পত্রদূত রিপোর্ট: অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিয়ে রেজুলেশন জালিয়াতি করে সাতক্ষীরা সিটি কলেজে ২০ শিক্ষক নিয়োগ ও ২১ শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করার অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক।
প্রথম দফায় ১৭ জানুয়ারি থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত দুদকের ঢাকা অফিসে ডেকে নিয়ে কলেজের ১০ প্রভাষকের লিখিত বক্তব্য নেয়া হয়েছে। এছাড়া আরও ১০ শিক্ষককে দুদকে তলব সংক্রান্ত চিঠি বুধবার সিটি কলেজে এসে পৌঁছেছে।
গত ১১ জানুয়ারি সাতক্ষীরা সিটি কলেজের অধ্যক্ষকে দুদকের উপসহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধানী কর্মকর্তা প্রবীর কুমার দাশের দেয়া চিঠিতে অধ্যক্ষ আবু সাঈদসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ, বিধিবহির্ভূতভাবে রেজুলেশন জালিয়াতি করে শিক্ষক নিয়োগ ও অনিয়মের মাধ্যমে ১৬ শিক্ষককে এমপিওভুক্তি করার বিষয়টি তদন্তের জন্য ১০ শিক্ষককে ঢাকায় তলব করা হয়। দুর্নীতি নিয়ে দু’দক কর্মকর্তা প্রবীর কুমার দাস গত বছরের ২২ ডিসেম্বর সাবেক অধ্যক্ষ এমদাদুল হক ও সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সুকুমার দাসকে সাতক্ষীরা এলজিইডি অফিসের রেস্ট হাউজে ডেকে সিটি কলেজের দুর্নীতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য অবগত হন।
ইতোমধ্যে দুদকে সাক্ষ্য দেওয়া ১০জন শিক্ষকের মধ্যে পাঁচজন শিক্ষকের কাগজপত্র জাল বলে প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ হয়েছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। দুদকের এই তদন্ত প্রক্রিয়ায় কলেজের অধ্যক্ষসহ মোট ২১ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়ায় রাখা হয়েছে। ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই দুদকের হটলাইনে শিক্ষক্ষ বিধান চন্দ্র দাসের অভিযোগের পর তদন্ত প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি থেকে এ সকল শিক্ষককে তদন্ত কর্মকর্তাদের মুখোমুখি থেকে লিখিত বক্তব্য দিতে হচ্ছে।
যে সকল শিক্ষককে ১৭ জানুয়ারি থেকে ঢাকায় দুদক কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছে তারা হলেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সৈয়দা সুলতানা, পদার্থবজ্ঞান বিভাগের আজিম খান, ইংরেজী বিভাগের এ এসএম আবু রায়হান, ইতিহাস বিভাগের মো. জাকির হোসেন, রসায়ন বিভাগের মোছা. নাজমুন্নাহার, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের অরুণ কুমার সরকার ও রুনা লায়লা, দর্শন বিভাগের শেখ নাসির উদ্দিন, বাংলা বিভাগের মো. মনিরুল ইসলাম, মনোবিজ্ঞান বিভাগের উত্তম কুমার সাহা ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সুরাইয়া জাহান। বৃহস্পতিবার ২১ জানুয়ারি প্রথম দফায় ১০ শিক্ষকের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে। প্রতিদিন দুইজন করে শিক্ষকের লিখিত বক্তব্য নেয়া হয়েছে।
প্রায় চার কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্যে কলেজ পরিচালনা পরিষদের তৎকালীন সভাপতি, কলেজ অধ্যক্ষ আবু সাঈদ ও মাউশির মহাপরিচালক, মাউশির খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালক, জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে এই অনিয়মের অভিযোগ আনা হয় ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ১৯ সালের পহেলা আগস্ট দুদকের উপ-পরিচালক এনফোর্সমেন্ট মো. মাসুদুর রহমান সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রতিবেদন প্রেরণপূর্বক কমিশনকে অবহিতকরণের নির্দেশ প্রদান করেন।
দুদকের ১০৬ হটলাইনে ’১৯ সালের ২৪ জুলাই সাতক্ষীরা সিটি কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক বিধান চন্দ্র দাস এক অভিযোগ দাখিল করেন। পরে এই অভিযোগের পক্ষে প্রমাণপত্রসহ লিখিত অভিযোগ চাওয়া হলে অভিযোগকারী প্রভাষক বিধান চন্দ্র দাস গত বছরের ৫ আগস্ট ৬ পৃষ্ঠা বর্ণিত অভিযোগ ও শতাধিক পৃষ্ঠার তথ্যপ্রমাণসহ দুদক চেয়ারম্যান বরাবর ফের আবেদন করেন। যা হটলাইনে করা অভিযোগের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এ বিষয়ে একাধিক বিস্তারিত প্রতিবেদন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
অভিযোগ, তৎকালীন পরিচালনা পরিষদের সভাপতি জামায়াত নেতা ও তৎকালীন সংসদ সদস্য বর্তমানে যুদ্ধাপরাধ মামলায় কারাগারে থাকা অধ্যক্ষ মাও. আব্দুল খালেকের নির্দেশে এক বিতর্কিত নিয়োগ বোর্ড দেখিয়ে অধ্যক্ষ মো. ইমদাদুল হক, উপাধ্যক্ষ মো. শহিদুল ইসলাম, অর্থনীতি বিভাগে মো. কাদির উদ্দীন এবং মো. মফিজুর রহমান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে একেএম ফজলুল হক, ইসলামের ইতিহাস বিভাগে মো. আশরাফুল ইসলাম ও মো. আব্দুল ওয়াদুদ, ইতিহাস বিভাগে মো. জাকির হোসেন, দর্শন বিভাগের মো. জাহাঙ্গীর আলম, ভূগোল বিভাগে মো. নজিবুল্যাকে রাতারাতি নিয়োগ প্রদান করেন।
পরবর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর ২০১১ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর শিক্ষা পরিদর্শক মো. মজিবুর রহমান এবং অডিট অফিসার মো. ফরিদ উদ্দীন নিরীক্ষা ও পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে ২০১২ সালের ৩ জানুয়ারি দেয়া রিপোর্টে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুর রশিদের আমলে নিয়োগকৃত শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগ যথাযথ হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়।
অভিযোগ, জামায়াত নেতা অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক ম-লের সময়ে বিতর্কিত ওই ১৪ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল না করে বর্তমান অধ্যক্ষ জামায়াতের পৃষ্টপোষক আবু সাঈদ ও কলেজ পরিচালনা পরিষদের তৎকালীন সভাপতি কাগজপত্র জালিয়াতি করে এবং প্রকৃত তথ্য গোপন করে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে অর্থনীতি বিভাগে মো. কাদির উদ্দীন এবং মো. মফিজুর রহমান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে (খুলনা বিভাগীয় জামায়াত নেতা ও ১৮টি নাশকতা মামলার আসামী) একেএম ফজলুল হক, ইসলামের ইতিহাস বিভাগে মো. আশরাফুল ইসলাম, ইতিহাস বিভাগে মো. জাকির হোসেন, দর্শন বিভাগের (রাজশাহী বিশ্ব^বিদ্যালয়ের ছাত্র শিবির নেতা ও নাশকতা মামলায় কয়েকবার জেলখাটা আসামী) মো. জাহাঙ্গীর আলমকে এমপিওভুক্ত করান। এদের অনেকেই জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার এবং বিভিন্ন নাশকতা ও রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় একাধিকবার আটক হলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের এমপিও হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মচারিদের অভিযোগ, সিটি কলেজের প্রভাষক অরুণ কুমার ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর উক্ত কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের অনার্স শাখায় যোগদান করেন। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট ও ২০১৯ সালের ১২ মার্চ পরিপত্রে ডিগ্রী স্তরে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্তির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এই প্রজ্ঞাপন উপেক্ষা করে অধ্যক্ষ আবু সাঈদ ও কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির যোগসাজশে ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক অরুণ কুমার সরকারের নিয়োগ ও যোগদান সংক্রান্ত তথ্য জালিয়াতি ও গোপন করে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তারিখের পূর্বে অর্থাৎ ২০০৯ এর ১৫ ডিসেম্বর ডিগ্রী স্তরের তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে এমপিওভুক্ত করেন। এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র উপেক্ষা করে ডিগ্রি স্তরে ইংরেজি বিভাগে এসএম আবু রায়হান, বাংলা বিভাগে মো. মনিরুল ইসলাম, দর্শন বিভাগে মো. নাসির উদ্দীনকে একইভাবে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ও তথ্য গোপন করে ডিগ্রী স্তরের তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে এমপিওভুক্ত করা হয়। বিএসসি শাখায় ডিগ্রি স্তরে কোন ছাত্রছাত্রী না থাকলেও প্রাণিবিজ্ঞানে আশরাফুন্নাহার ও সুরাইয়া জাহান, পদার্থ বিজ্ঞানে আজিম খান শুভ, উদ্ভিদ বিজ্ঞানে মোস্তাফিজুর রহমান এবং রসায়নে নাজমুন্নাহারকে ২০১৮ সালে কাগজপত্র জালিয়াতি করে ও তথ্য গোপন করে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর সাতক্ষীরা সিটি কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও অধ্যক্ষের যৌথ পরিকল্পনায় হিসাব বিজ্ঞানের শিক্ষক বিধান চন্দ্র দাসকে বিতাড়িত করেন। এ নিয়মবহির্ভুত কাজের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গেলে গত বছরের ২৪ নভেম্বর মহামান্য হাইকোর্ট শিক্ষা সচিব, মাউশির মহাপরিচালক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ নয়জনকে এক আদেশে বিধ্না চন্দ্র দাসকে এক মাসের মধ্যে এমপিওভুক্তিসহ স্বপদে পূণর্বহালের নির্দেশ দেন।
The post অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত সাতক্ষীরা সিটি কলেজের ২০ শিক্ষককে দুদকে তলব appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/396xiIy
No comments:
Post a Comment