Tuesday, October 27, 2020

বঙ্গবন্ধুর চিঠি-ই তার সম্বল, মেলেনি শহীদ স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি: মৃত্যুর আগে বঙ্গবন্ধু কন্যার সাক্ষাৎ চান বিধবা বৃদ্ধা আমেনা বিবি https://ift.tt/eA8V8J

সামিউল মনির, শ্যামনগর: বঙ্গবন্ধুর মেয়ের সঙ্গে এটটু দেখা করতি চাই। এটাই আমার শেষ ইচ্ছা। আমার মনে বিশাল কষ্ট। কথাগুলো বলতেই ভারী হয়ে যায় সত্তোরোর্ধ্ব বয়সী আমেনা বিবির কন্ঠ। জড়তা কাটিয়ে কয়েক মুহূর্ত পর আবারও শুরু করেন, অগ্রায়হণ মাসে দেশ স্বাধীন হুয়োলো। তার আগে কার্তিক মাসের এগার তারিখে রাজাকাররা আমার স্বামীর ডেকে নে গুলি করে মেরে ফেললো। বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের সাহেবকে এগিয়ে দিতি গে রাজাকারগো নজরে পুড়েলো ও লোক। আর ওটাই তার জন্যি কাল হুয়ে দাঁড়িয়োলো-যোগ করেন তিনি।

এবার নিজেকে আর কোনভাবে সামলে রাখতে পারে না বিধবা বৃদ্ধা। নাতিকে জড়িয়ে ধরে গলা ছেড়ে অঝোঁরে কাঁদতে শুরু করেন তিনি। কিছু সময় পরে পরিবারের সদস্যদের বুঝপাটে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা আমেনা জানান বিয়ের তিন বছরের মধ্যে স্বামীকে হারিয়েছিলেন। ২০০২ সালে একমাত্র মেয়েকে হারনোর পর এখন নিজের বিদায়ের ক্ষন গুনছেন। জীবনের এমন অন্তিম সময়ে এসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করাই তার শেষ ইচ্ছা।
সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা গ্রামে নাতি মহিবুল্লাহ গাজীর বাড়িতে এখন বসতি পাশর্^বর্তী কোদন্ডা গ্রামের শহীদ কাশেম মোল্যার স্ত্রী বৃদ্ধা আমেনার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পুর্বমুহুর্তে রাজাকারদের হাতে নির্মমভাবে স্বামী শহীদ হওয়ার পর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ব্রেণ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মেয়ে রাবেয়ার মৃত্যুর পর থেকে নাতি মহিবুল্লাহর বাড়িতে অবস্থান তার।

আমেনা বেগম জানান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে স্বামী কাশেম বন্ধুদের সাথে মিলে তথ্য আদান প্রদানসহ মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন কাজে সহায়তা করতেন। কোলে সদ্যজাত সন্তানের কথা বলেও তাকে আটকে রাখা যেত না। সন্তানকে দেখার জন্য মাঝেমধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়িতে ফিরলেও ‘বুকে সাহস রাখো, আমি বঙ্গবন্ধুর পাঠানো লোকদের সাথে থেকে দেশ স্বাধীনের চেষ্টা করতিছি’ জানিয়ে বেরিয়ে যেতেন কাশেম।

তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে দেখা করার জন্য তাদের এলাকায় আসেন। শেখ নাসেরকে নিরাপদ গন্তব্যে পৌছে দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে তার স্বামী কাশেম মোল্যাও ছিলেন। কার্তিক মাসের এগার তারিখ লুকিয়ে বাড়িতে ঢোকার সময়ে রাজাকরা তার স্বামীকে আটক করে গুলি করে হত্যার পর ধান ক্ষেতে লাশ ফেলে রাখে।

তিনি বলেন ভয়ে কেউ লাশ উদ্ধারে না যাওয়ায় শিয়াল কুকুরে খাওয়ার শংকায় এক দিন পর স্থানীয় কয়েক নারী ও পুরুষ জানাযা ছাড়াই স্বামীকে দাফন করে। সুযোগ না থাকায় তড়িঘড়ি করে তার (আমেনা) পরণের শাড়ি কাফনের কাপড় হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলেও জানান তিনি।
বিয়ের অল্প দিনের মধ্যে বিধবা হওয়ার কষ্ট বুকে নিয়ে একমাত্র সন্তানের সাথে ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল- জানিয়ে আমেনা বিবি বলেন, ভূমিহীন স্বামীর মৃত্যুতে সংসারে চরম দু:সময় ভর করে। দেশ স্বাধীন হলেও ভাগ্য পরিবর্তন না হওয়ায় স্বামীর অনুপস্থিতিতে কোলের সন্তান নিয়ে মানুষের বাড়িতে কাজ করে মুখের খাবার জোগাড় করেছেন তিনি। এসময় নিদারুন অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে রনজিৎ মন্ডল নামের স্থানীয় এক ব্যক্তির সহায়তায় বঙ্গবন্ধুর কাছে একটি ‘দরাখাস্ত’ লেখেন। যার ফলে ৬ এপ্রিল ১৯৭২ সালে জাতির জনক স্বাক্ষরিত সমবেদনা জানানো একটি চিঠির সাথে সিংএ ০৩৪০৫৩ নম্বর ক্রমিকের দুই হাজার টাকার একটি চেকও লাভ করেন যুদ্ধে স্বামীকে হারানো গৃহবধু আমেনা।
বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা এ চিঠি আামার সম্বল-উল্লেখ করে আমেনা বিবি জানান, পরবর্তীতে রনজিৎ মন্ডল ভারতে চলে যায়। এদিকে যোগাযোগ করার মত কোন মানুষ না থাকার কারনে তার স্বামীকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করা হয়নি। নাতিরা বড় হয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দপ্তর আর মানুষের কাছে হেঁটেও স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বামীর অংশগ্রহনের স্বীকৃতি আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় তীব্র মর্মবেদনায় তিনি প্রতিনিয়ত পোড়েন বলেও দাবি করেন।

বৃদ্ধা আমেনা বিবির অভিযোগ, স্বামী স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম তার (কাশেম) ওঠেনি। টাকা ছাড়া কেউ কোন সহায়তা দিতে অপারগশতা প্রকাশ করেন। এদিকে ভূমিহীন হয়ে চরম দারিদ্রতার মধ্যে বসাবস সত্ত্বেও বিধবা বা বয়স্ক ভাতার সুবিধা পর্যন্ত মেলেনি তার নিজের ক্ষেত্রে। স্বামীকে হারানোর পর থেকে মানুষের বাড়িতে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, স্বামী ও সন্তান হারিয়ে আর কোন চাওয়া পাওযা নি। শুধু মরণের আগে একবার অন্তত বঙ্গবন্ধুর মেয়ের সাথে দেখা করে মরতি চাই।

আমেনা বিবির নাতি মহিবুল্লাহ বলেন, মোটরসাইকেল এ ভাড়া টেনে যা আয় রোজগার করি, নানি আর পরিবারের জন্যি খরচ করি। বঙ্গবন্ধুর লেখা চিঠি নে অনেকের সাথে যোগাযোগ করেও কোন লাভ হয়নি। টাকা ছাড়া কেউ কোন কথা বলতি চাই না-বলেও দাবি তার।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন বলেন, শেখ সাহেবের ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাক্ষাতের জন্য কোথন্ডার মুক্তিযোদ্ধা নেতা আব্দুল গনির বাড়িতে আসে। পরবর্তীতে আব্দুল গনির নির্দেশে শেখ সাহেবের ভাইকে বডদল পর্যন্ত পৌছে দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন কাশেম।
আশাশুনি পাইকগাছার তৎকালীন এমএলএ আব্দুল গফুরের নির্দেশে ঘুষুড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প করার কথা জানিয়ে তৎকালীন ক্যাম্প ইনচার্জ আব্দুল গনি বলেন, ঘুষুড়ি গ্রামের ছিদাম বাবুর বাড়িতে ৪০ মুক্তিসেনা নিয়ে ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়। পরবের্তীতে শেখ নাছের সাহেব আমাদের ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে ফিরে যাওয়ার সময় কাশেম মোল্যাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু শেখ সাহেবকে বডদল পৌছে দিয়ে ফেরার পথে রাজাকাররা তাকে শহীদ করে। এ বীর যোদ্ধা আরও বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর দেয়া ২ হাজার টাকা ছাড়া কাশেমের স্ত্রী কোন সহায়তা পায়নি। অজ্ঞাত কারনে তার স্বামীর নামও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাতে স্থান পায়নি।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শাকিল হোসেন জানান টাকা দিতে না পারায় অনেককে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এমন অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। কাশেম মোল্যা মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হবেন কিনা বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিষয়। তবে আমেনা বিবি তার সাথে যোগাযোগ করলে তাকে বয়স্ক বা বিধবা ভাতার সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

আশাশুনি উপচেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আমির জোয়ারদার বলেন, সরাসরি যুদ্ধ না করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা বা অন্য কোন কারনে রাজাকাররা আরও অনেকের মত কাশেমকে হত্যা করে। কাগজপত্র না থাকায় হয়তবা তার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত হয়নি।

আশাশুনি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আব্দুল হান্নান বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর রাজাকার ও পাক সোনাদের হাতে নিহতদের অনেকের পরিবারকে বঙ্গবন্ধু চিঠি লেখেন এবং ২ হাজার করে অর্থ সহায়তা দেন। পরবর্তীতে তাদের অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় জায়গা পেয়েছে। আমেনা বিবির পরিবারের কেউ কখনও যোগাযোগ করেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমেনা বিবিকে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে সংসদের পক্ষ থেকে সর্বোত চেষ্টা করা হবে।

The post বঙ্গবন্ধুর চিঠি-ই তার সম্বল, মেলেনি শহীদ স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি: মৃত্যুর আগে বঙ্গবন্ধু কন্যার সাক্ষাৎ চান বিধবা বৃদ্ধা আমেনা বিবি appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/2JfB7kp

No comments:

Post a Comment