সৈয়দ নূরুল আলম
রায়না সেদিন আনোয়ারের বাসায় টিফিনক্যারিয়ার রেখে এসেছিল। আনোয়ার ভাবে ওটা কীভাবে ফেরত দেবে। খালি টিভিনক্যারিয়ার ফেরত দেয়া ঠিক হবে? ওর মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। রায়নাকে সারপ্রাইজ দেবে। সকালে ও বেশি করে ভাত রান্না করে, ভাতে পানি দিয়ে রাখবে। সন্ধ্যায় সেই পানি ভাত, সাথে মরিচ পোড়া, পেয়াজ, ইলিশ মাছ ভাজা, বেগুন ভর্তা এসব নিয়ে রায়নার বাসায় যাবে। যেয়ে বলবে, তোমার টিফিনক্যারিয়ার নিয়ে এলাম।
আনোয়ারের হাতে টিফিনক্যারিয়ার দেখে মিসকি হাসে রায়না। হেসে বলে, ওটা ছাড়া কি আসা যায় না? কোনো একটা অজুহাত নিয়ে আসতে হবে?
‘তাতে হাসির কী হলো।’
‘আমার এখানে আসতে, কোনো অজুহাত লাগবে না। যখন মন চাইবে, কারণে-অকারণে চলে আসতে পারো।’
‘তা তো ঠিকই।’
‘আচ্ছা, আমরা আগের মতো, ভার্সিটিতে থাকার সময়ের মতো, বন্ধু হয়ে যেতে পারি না? শুধুই বন্ধু?’
আনোয়ার কিছু বলে না। আনোয়ার রায়নার দিকে চেয়ে, রায়নাকে দেখে। আজ ও শাড়ি পড়েছে। সবুজ শাড়ির সাথে লাল ব্লাউজ। লম্বা চুল পিঠ পর্যন্ত ছড়ানো। ব্লাউজের সাথে মিলিয়ে লাল টিপ পড়েছে। ঠোঁটে খয়েরি লিপষ্টিক। কানে ছোট এয়ার রিং। হাত খালি। আজ এমন করে সাজার কোনো কারণ আনোয়ার খুঁজে পায় না।
রায়না টিভিনক্যারিয়ার ধরে বলে, এটা এত ভারি কেন? কী আছে এতে?
‘খুলে দেখ।’
রায়না টিভিনক্যারিয়ার খুলে সত্যি সত্যি অবাক হয়। যতটা আনোয়ার ভেবেছিল, ঠিক ততটা।
‘আজ তো বাংলা নববর্ষ না।’
‘ ভেবে নিই, আজ নববর্ষ। ক্যালেন্ডারের দিক থেকে না হলেও, যদি বলি মনের দিক থেকে।’
‘তাতো ভাবা যায়। কতো কিছুই তো ভাবা যায়। এখন তুমি যদি ভাবো, আজ রাতের জন্য আমি তোমার বউ, কি ভাবা যায় না?’
আনোয়ারের ভেতরটা দেখার জন্য রায়না কথাটা বলে। তারপর কী উত্তর দেয়, সেটা শোনার জন্য আনোয়ারের মুখের দিকে হা করে চেয়ে থাকে ।
আনোয়ার মাথা চুলকায়। অকারণে নাকে হাত দেয়। দেয়ালে টানানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে। তারপর বলে, প্লেট আনো দু’জনে মজা করে পান্তা খাই।
রায়না খেতে খেতে বলে, এতকিছু তুমি করলে কী করে। তোমার তো আর বউ লাগবে না।
‘বউ কি শুধু রান্না-বান্নার জন্য?’
‘আর কী কাজে লাগে? সন্তান উৎপাদন? সেটা তো তুমি করে ফেলেছ।’
‘আচ্ছা একটা কথা বলোত। তোমরা নিচ্ছ না কেন? রিফাত বলেছিল, কোথাও সেটেল্ড হয়ে, তারপর। তো এখন –।
‘তোমার বন্ধু তোমাকে একথা বলেছে? তোমরা এসব বিষয় নিয়েও কথা বলো?’
‘একদিন কথায় কথায় ও বলেছিল, এখানে ওখানে পরিযায়ী পাখির মতো ঘুরছি, ঢাকা বা কোথাও সেটেল্ড হতে পারলে–।’
‘তাই বুঝি?’ রায়না একটু বক্র হাসি হাসে।
‘কী কথাটা ঠিক?’
‘আমার কাছ থেকে সত্যতা যাচাই করছ? তোমার বন্ধুর কথার ওপর তোমার আস্থা নেই?’
‘আমি বলেছিলাম এটা একটা কারণ?’
‘রিফাত কী বলল?’
‘রিফাত বলল, তুমিই এমনটা চাও।’
‘বাদ দাও, ওসব কথা। চুপচাপ খাও।’
‘খেতে খেতে গল্প করলে, খাবার হজম হয় ভালো।’
রায়না আনোয়ারের পাতে একটুকরো ইলিশ তুলে দিয়ে বলে, তুমিতো কিছুই নিচ্ছো না। ভাবছ, নিজে না খেয়ে, আমাকে খাইয়েই তোমার আনন্দ?’
‘যারা রাধে, তারা অন্যকে খাইয়েই আনন্দ পায়, ঠিক না? যেমন সেদিন তুমি আমাকে বিরিয়ানি খাইয়ে আনন্দ পেয়েছিলে।’
‘তুমি কী আজ শোধ দিতে এসেছ? তা হলে খাব না।’ রায়না ভাতের থালা থেকে হাত গুটিয়ে নেয়।
‘আরে তা কেন, এখানে শোধের কথা আসবে কেন? আর একটা কথা জেনে রেখ, তোমার সব না বলা কথা আমি বুঝতে পাই। তোমার সব স্পর্শ আমি টের পাই। তুমি ভেবো না, আমি অনুভুতিহীন? নির্জীর?’
রায়না কিছু সময় আনোয়ারের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর আবার খাওয়া শুরু করে। শুটকি ভর্তা পাতে তুলে নিয়ে বলে, তোমার সবকিছু খুব ভালো হয়েছে। আর তুমি এরকম একটা আয়োজন করবে, তা আমার কল্পনায় ছিল না। ধন্যবাদ, আলাদা স্বাদ দেয়ার জন্য।
‘ধন্যবাদ।’
‘তোমাকে আমি আলাদা একটা স্বাদ দিতে পারি, নেবে? সম্পূর্ণ অন্য রকম।’
‘কেন নয়? তুমি দেবে আর আমি নেব না, তা হয়?’
‘তা হলে, খাওয়া শেষ কর। তারপর।’
‘ওকে।’
আনোয়ার রাজি হওয়াতে রায়না খুব খুশি হয়। রায়নার মুখ দেখে আনোয়ার সেটা বুঝতে পারে। খুশি খুশি মুখ দেখতে আনোয়ারের খুব ভালো লাগে। একজন মানুষকে খুশি করতে পারা, একটি নেকির সমান, আনোয়ার সেটা মনে করে ।
দু’জনের খাওয়া শেষ হলে, রায়না টিভিতে একটা মুভি ছাড়ে। গত কয়েক দিন রায়না একা একা মুভি দেখেছে। একা দেখে তেমন আনন্দ পায়নি। আজ আনোয়ার আছে, রায়না বেছে বেছে সুন্দর, ভারতের ফিল্ম এ্যাওয়ার্ড পাওয়া একটি মুভি বের করে।
‘মুভি দেখতে, দুই-আড়াই ঘণ্টা লাগবে। ওত সময় হবে।’
‘ কেন, তোমার রাতে আবার কাজ কী।’
‘না। রিফাত আবার তোমাকে ফোন করবে না? প্রতি দিন বারটার সময় করে।’
রায়না শব্দ করে হাসে। বলে, আজ তুমি সামনে থেকো।
‘ তোমাদের মধ্যে আবার আমি কেন?’
রায়নার মুখে আবার সেই হাসি।
‘হাসছ যে?’
‘তুমি কিছু বোঝনি?’
‘না।’
‘তোমার বউয়ের সাথে ইমোতে কথা বলো না।’
‘ তোমাকে তো বলেছি আমার হোটসএ্যাপ-ইমো, কোনো একাউন্ট নেই। কীভাবে খুলতে হয় তা-ই জানি না।’
‘ঠিক আছে, একদিন শিখিয়ে দেব।’
‘দিও। তা খাওয়ার সময় কী যেন বলেছিলে?’
‘মুভিটা দেখতে থাকো। আরেকটু রাত হোক। না হলে মজা নেই।’
আনোয়ার, রায়নার রহস্যপূর্ণ কথা বুঝতে পারে না। ভাবে, এমন কিছু করবে কী, যা তার ঘোরতর আপত্তি! ওদিনের মতো, ও কি পিছে আসবে ? সেদিন রায়নাকে দুঃখ দিয়েছে, কতোদিন এভাবে দুঃখ দিয়ে থাকতে পারবে?
আনোয়ার ভেবেছিল, ওদিনের পর রায়না দূরে সরে যাবে। আর কথা-ই বলবে না। কোনো সম্পর্কই রাখবে না। কিন্তু এরপরও সহজ থেকেছে। সহজ ভাবে সবকিছু মেনে চলছে। আজ–।
‘কি ভাবছ? তোমাকে অনেক ভাবনায় ফেলে দিয়েছি?’ ভাবছ, ভুল করে রাজি হয়ে গেলাম। কী না কী?’
‘আরে না, না। ভাবব আবার কী?’ আনোয়ার জোর করে হাসার চেষ্টা করে।
‘তা হলে, বলে ফেলি। দু’জনে মিলে কিছু খাব। তোমাকে আগে বলেছিলাম না, রিফাত রেগুলার খায়। আজ খাব।’ কথাগুলো বলে রায়না ফ্রিজ থেকে দু’টো বোতল বের করে, আনোয়ারের সামনে রাখে, সাথে কিছু বাদাম, বরফ।
‘আনোয়ার অবাক মুখে বলে, তুমি এসব খাও?’
‘ও যখন খায়, তখন তো একটু সঙ্গ দিতে হয় বৈকি।’
‘আমি তো এসব খাই না।’
‘খাও না, আজ খাবে। পুরুষ মানুষ, এটা খাই না, ওটা করি না। শুধু না-না বললে চলে?
‘আমি যা না, তা- তো বলব।’
‘কিন্তু মানুষ পাল্টায় না? তুমি পাল্টাতে পারো না?’
‘সরি। রায়না।’
‘ওকে, আমি তোমাকে জোর করব না। আমি একটু খাই। তুমি আমার সামনে একটু বসে থাকো। এ অনুরোধটা অন্তত রাখো।’
রায়না গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে চুমুক দেয়।
আনোরার রায়নাকে দেখে। কীভাবে গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে পানি মেশায়, সেটা দেখে। তারপর কীভাবে একটু একটু করে হুইস্কি খায়, তা দেখে।
রায়না খেতে খেতে বলে, খুব বেশি খাই না। খেয়ে মাতাল হবো না। ভয় পেয়ো না।
রায়না মুখে একথা বললেও এক গ্লাস শেষ করে, আরেক গ্লাস ঢালতে থাকে।
আনোয়ার অসহায়ের মতো রায়নার সামনে বসে থাকে।
রায়না শূন্যে চিয়ার্স বলে, আরেক ঢোক খেয়ে বলে, সব মিথ্যে । সব মিথ্যে। রিফাত তোমাকে মিথ্যে বলেছে। ও কোনো দিন বাবা হতে পারবে না। ও অপুষ্পক গাছ। ও গাছে কোনো দিন ফুল ফুটবে না।
রায়না দ্বিতীয় গ্লাস শেষ করে, তৃতীয় গ্লাস ঢালতে গেলে, আনোয়ার রায়নার হাত ধরে থামিয়ে দেয়। বলে, প্লিজ আর খাবে না। অনেক খেয়েছ।
‘আর সামান্য একটু খাই? আমি অন্য সময় তোমাকে আমার কথাগুলো বলতে পারিনি। তাই এখন বলছি। আর না খেলেত বলতে পারব না।
রায়না আনোয়ারের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আরেক ঢোক খেতে খেতে বলে, আমি ভালোবাসলাম তোমাকে, আর তুমি আমাকে চাপিয়ে দিলে রিফাতের ঘাড়ে। ও আমাকে কী দিল। না দিলো কোনো আগামী । না দিলো গোলাপের সুবাস। শুধুই লাল জবা, যার কোনো গন্ধ নেই।
রায়না কিছু সময় থেমে আবার বলে, এর জন্য কে দায়ি? বলো! বলো!
আনোয়ার বুঝতে পারে আর খেলে, কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাবে। তাই আনোয়ার জোর করে রায়নার কাছ থেকে বোতল- গ্লাস কেড়ে নিয়ে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে।
রায়না ছোপা থেকে উঠতে যেয়ে, পড়ে যেতে চায়। আনোয়ার দ্রুত রায়নাকে দু হাতে ধরে, বেডরুমে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। রায়না মরার মতো বিছানায় পড়ে বিড় বিড় কওে বলতে থাকে আমি তোমাকেই ভালোবাসি। তুমিই আমার প্রথম প্রেম। প্রথম পুরুষ। এ অবস্থায় রায়নাকে রেখে কীভাবে আনোয়ার নিজের ফ্লাটে যায়। ও ড্রয়িং রুমে যেয়ে বসে থাকে। রায়না সারা রাতে আর ওঠে না। আনোয়ার বেডরুমে যেয়ে উকি দিয়ে দেখে আসে রায়না গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আনোয়ার রাতটা ড্রয়িং রুমে কাটিয়ে দেয়।
The post রবিবারের নৈঃশব্দ্য বিকেল appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3ptbTid
No comments:
Post a Comment