Sunday, October 25, 2020

সুবাস ছড়ানো ছাতিম বিলুপ্তির পথে https://ift.tt/eA8V8J

এসএম শহীদুল ইসলাম: হেমন্তের গোধূলি লগ্ন থেকে রাত অবধি তীব্র মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে বাতাসকে সুবাসিত করে ছাতিম ফুল। ছাতার মতো আকৃতির পুরো গাছটির গুচ্ছবদ্ধ সবুজাভ সাদা অসংখ্য ফুল নজর কাড়ে অনেকের। অল্প বাতাসেই ছোট ছোট ফুলে ভরে যায় গাছতলা। শীতের আগে ফোটা সর্বশেষ ফুল ছাতিম। শীতের আগে সাধারণত আর কোন ফুল ফুটতে দেখা যায় না।

ছাতিম অঢ়ড়পুহধপবধব গোত্রের উদ্ভিদ। সারাবিশ্বে এর প্রায় ৪০-৬০টি প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বড় বড় যে ছাতিম গাছ দেখা যায় সেটির বৈজ্ঞানিক নাম অষংঃড়হরধ ংপযড়ষধৎরং.
ছাতিম গাছের পত্রটি যৌগিক পত্র। এর বৃন্তের গোড়ায় পাঁচ থেকে আট-নয়টি পর্যন্ত পত্রক থাকে। তবে সাধারণত এতে সাতটি পত্রক থাকায় সংস্কৃত ভাষায় একে সপ্তপর্ণ বা সপ্তপর্ণী উদ্ভিদ বলে। বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে এটিকে ছাতিয়ান, ছাইত্তান, ছাইত্তান্না বা ছাতিম নামে ডাকা হয়।

উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে, ছাতিম গাছকে ইংরেজিতে ডেভিল’স ট্রি বলে। নামটি বাংলা করলে দাঁড়ায় শয়তানের গাছ। এ শয়তান শব্দটি অঞ্চলভেদে বিকৃত হয়ে ছয়তাইন্যা গাছ কিংবা ছাতিয়ান, ছাইত্তান, ছাইত্তান্না গাছ নামে ডাকা হয়।
ছাতিম গাছে হেমন্তে ফুল ফোটে। খানিকটা দূর থেকেই ছাতিম ফুলের তীব্র ঘ্রাণ টের পাওয়া যায়। রাতে সে ঘ্রাণ হয় আরও তীব্র।

ছাতিম গাছের ডাল-পাতা ছাতার মতো ছড়ানো। এ জন্যই বোধহয় এর নাম হয়েছে ছাতিম। ছাতিমের মতো শোভাময়ী একটা গাছকে ইংরেজরা কেন যে শয়তানের গাছ বললো, তা বোধগম্য নয়। ছাতিম গাছ ছায়া দেয়, উদ্যান ও পথের শোভা বাড়ায়, থোকা ধরে প্রচুর ফুলও ফোটে। ফুলের পাগল করা মদির গন্ধে প্রচুর মৌমাছিও জোটে। তবে ফুল নয়, এ গাছের কদর এককালে ছিল অন্য কারণে। এর কাঠ দিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ড তৈরি হতো। বিদ্যাদানের কাজে ব্যবহারের জন্য হয়তো আপোসাইনেসি পরিবারের এ গাছটির প্রজাতিগত নাম অষংঃড়হরধ ংপযড়ষধৎরং এর শেষাংশ হয়েছে স্কলারিস। ছাতিম গাছ ১৫ থেকে ৩০ মিটার উঁচু হয়। পাতা বেশ বড়, উপর পিঠ সবুজ, নিচের পিঠ সাদাটে। ডালের মাথায় থোকা ধরে সাদাটে ফুল ফোটে। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ফুল ফোটে।

বাংলাদেশের সর্বত্র আগে ছাতিম গাছ দেখা যেত। নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে ছাতিম গাছ এখন বিপন্ন প্রজাতির।
এর আদি বাসস্থান পূর্ব এশিয়ার চীন, ভারত, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং অস্ট্রেলিয়া। এমনকি এটি আফ্রিকায়ও দেখা যায়।
ছাতিম গাছকে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণ সম্পর্কে উদ্ভিদ তত্ত্ববিদরা বলেন, গাছটির তেমন বাণিজ্যিক মূল্য নেই। এ গাছের ফুল ও ফল বন্যপ্রাণি বিশেষ করে বানর-হনুমানরা খায়। কাঠেরও তেমন বাণিজ্যিক মূল্য নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে ছাতিম গাছের কাঠকে বলা হয় ‘হোয়াইট চিজ উড’ বা শ্বেত নমনীয় কাঠ। জ্বালানি, হালকা আসবাবপত্র, লেখাপড়ার ব্ল্যাকবোর্ড, দিয়াশলাইয়ের বাক্স প্রভৃতি তৈরিতে ছাতিম গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়।
আমাদের দেশে গাছ অযতœ অবহেলায় বড় হলেও পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য উদ্ভিদ হিসেবে সম্মান দেওয়া হয়েছে ছাতিম গাছকে। তবে ভারতেও আগের মতো ছাতিম গাছ আর দেখা যায় না।
বাংলা সাহিত্য ও কবিতায় গুরুত্বসহকারে ছাতিম গাছের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে গাছটিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

সাহিত্যানুসন্ধানে জানা যায়, শান্তিনিকেতন পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুরে একটি আশ্রম ও শিক্ষাকেন্দ্র। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজের উপাসনার জন্য রায়পুরের জমিদার প্রতাপ নারায়ণের আমন্ত্রণে রায়পুরে যান। সে সময় বোলপুরের এ স্থানটিতে দুটি ছাতিম গাছ দেখে তার নিচে বিশ্রাম নেন তিনি। সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশে তার মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। সেখানে তিনি তার ‘প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি’ লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে ২০ বিঘা জমি নিয়ে একটি দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বাড়িটির নাম দেন ‘শান্তিনিকেতন’। সেই থেকে এ অঞ্চলটি শান্তিনিকেতন নামে পরিচিত।

ইন্টারনেট তল্লাসী করে জানা যায়, সেকালের ছাতিম গাছ দুটি মরে যাওয়ার পর ওই একই জায়গায় আরও দুটি ছাতিম গাছ রোপণ করা হয়। গাছ দুটিকে কংক্রিটের ঘের দিয়ে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। দক্ষিণ দিকের গেটে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি’ কথাটি লেখা রয়েছে। পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা ছাত্র-ছাত্রীদের সপ্তপর্ণী তথা ছাতিম গাছের পাঁচটি পাতার গুচ্ছ উপহার হিসেবে দেওয়া হয়।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় এ গাছটির নামে রয়েছে একটি গ্রাম। গ্রামটির নাম ‘ছাতিয়ান তলা।’ শহরের ইটাগাছা বাঙালের মোড়ে পুষ্পে পুষ্পে শোভা ও গন্ধ বিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছাতিম গাছ। এছাড়া গ্রাম-গ্রামান্তরেও গাছটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তবে গাছটির বাণিজ্যিক মূল্য ও কদর না থাকায় ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে।

ছাতিম চিরসবুজ বৃক্ষ। গাছের পুরু ছালের ভিতরটা সাদা ও দানাযুক্ত, উপরটা খসখসে, গোটা গাছে সাদা দুধের মতো আঠা আছে। গাছটিতে শীতকালে সরু বরবটির মতো ফল হয়।

উইকিপিডিয়ায় ছাতিমের ওষুধি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে। ছাতিমের কষ বা আঠা অনেকে ঘা বা ক্ষতে লাগিয়ে থাকেন। এর বাকল বা ছাল ওষুধের কাজে ব্যবহার করা হয়। দীর্ঘস্থায়ী আমাশয়ে এটি অত্যন্ত উপকারী। জ্বর ধীরে ধীরে নামায় বলে ম্যালেরিয়াতেও উপকারী। চর্মরোগেও ছাতিম ফলপ্রদ। বাণিজ্যিক মূল্য নেই বলে ছাতিমকে কেউ তাদের বাগানে বাড়ির পাশে কিংবা রাস্তার ধারে লাগায় না। নার্সারিতেও ছাতিম গাছের চারা পাওয়া যায় না। অযতেœ অবহেলায় গাছটি বেড়ে ওঠে। জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় গাছটি রক্ষণাবেক্ষণ করা জরুরি।

The post সুবাস ছড়ানো ছাতিম বিলুপ্তির পথে appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3jtZPJS

No comments:

Post a Comment