Friday, December 4, 2020

সাতক্ষীরার বহুল আলোচিত কৃষক নেতা সাইফুল্ল¬াহ লস্করের আজ ১১ম মৃত্যু বার্ষিকী https://ift.tt/eA8V8J

পত্রদূত রিপোর্ট: ‘আমার স্বামী সাইফুল্লাহ লস্কর ছিলেন খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার আন্দোলনের নেতা। তিনি তার জীবদ্দশায় শুধু ভূমিহীনদের জন্য নয়, সাধারণ মানুষের অধিকার আন্দোলনে কাজ করে গেছেন। কৃষকের সার, ডিজেল ন্যায্য মূল্যে পাওয়ার অধিকার ও উৎপাদিত পাট, ধানসহ কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম করে গেছেন। এ কারণে ভূমিদস্যু, রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের একাংশ তার উপর ক্ষুব্ধ ছিল। এরই জের ধরে ২০০৯ সালের ৪ ডিসেম্বর ভোর রাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বাড়ির বাইরে নিয়ে তাকে হাত, পা ভেঙে শ্বাসরোধ করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। স্বামীর হত্যাকারিরা কোনদিনও শাস্তি পাবে এটা আমি কখনো মনে করি না। তাই যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন স্মৃতিচারণ করাটা ছাড়াই আর উপায় কি।’
শুক্রবার এক সাক্ষাৎকারে প্রয়াত কৃষক নেতা সাইফুল¬াহ লস্করের ১১তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে বর্তমান ভাবনা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে নিহতের অসুস্থ স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার (৬৬) সাংবাদিকদের কাছে এভাবেই তার আর্তি জানান।
এদিকে সাইফুল্ল¬াহ লস্করের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি আজ শনিবার সকাল ১০টায় মরহুমের কবর জিয়ারত ও বিকেল ৩টায় তালা উপজেলার ডাক বাংলো চত্ত্বরে স্মরণসভার আয়োজন করেছে। সাতক্ষীরা জেলা ভূমিহীন সমিতি, ভূমিহীন উন্নয়ন সমিতি ও নাগরিক সমাজ মরহুমের কবর জিয়ারতসহ বিভিন্ন স্থানে স্মরণসভার আয়োজন করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ শনিবার সকালে মরহুমের মাজার জিয়ারত করবেন।
ভূমিহীন জনপদের একাধিক সূত্রে জানা যায়, দেবহাটার নোড়ারচকে ভূমিদস্যুদের ইজারাকৃত জলমহল ভূমিহীনরা দখলে নেওয়ায় ভূমিদস্যুরা পুলিশ প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে। তারা সাতক্ষীরা থেকে ভূমিহীন আন্দোলন মুছে ফেলার জন্য শহরের একটি বাগান বাড়িতে দফায় দফায় বৈঠক করে। ২০০৯ সালের ৩ ডিসেম্বর রাতে তৎকালিন দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তারা আগে থেকেই সাইফুল্ল¬াহ লস্করের হত্যার মিশনের পরিকল্পনা করেছিলেন বলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করে আসছেন। নিজেকে নির্র্দোষ প্রমান করতে ৪ ডিসেম্বর তৎকালিন সাতক্ষীরার এক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা বেড়ানোর কথা বলে সাতক্ষীরার তৎকালিন আরেক জেলা কর্মকর্তাকে নিয়ে কালীগঞ্জের বন্দকাটি গ্রামের কুখ্যাত হরিণ শিকারীর লঞ্চে সুন্দরবনে রাত কাটিয়েছিলেন। রাতে তার সহযোগি পাতাখালির কুখ্যাত এক হরিণ শিকারী প্রশাসনের দু’কর্মকর্তার তাস খেলার অংশীদার ছিলেন বলে একটি দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করে। সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের দু’জেলা প্রধানের একইসাথে সুন্দরবন বিহার সাতক্ষীরার জন্য সেটাই ছিল প্রথম।
২০০৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ভোররাত তিনটার দিকে সাতক্ষীরা শহরের কাটিয়া পুলিশ ফাঁড়ির প্রশিক্ষণরত উপপরিদর্শক (টিএসআই) নজরুল ইসলাম ও সিপাহী শাহজালাল (কংনং-২৪৮) কৃষক সংগ্রাম সমিতির সহ-সভাপতি ও জেলা ভূমিহীন সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সাইফুল¬াহ লস্করকে কাটিয়া লস্করপাড়ার নিজ বাড়ি থেকে বাইরে ডেকে আনেন।
পরদিন ভোরে আকবর লস্করের বাড়ির পুকুর পাড়ে কাঠ ও বিচালী রাখার ঘরের মধ্যে সাইফুল্ল¬াহ লস্করের রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় সদর থানার উপ-পরিদর্শক মনোয়ারা খাতুন ২০০৯ সালের ৫ ডিসেম্বর থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা (৯২/২০০৯নং) করেন। মামলার তদন্তভার সদর থানার উপ-পরিদর্শক আব্দুস সবুরের (বর্তমানে প্রয়াত) উপর ন্যস্ত হয়। ৬ ডিসেম্বর রাতে জেলা জাপা নেতা ও ভূমিহীনদের পৃষ্টপোষক এড. আব্দুর রহিমকে আহবায়ক ও বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাতক্ষীরা শাখার সম্পাদক বর্তমানে সাংসদ অ্যাড. মুস্তাফা লুৎফুল¬াহকে সদস্য সচিব করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট সাইফুল্ল¬াহ লস্কর হত্যার বিচার বাস্তবায়ন সংগ্রাম ও সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। হত্যাকারিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে পরদিন সকালে বিভিন্ন সংগঠনের ডাকে আপামর জনতা শহীদ আলাউদ্দিন চত্ত্বরে অবস্থান ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। এতে সারা সাতক্ষীরা অচল হয়ে পড়ে। জনগণের আই ওয়াশ করতে কাটিয়া পুলিশ ফাঁড়ির শিক্ষানবীশ উপ-পরিদর্শক নজরুল ইসলামকে পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করা হয়।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের তৎকালিন আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মধুসূধন ম-ল ময়না তদন্তে সাইফুল্লাহ লস্করকে নির্যাতনের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন দেন। নিহতের স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার বাদি হয়ে দায়ের করা এজাহারটি ৬ ডিসেম্বর থানায় জমা দিলে তা হত্যা মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়। কাটিয়া পুলিশ ফাঁড়ির শিক্ষানবীশ উপপরিদর্শক (টিএসআই) নজরুলসহ দু’জন পুলিশ ২০০৯ সালের ৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাত তিনটার দিকে সাইফুল্ল¬াহ লস্করকে তার বাড়ি থেকে ডেকে আনেন বলে মামলায় উল্লে¬খ করা হয়। পুলিশ ও সুবিধা বঞ্চিত ভূমিদস্যুরা সাইফুল¬াহ লস্করকে হত্যা করেছে মর্মে মামলায় বলা হয়। এছাড়া ঘটনার রাতে পুলিশ ও সাদা পোশাক পরিহিত কিছু লোকজন সাইফুল্ল¬াহ লস্করের বাড়ির আশে পাশে অবস্থান করছিল বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। মামলার তদন্তভার সাতক্ষীরা সদর থানার উপপরিদর্শক সরদার মোশাররফ হোসেনের উপর ন্যস্ত করা হয়। সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়না তদন্ত প্রতিবেদন একটি স্থানে গরমিল দেখা দেওয়ায় তৎকালিন সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার এসএম মনিরুজ্জামান ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর চার সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত টিম গঠন করেন। ২০ ডিসেম্বর ওই কমিটি তদন্ত প্রতিবেদনে সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের একটি অংশে জখমীর স্থান নিয়ে ভিন্নতা তুলে ধরেন। পুলিশ ২০০৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর কালীগঞ্জের চম্পাফুল ইউপি চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক (৬৩) ও ২০১০ সালের ৩০ জুন সাতক্ষীরা শহরের থানাঘাটার আবু সাঈদ (৫৮) ওরফে নাক কাটা সাঈদকে গ্রেপ্তার করে রিমা-ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি হাইকোর্ট থেকে তৎকালিন জেলা যুবদল নেতা নাসিম ফারুক খান মিঠু ও আশাশুনির শোভনালী ইউপি’র তৎকালিন চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম চার সপ্তাহের জন্য অর্ন্তবর্তীকালিন জামিন নেন। একই সময়ে সাতক্ষীরার বহুল আলোচিত ভূমিদস্যু আশাশুনির সরাফপুরের বসির আহম্মেদ ও আলীপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ একইভাবে হাইকোর্ট থেকে চার সপ্তাহের জন্য জামিন গ্রহণ করেন। পরে তারা আর জামিনের আবেদন বাড়ান নি। এমনকি আদালতের নির্দেশে নি¤œ আদালতে তারা আত্মসমর্পণ করেননি।
একপর্যায়ে মামলাটি হিমাগারে পাঠাতে বাদির আবেদন ছাড়াই সদর থানার তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসএম কামরুজ্জামান তৎকালিন জেলা পুলিশ সুপার এসএম মনিরুজ্জামানের মাধ্যমে ২৩ ডিসেম্বর ঢাকাস্থ পুলিশের গোয়ন্দা, অপরাধ ও তদন্ত শাখায় মামলার তদন্তভার স্থানান্তরের জন্য পাঠান। ৩০ ডিসেম্বর তদন্তভার ওই বিভাগেই ন্যস্ত হয়। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি পুলিশের গোয়েন্দা, অপরাধ ও তদন্ত সাতক্ষীরা শাখার পরিদর্শক আমির হোসেন আমু তদন্তভার বুঝে নেন। ৩১ জানুয়ারি সংস্থার খুলনা বিভাগীয় পুলিশ সুপার (সিআইডি) আব্দুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে বাদিকে বিভিন্নভাবে হুমকি ধামকি দেন। এ ঘটনায় পরদিন সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১২ সালের ১০ ডিসেম্বর মামলার তদন্তভার একই সংস্থার একই শাখার উপপরিদর্শক লস্কর জায়াদুল হকের (বর্তমানে পিবিআই এর সাতক্ষীরা শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) উপর ন্যস্ত করা হয়। ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর মামলার তদন্তভার একই সংস্থার বাগেরহাট শাখার পরিদর্শক সাইফুল ইসলামের উপর ন্যস্ত করা হয়। তদন্তকালে সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে বাদি ও তার স্বজনদের বিভিন্নভাবে হয়রানির অভিযোগ ওঠে।
মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা হাইকোর্ট থেকে চার সপ্তাহের মেয়াদে জামিনে থাকা ভূমিদস্যুদের সন্ধিগ্ধ আসামী হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেপ্তার না করে আদালতে দায়সারা জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন জানিয়েই তার দায়িত্ব শেষ করেন। সাড়ে চার বছরে সাতজন তদন্তকারি কর্মকর্তা পরিবর্তন করার পর মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করা হয়। ফলে অধরাই থেকে গেছে ভূমিহীন কৃষক আন্দোলনের নেতা সাইফুল্লাহ লষ্করের হত্যাকারীরা।

The post সাতক্ষীরার বহুল আলোচিত কৃষক নেতা সাইফুল্ল¬াহ লস্করের আজ ১১ম মৃত্যু বার্ষিকী appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/36GLSFu

No comments:

Post a Comment