বা পুন:নির্মণ করা হয়েছে। ১৪টি ফ্লাইওভার ও ১৮টি রেলওয়ে ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। রেলওয়ে গেটের দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য পর্যায়ক্রমে সকল জায়গায় ওভারপাস বা আন্ডারপাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এছাড়াও ৪৫৩.৭ কি. মি. জাতীয় সড়ক ৪ লেনে বা কোথাও ৬ লেনে উন্নীত করা হয়েছে। ১ হাজার ৬ শত কি. মি. মহাসড়ক ৪ লেন বা তদুর্ধ্ব লেনে উন্নীতকরণের কাজ চলমান আছে। এ সমস্ত মহাসড়কে দ্রুতগতির যান চলাচলের পাশাপাশি যাতে ধীরগতির যানবাহনও চলাচল করতে পারে সেজন্য পৃথক ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২১টি স্থানে একমুখী এবং উভয়মুখী মিলে মোট ২৮টি এক্সেল রোড় কন্ট্রোল স্থাপনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। সারাদেশে মহাসড়কে ১৪৪টি ব¬াক স্পট চিহ্নিত করে সেই দুর্ঘটনা প্রবণ স্থান, বাজার এলাকা, রোড় ডিভাইডার স্থাপন, বাঁক সরলীকরণ, রোড় মার্কিং, সাইন সিগনাল ইত্যাদি স্থাপন করা হয়েছে। ২২টি মহাসড়কে সবধরণের থ্রি হুইলার চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বর্তমান সরকার ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকায়নে দীর্ঘমেয়াদি ব্যপক ও সমন্বিত পরিকল্পনা করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ৬টি মেট্রোরেলের আওতায় ১২৮.৭৪১ কিঃ মিঃ দীর্ঘ এবং ১০৪টি স্টেশন বিশিষ্ট একটি শক্তিশালী সড়ক নেটওয়ার্কের এগিয়ে চলছে। ৬৭.৫৬৯ কি. মি. উড়াল এবং ৬১.১৭২ কি. মি. পাতাল মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে যার ৫১টি স্টেশন হবে উড়াল এবং ৫৩টি স্টেশন হবে পাতাল। মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকাসহ এর পাশ্ববর্তী জেলার যানজট কমবে, দ্রুত যাতায়াত সম্ভব হবে। এতে জনগণ নিরাপদে, দ্রুত এবং স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াতের সুযোগ পাবে। বর্তমান সরকার ঢাকা ও চট্টগ্রামে মেয়েদের যাতায়াতের জন্য ২২টি বাস সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াতের জন্য ১৮৮ বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাধারণ যাত্রীদের জন্য ৬ শত নতুন বাস, ৬২৯টি দোতলা বাস এবং ২৮৭টি এসি বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও মালামাল পরিবহণের জন্য ৫ শতটি নতুন ট্রাক সংগ্রহ করা হয়েছে। জনগণের যাতায়াতের সুবিধার জন্য কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল তৈরি হচ্ছে।
মোটরযান এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স সংক্রান্ত সেবাসমূহের জন্য অনলাইনে আবেদনের সুযোগ করা হয়েছে। আমাদের দেশে অধিকাংশ লোক নিজে গাড়ি ড্রাইভিং করে না। ড্রাইভার রেখে গাড়ি ব্যবহার করে। অথচ উন্নত দেশগুলোতে সবাই নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে। এজন্য সকলকে ড্রাইভিং শেখার জন্য উৎসাহী করতে হবে। জেলা-উপজেলায় মানসম্মত ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করতে হবে যাতে সহজে ভালো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা সম্ভব হয়। বিআরটি এ কে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে কোনোভাবেই যেনতেনভাবে লাইসেন্স না পায়। যারা বর্তমানে নিয়মিত ড্রাইভার ও হেলপার তাদের ও স্বল্পমেয়দি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ট্রাফিক আইন-কানুন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া দরকার। প্রত্যেকটি মহাসড়কসহ সকল রাস্তায় স্পিড লিমিট নির্ধারণ করে দেওয়া দরকার। ট্রাফিক সিস্টেমে আধুনিক ডিজিটাল ডিভাইস সংযোজন করে মনিটরিং জোরদার করা যেতে পারে। কোনো যানবাহন নির্ধারিত গতিসীমা অতিক্রম করলে লেজার বিন দিয়ে গাড়ি আটকিয়ে ফাইন করা যেতে পারে। জরিমানা আদায়ের বিষয়টি সহজ ও ঝামেলামুক্ত হতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে সড়ক পরিবহণ আইন ২০১৮ জারি করেছে যা পর্যায়ক্রমিকভাবে সকলের সুবিধার বিষয়গুলো বিবেচনা করে বাস্তবায়ন করছে। ফিটনেস বিহীন যানবাহন কোনোভাবেই সড়কে যাতে চলতে না পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য গাড়ির মালিক, শ্রমিকসহ সংশ্লি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষকে সচেতন হতে হবে। গাড়ির ফিটনেস নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ড্রাইভার হেলপারদের বিশ্রামের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। একজন ড্রাইভারকে দিয়ে একটানা গাড়ি না চালিয়ে বিকল্প ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ি চালানো জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। সরকার পর্যায়ক্রমে সড়কের পাশে যেখানে পেট্রোল পাম্প আছে সেখানে পরিবহণ শ্রমিকদের বিশেষ করে ড্রাইভার হেলপারদের জন্য বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের জাতীয় মহাসড়কের ৪টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চালকদের জন্য বিশ্রামাগার করা হয়েছে। সড়ক ব্যবহারকারী পথচারীদের সচেতন করতে হবে। তাদের ট্রাফিক রুল সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। প্রাথমিক স্কুল লেভেল থেকেই ট্রাফিক রুল সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। ফ্লাইওভার, ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডার পাস, জেব্রাক্রসিং ও ফুটপাত ব্যবহারে সকলকে সচেতন হতে হবে। এগুলো নিয়ম মেনে ব্যবহার করতে হবে। যত্রতত্র রাস্তা পার হওয়া যাবে না। কোনো কারণে গাড়ি এক্সিডেন্ট হলে কোনোভাবেই আইন হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। ড্রাইভার হেলপারকে লাঞ্ছিত করা যাবে না, গাড়ি ভাংচুর বা এর ক্ষতি সাধন করা যাবে না। দ্রুত পুলিশের সহায়তা নিতে হবে এবং এক্সিডেন্টে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য প্রেরণের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ থেকে নিরাপদ সড়কের বিষয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ তথ্য অধিদফতর নিয়মিত ফিচার ও নিউজ গণমাধ্যমে প্রকাশের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জনগণকে প্রশিক্ষিত করে তুলছে। পরিবহণ দুর্ঘটনায় হতাহতদের মধ্যে শতকরা ২৫ শতাংশ লোকই উপার্জনক্ষম।বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় ২০১৭ সালে উলে¬খ করা হয়েছে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে আর্থিক ক্ষতি ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো (৫৩%) এরপর আছে চালকের বেপরোয়া মনোভাব (৩৭%) এবং অন্যান্য ১০%। রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহিতদের ৭২% পথচারী। বিশ্বব্যংকের তথ্যমতে, জিডিপিতে ৩ থেকে ৫ শতাংশ ঘাটতি তৈরি করে সড়ক দুর্ঘটনা। এটি জাতীয় উন্নয়নে বড়ো বাধা।
সরকার ২০৪১কে সামনে রেখে যত রাস্তা-ঘাট, সড়ক মহাসড়ক আছে, এর কোনো জায়গায় যোগাযোগ বাড়াতে হবে, কোথায় আরও দ্রুত যোগাযোগ বাড়াতে হবে, কোথায় ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে, সেগুলো বিবেচনা করে পরিকল্পনা করছে। এছাড়াও সরকার প্রেক্ষিত পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং এখন অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এভাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে দেশকে উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
এসডিজিতে নিরাপদ সড়কের বিষয়ে উলে¬খ আছে। সেগুলো সরকার পরিকল্পনা মোতাবেক বাস্তবায়ন করছে। আমাদের দেশের জনসংখ্যা বেশি। সেজন্য গ্রামের মানুষ যাতে গ্রামে থেকেই শহরের সব সুবিধা পায় তার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। গ্রামীণ সড়কগুলো উন্নত করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া।
বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। আমরাও পিছিয়ে থাকব না, এগিয়ে যাব। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনকারী দেশ ও জাতি কখনো পিছিয়ে থাকবে না, থাকতে পারে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা উন্নত, নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ণ দেশ আমাদের রেখে যেতে হবে। যে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে চলবে। আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলব। এটাই হোক আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
The post নিরাপদ সড়ক appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3nMUZul
No comments:
Post a Comment