আউয়াল আনোয়ার
জীবনানন্দ -চর্চার পত্রিকা ‘জীবনানন্দ’। যতই পড়ছি,ততই মুগ্ধ হচ্ছি। অচেনা অজানা জীবনানন্দকে নতুন করে আবিস্কার করছি। সম্পাদক মাসউদ আহামাদ পত্রিকাটি বের করতে যে কী পরিমান শ্রম ও সময় দিয়েছেন, ক্রমশ তা অনুধাবন করতে পাচ্ছি।একটি ভালো কাগজ করতে যা যা করা প্রয়োজন, সম্পাদক ঠিক ঠিক তাই করেছেন। এজন্য সম্পাদক মাসউদ আহমাদকে ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করতে চাইনা।’জীবনানন্দ’র জন্য তার প্রতি আমার একধরনের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়েছে, শুধু এটুকু বলতে পারি।অপেক্ষায় রয়েছি জীবনানন্দ দাশের জীবন,সময় এবং সেই সময়ের কুশলীবদের নিয়ে তার প্রকাশিতব্য দীর্ঘ উপন্যাস ‘কালো সিন্দুক’ পাঠের।
‘জীবনানন্দ’তে বিশেষ রচনায় গৌতম মিত্র’র ৪০ লক্ষ শব্দে গড়া মুদ্রাদোষ, দেবাশিস ঘড়াই’র সব পাখি ঘরে আসে,সব নদী,আসেন না জীবনানন্দ, আমীন আল রশীদ’র জীবনানন্দ :খডুগপুরের চিঠি।জীবনানন্দ-বিষয়ে সাক্ষাৎকারে অমিতানন্দ দাশ’র সাহিত্য চর্চার বাইরে জীবনানন্দ বাস্তবের মানুষ ছিলেন না, প্রভাতকুমার দাস’র তার কোনো চিঠিই অযতœ লিখিত নয়,সুরঞ্জন প্রামাণিক’র উপন্যাস লেখার সময় মনে হয়েছিল আমিই জীবনানন্দ। গল্প-উপন্যাস-বিশ্লেষণ বিষয়ে সুমিতা চক্রবর্তী’র উপন্যাসের নায়ক যখন জীবনানন্দ, মো.মেহেদী হাসান’র জলপাইহাটির কবি,সিরাজ সালেকীন’র জীবনানন্দের ‘ছায়ানট’ গল্পের শৈলী-প্রসঙ্গ,হানযালা হান’র আর্টের শরীর ও মন। আমার জীবনানন্দ বিষয়ে সুবোধ সরকার’র জীবনানন্দকে নিয়ে আমার বেদনার জায়গা আছে, হামীম কামরুল হক’র জীবনানন্দের সুবাস প্রগাঢ়ভাবে টের পাই,সাদাত হোসাইন’র
জীবন আনন্দ। কবিতা নিয়ে বিষয়ে মুহম্মদ মুহসিন’র রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ এবং প্রভাবের যন্ত্রণা, শামীম রেজা’র বনলতা সেন: বিশ্ব কবিতার আলোকে তুলনামূলক পাঠ, সেয়দ তৌফিক জহুরী’র জীবনানন্দের অতীন্দ্রিয়বোধ দৃশ্য অদৃশ্যের উপলব্ধি, মিরাজুল আলম’র জীবন শুয়ে আছে লাশকাটা ঘরে। সৃজনশীলতার নেপথ্যে বিষয়ে জয় গোস্বামীর যেভাবে লেখা হলো শ্রীচরণকমলেষু, জাহিদ আকবর’র ৮ নম্বর বাস সঙ্গী বনলতা সেন, কিং সউদ’র যেভাবে লেখা হলো আবার আসুন জীবনানন্দ সহ প্রতটি রচনাই জীবনানন্দ নিয়ে ভাবনা তৈরি করে। চিন্তার খোরাক যোগায়।আমি এ আলোচনায় সকল রচনার ভেতর থেকে শুধুমাত্র ‘জয় গোস্বামীঃ শ্রীচরণকমলেষু লেখাটির কিছু বিষয় তুলে ধরছি।
‘জীবনানন্দ’তে সৃজনশীলতার নেপথ্যে(নেপথ্য গল্প) অংশটিতে ‘যেভাবে লেখা হলো শ্রীচরণকমলেষু’ শীর্ষক লেখাটি পড়তে পড়তে একটা ঘোরের ভেতর ঢুকে পড়েছি মনে হচ্ছে।উত্তরকালের একজন কবির চোখে পূর্বকালের একজন কবিকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখা, অন্তচক্ষু দিয়ে দেখা যেনো। কবি জয় গোস্বামীর চোখে কবি জীবনানন্দ দাশ। কবি জয় গোস্বামী কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘শ্রীচরণকমলেষু’- উৎসর্গ জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯-১৯৫৪ শীর্ষক জীবনানন্দ বিষয়ক যে কবিতাগুচ্ছ রচনা করেন,তা এখানে সংকলিত হয়েছে ।এখানে জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে কবি জয় গোস্বামীর মোট ৯ টি কবিতা রয়েছে।কবিতার শিরোনাম গুলো এরকম-
এক)১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯
দুই) অন্ধকার থেকে এসে নব সূর্যে জাগার মতন
তিন) কবিতার কথা
চার)তার ভালবাসা পেয়ে ভয়াবহভাবে সৎ হয়ে আছি পাঁচ)সঞ্জয় ভট্রাচার্যকে লেখা চিঠি, ছয়)বরং নিজেই তুমি লেখো না কো একটি কবিতা
সাত) তবু ভালোবাসা ধুলো আর কাদা
আট) করুবাসনা উপসংহার) গ্রাম পতনের শব্দ হয়।
এখানে জীবনানন্দ বিষয়ক কবি জয় গোস্বামীর একটি চমৎকার কবিতা পাঠকদের জন্য তুলে দিচ্ছি।
“ঘরে ঠিক বনিবনা ছিল না? অবৈধ প্রেমে যেতে
সাহস ছিল না?তবে ভাড়াঘরে নতুন ভাড়াটে
বসাতে সাহস তো ছিল, সাশ্রয়ের কথা ভেবে? রাতে
বাতাসের রং দেখতে ভ্রমণ তো ছিল পূর্ণ একা!
পদচারণা তো ছিল জলের ওপরে,মধ্যে? তলে তলে দেখা
জলের সমস্ত তারা,তারার সমস্ত নদী, নদীর সকল
লুকোছাপা অগ্নি স্বতঃশ্চল।
ছিল সব অভিজ্ঞতা। খানখান দাম্পত্য হাত পেতে
নিলে ও বহন করলে। আমার সন্দিগ্ধ মন বলে
নতুন সম্পর্ক এলে তুমি কি এগিয়ে যেতে,
জল কি ফিরিয়ে দিতে, শ্রীচরণকমলেষু,জলে?”
(তার ভালোবাসা পেয়ে ভয়াবহভাবে সৎ হয়ে বেঁচে আছি)
‘জীবনানন্দ’ সম্পাদক মাসউদ আহমাদ ১৮ মার্চ,২০১৯ তারিখে কলকাতার সল্টলেকে যান এবং কবি জয় গোস্বামীর সাথে সাক্ষাৎ করে জীবনানন্দ বিষয়ক কবিতাগুচ্ছ ‘শ্রীচরণ কমলেষু’র শানে-নযুল উদ্ধার করেন।জীবনানন্দ পাঠকদের জন্য এ এক বড় পাওয়া।
(বিঃ দ্রঃ জয় গোস্বামী কথা বলেন কম,কিন্তু যা বলেন তার বেশিরভাগই গভীর ও অর্থবহ)
পাঠকদের জন্য জীবনানন্দকে নিয়ে আমার একটি কবিতা এখানে উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছিনা। কবিতাটি এরকম–
“এ জগত বড়ই মায়াময়
চারদিকে মায়ার খেলা শুধু
শরৎ চলিয়া যায়
হেমন্ত হিমে মাঠে মাঠে গীত ভেসে আসে
তেমাকেই মনে পড়ে,ঠিক তেমনিই
জীবনানন্দ রাত দীর্ঘ হয়
কিছু অদ্ভুত আর্তনাদ পেঁচার ডাক
রহস্যঘেরা একটি পুকুর
ঝি ঝি পোকার ডাক
হারিয়ে যাওয়া বন্ধর মুখ
কেউ জানেনা কোনোকিছু
মাস্টার মশাইয়ের পান্ডিত্যভরা মুখ খুব মনে পড়ে
‘ক-তে কবিতা
জ-তে জীবনানন্দ দাশ’
আজও সেই বারান্দায়
একদিন মা আমার বাবার জন্য কেঁদেছিলেন খুব
সেদিনই প্রথম বুঝেছিলাম
প্রেমের চেয়ে অধিক নেই কিছু আর
কুয়াশার পাঁজর ঠেলে ঠেলে চিক চিক রোদ
লাজুক চোখ কাকে খোঁজে যেনে
কাকে?
অন্ধকারেও সে কী অপরূপা!
মায়া বাড়ে মায়া
শুধুই স্বর্গীয় প্রপাত
জীবনানন্দের বাড়ি কোথায়?
মায়াপুর।” (জীবনানন্দ, আউয়াল আনোয়ার,সাহিত্য পত্রিকা জীবনানন্দ, সম্পাদক মাসউদ আহমাদ)
কিছুদিন পূর্বে বরিশালে কবি জীবনানন্দের বাড়িটি দেখতে গিয়ে চরমভাবে হতাশ হয়েছি।আমার মতো অনেকেই এরকম হতাশ হয়েই ফিরে আসেন বোধহয়।অনেকেই গিয়ে ফোন করেন,কোথায় কবির বাড়ি?নেই,কিছুই নেই। শুধু ভিটেটুকু রয়েছে শুধু। সেটাও অন্যের দখলে।তবুও যখন পড়ন্ত বেলায় কবির ভিটেয় পা রাখলাম,একধরনের ভালোলাগা,শিহরন অনুভব করলাম পরানে।আমি ছুঁতে থাকলাম বাড়িটির মাটি,লতাগুল্ম ইত্যাদি।কথা বলতে থাকলাম কবির সাথে।বেদনার মলাটজুড়ে মূহুর্তেই সবকিছু জীবনানন্দময় হয়ে উঠলো আমার কাছে।আহা!জীবনানন্দ, ঝরাপালকের কবি জীবনানন্দ।
বাড়িটির প্রবেশদ্বারে শুধু লেখা রয়েছে “ধানসিড়ি”।আমি বসে পড়লাম তার নীচে।কবি নিশ্চয়ই এ পথেই বাড়িটিতে ঢুকতেন?সেখানেও এখন ময়লার স্তুপ।কর্তৃপক্ষের কি কিছুই করার নেই?পৃথিবীর সব ক’জন শক্তিশালী কবির মধ্যে জীবনানন্দ একজন। বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ একজন কবি,কবিদের কবি তিনি।তার স্মৃতিময় বাড়িটির এমনতো হবার কথা নয়।জীবদ্দশায় দুঃখ আর কষ্টকে লালন করে মৃত্যুর পরে তার স্মৃতিময় ঠিকানার এমন ভঙ্গুর দশা কীভাবে মেনে নিই?
জীবননান্দ দাশের কানাডা সফর
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
চার ঋতুর দেশে কার্তিক, হেমন্ত নেই!
আরো বিষণœ হয়ে ঠান্ডা চায়ের দিকে তাকালেন, তিনি।
আমি তাঁর গাইড, সফরসঙ্গী।
শহর থেকে দূরে তাঁকে নিয়ে গেলাম নায়গ্রা পার্কে
পাতা বাহারী ফলে, হুলি উৎসবে।
কিন্তু লাল-হলুদ-কমলা পাতাদের চোখ ধাঁধানো কালারফুলে মুগ্ধ না হয়ে
ঝরাপাতা অর্থাৎ শুকনো মেপল লিপে মগ্ন হলেন, তিনি!
এতো তুমুল তীব্র শীত! কনকনে হিমেল হাওয়া
মাইনাস টুয়েন্টি টু। ঘন কুয়াশার মতো ঘন স্নো ঝরছে, ঝরছে
অথচ কুয়াশা নেই; শিশির নেই।
টলমল ঝুলছে বরফ চুয়ানো কাঁচের শক্ত শিশির
আবারো দীর্ঘ নি:শ্বাস ছাড়লেন, তিনি!
বরফের পাহাড় দেখে মনে মনে ভাবছেন, তিনি-
আমাদের লাশকাটা হিমঘরে বরফের অভাব
চাঁদপুরে ইলিশ পঁচে যাচ্ছে!
টরন্টোর ডাউন টাউনে ট্রাম দেখে অদ্ভূতানন্দে অভিভূত, তিনি
স্ট্রিট কারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন—
ট্রামে কলকাতা চলে যাই। ২২ অক্টোবর আমাকে ফিরতে হবে!
The post শ্রীচরণকমলেষু জীবনানন্দ দাশ appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3e0VAVd
No comments:
Post a Comment