Thursday, February 25, 2021

কুরআন-সুন্নায় মুহাম্মদ (সা.) এর কর্মনীতি ও তাঁর দর্শন https://ift.tt/eA8V8J

 

মাওলানা মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ
(১৯ তম পর্ব)…
কুরআন-সুন্নায় বর্ণিত জাহান্নামের হাক্বিকত: আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার মানুষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। একই সাথে ভাল এবং মন্দের পার্থক্য সৃষ্টির জন্য ইলমে মুবিন তথা (কুরআনের) সুস্পষ্ট জ্ঞান দান করেছেন। যা সৃষ্টিকুলের মধ্যে অন্য কোনো প্রাণীকে দান করেননি। এই এক জায়গায় মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে নিগূঢ় পার্থক্য বিদ্যমান। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্মনীতি ও দর্শনের মূল লক্ষ্যস্থল হলো ইহকাল ও পরকাল কেন্দ্রিক। মানুষের দুনিয়ার জীবনের পাপ-পূর্ণের চুড়ান্ত ফয়সালা হবে পরকালে। ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করলে ব্যক্তির নেক আমলের অসিলায়; আল্লাহ অসীম দয়াবলে তাঁকে জান্নাত দান করবেন। কিন্তু ঈমান ছাড়া যদি কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হয় এবং পাপ রাশির মহাসাগর নিয়ে যদি সে পরকালে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হয়। তাহলে সে ব্যক্তির চুড়ান্ত ভয়ানক পরিণতি হবে উত্তাপ্ত অগ্নি শিখাময় স্থান জাহান্নাম। জাহান্নামের হাক্বিকতঃ জাহান্নামের প্রকৃত অবস্থা বুঝার জন্য নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ থেকে আমরা উপলব্দি করবো। যেমন: বুখারি ও মুসলিম শরিফে একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, “হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: তোমাদের (ব্যবহৃত) আগুনের উত্তাপ জাহান্নামের আগুনের উত্তাপের সত্তর ভাগের একভাগ মাত্র। বলা হলো, ইয়া রাসুলুল্লাহ! (জাহান্নামের শাস্তিদানের জন্য) দুনিয়ার আগুন তো যথেষ্ট ছিল। তিনি বললেন, দুনিয়ার আগুনের উপর তার সমপরিমাণ তাপসম্পন্ন জাহান্নামের আগুন আরো উনসত্তর ভাগ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।” সুত্র: সহীহ বুখারি-৩২৬৫, সহীহ মুসলিম-২৮৪৩, মিশকাত: ৫৬৬৫। আল্লাহ তায়ালা জাহান্নামকে যেখানে তৈরী করেছেন সেখান থেকে টেনে এনে জান্নাত গমনের পথে রাখা হবে এবং তার উপরেই বিছানো হবে পুলসিরাত। এটা হতে সহজেই ধারণা করা যায় যে, জাহান্নাম কত বৃহাৎ এবং তা থেকে বের হওয়াও অসম্ভব হবে। যেমন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: কিয়ামতের দিন জাহান্নামকে এমন অবস্থায় উপস্থিত করা হবে যে, তার সাথে সত্তর হাজার লাগাম থাকবে এবং প্রতিটি লাগামের সাথে সত্তর হাজার ফেরেশতা থাকবে। তারা জাহান্নামকে টেনে আনবে। সুত্র: সহীহ মুসলিম: ২৮৪২, তিরমিযী: ২৫৭৩। জাহান্নাম বাসীদের শাস্তির তীব্রতা ভিন্নভিন্ন হবে। তবে যে ব্যক্তিকে সবচেয়ে কম শাস্তি প্রদান করা হবে সে বিষয়ে বুখারি-মুসলিম শরিফের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে ঠিক এভাবে-“হযরত নুমান ইবনে বশীর (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: জাহান্নাম বাসীদের মধ্যে সর্বপেক্ষা সহজতর শাস্তি ঐ ব্যক্তির হবে, যাকে আগুনের ফিতাসহ দু’খানা জুতা পরানো হবে। তাতে ঐ ব্যক্তির মগজ এমনিভাবে ফুটতে থাকবে, যেমনিভাবে তামার পাত্র ফুটতে থাকে। তখন সে ব্যক্তি ধারণা করবে যে, তার অপেক্ষা কঠিন আযাব আর কেউ ভোগ করছে না। অথচ সে হবে সর্বাপেক্ষা সহজতর শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি। সুত্র: সহীহ বুখারি-৬৫৬১/৬৫৬২, সহীহ মুসলিম-১/১৯৬। এই বিষয়ে মিশকাত শরিফে অন্য আরেকটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: দোজখ বাসীদের মধ্যে সর্বপেক্ষা সহজতর শাস্তি হবে আবু তালিবের। তার দুই পায়ে দুখানা আগুনের জুতা পরিয়ে দেওয়া হবে। তাতে তার মাথার মগজ টগবগ করতে থাকবে। সুত্র: মিশকাত: ৫৬৬৮, সহীহ মুসলিম: ৩৬২, ২১২। আল কুরআনের আলোকে জাহান্নামের অধিবাসীদে ধরণ ও প্রকৃতি: এ্েক্ষত্রে সুরাহ তাওবার ৭৯ নং আয়াতকে সামনে রেখে উক্ত আয়াতের প্রেক্ষাপট ও শানে নুজুল তথ্যসূত্র সহ বর্ণনা করবো ইনশাআল্লাহ। বক্ষমান আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-“মুমিনদের মধ্যে যারা স্বত:স্ফূর্তভাবে সদকা দেয় এবং যারা নিজ শ্রম ব্যতিরকে কিছুই পাই না,তাদেরকে যারা দোষারোপ ও বিদ্রুপ করে, আল্লাহ তাদেরকে বিদ্রুপ করেন। তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” সুত্র:সুরাহ আত তাওবাহ:৭৯।অত্র আয়াতের শানে নুজুল বা প্রেক্ষাপটঃ একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দান-সদকা করার ব্যাপারে সাহাবীদেরকে উৎসাহিত করলেন। নবীজির বয়ানে অনুপ্রাণিত হয়ে হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বাড়ি থেকে চার হাজার দিরহাম এনে নবীজির সামনে হাজির করলেন এবং বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার সম্পদের পরিমাণ ৮ হাজার দিরহাম। আমি এর অর্ধেক দান করলাম এবং অর্ধেক পরিবার পরিজনের জন্য রেখে দিলাম। নবীজি বললেন: আল্লাহ তায়ালা তোমার দানকৃত ৪ হাজার দিরহামে এবং পরিবারের জন্য রেখে আসা ৪ হাজার দিরহামের মধ্যেও বরকত দান করুন।

যাই হোক, এরপর আসেম ইবনে আদী (রাঃ) দাঁড়ালেন এবং তিনি একশত ওয়াসক অর্থাৎ (১৩০ কেজি ৫০০ গ্রাম) খেজুর দান করলেন। মুনাফিকরা সাহাবীদের এই দানকে সামনে রেখে কঠিনভাবে দোষারোপ করলো এবং তারা বলতে লাগলো এরা লোক দেখানোর জন্য এই সম্পদ দান করেছে। এদিকে বনু হানিফের আবু আকিল নামের একজন সাহাবী অত্যন্ত দারিদ্রক্লিষ্ট অবস্থাতেও এক সা পরিমাণ খেজুর এনে সদকার মালে জমা করলেন। এই দৃশ্য মুনাফিকরা অবলোকন করে হাসাহাসি করতে লাগলো এবং বলতে লাগলো আল্লাহ তায়ালা আবু আকিলের এই ক্ষুদ্র মাল গ্রহণ করবেন না। তাদের এসব আচরণের প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা অত্র আয়াত খানা নাজিল করলেন। সুত্র: তাফসিরে তাবারী: ৪/৩২৬, ফাতহুল বারী: ১৭/৪৭০। ফি সাবিলিল্লাহ তথা আল কুরআন ও রাসুলের সুন্œাহ প্রতিষ্ঠিত ইসলামের পথে যারা বৃহাৎ থেকে ক্ষুদ্র পরিসরে দান সদকা করে আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করতে চাই তাদের এই ইখলাছ পূর্ন দানে যারা অবজ্ঞা ও হেয় প্রতিপন্ন করে তারা অত্র আয়াত অনুসারে মুনাফিক এবং পরোকালে তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে। এই মুনাফিকরা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে। যারা আল্লাহর নাফারমানী করবে কুরআন-সুন্নাহর বিপরীত পথে চলে গুনাহ করবে তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে।এ সম্পর্কে আল কুরআনের সুরাহ হুদের ১০৬ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-“অত:পর যারা গুনাহ (অর্থাৎ কবিরা গুনাহ কিন্তু তাওবাহ ছাড়া মৃত্যুবরণ) করেছে তারা থাকবে জাহান্নামের আগুনে, সেখানে তাদের জন্যে থাকবে (আজাবের ভয়াবহ) চিৎকার ধ্বনি ও (যন্ত্রণাদায়ক) ভয়াল আর্তনাদ।” মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর প্রেরিত ওহীকে নিয়ে যারা বিতর্ক করে এবং মুমিনদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয় তাদের পরিণতি: এসমস্থ মানুষের পরিণতি পরোকালে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও মর্মান্তুদ হবে। তাদের সম্পর্কে সুরাহ হজ্জ্বের ১৯ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-“এ হচ্ছে (বিপরীতমুখী) দুটি দল যারা নিজেদের রবের ব্যাপারে (একে অন্যের সাথে) ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হলো, অত:পর এদের মধ্যে যারা আল্লাহ তায়ালাকে অস্বীকার করে তাদেরকে (জাহান্নামে পরিধান করানোর) জন্য আগুনের পোশাক কেটে রাখা হয়েছে; শুধু তাই নয়, তাদের মাথার উপর সেদিন প্রচন্ড গরম পানি ঢেলে দেওয়া হবে।”

আয়াতটির প্রেক্ষাপট ও শানে নুজুল: রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আয়াতটি আহলে কেতাবদের ব্যাপারে নাজিল হয়েছে। একদিন তারা মুমিনগণকে বললো আমরা তোমাদের চেয়ে আল্লাহ তায়ালার অধিক নিকটবর্তী। কিতাব অবতীর্ণ হওয়ার দিক দিয়েও তোমাদের চেয়ে অগ্রগামী এবং আমাদের নবীও তোমাদের নবীর আগে আগমন করেছে। জবাবে মুমিনগণ (সাহাবীগণ) বললেন, আমরাই বরং আল্লাহ তায়ালার নৈকট্যের অধিক হকদার। কেননা আমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান এনেছি এবং সেই সাথে তোমাদের নবীগণের প্রতিও ঈমান এনেছি। পূর্বে আল্লাহ তায়ালা যতো আসমানী কিতাব নাজিল করেছেন তার সবগুলোর প্রতি ঈমান এনেছি। পক্ষান্তরে তোমরা আমাদের নাবীকে সত্য নাবী জানা সত্ত্বেও হিংসাবশত তাঁকে অস্বীকার করেছো। এভাবে মুসলমান ও আহলে কিতাব মধ্যে বিতর্ক হলে অত্র আয়াত নাজিল হয়। সুত্র: লুবাবুন নুকুল: ১/১৩৪, তাফসিরে কুরতুবী: ১/১১০, তাফসিরে মাজহারী: ৬/২৬৩। সহীহ আল বুখারির বর্ণনায় এই আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট আরো স্পষ্টরুপে বর্ণিত হয়েছে ঠিক এভাবে-“কায়স ইবনু উবাদ (রা.) বলেন: সাহাবীদের মধ্যে (আলী,হামযাহ এবং উবায়দা রা. আনহুম) সম্পর্কে অত্র আয়াত নাজিল হয়। আর কাফিরদের মধ্যে ছিল শায়বাহ ইবনে রাবীয়া, উতবাহ এবং ওয়ালীদ ইবনে উতবাহ প্রমুখ। অর্থাৎ অত্র আয়াতে সাহাবায়ে কেরাম ও কাফিরদের মধ্যে যে বিবাদ ও ঝগড়া সংগঠিত হয়েছিল সে সম্পর্কেই বর্ণিত হয়েছে।” সুত্র: সহীহ বুখারী: হা: নং: ৩৮২৩। এই আয়াতে পরম শিক্ষা হলো আল কুরআনের বিধানকে মেনে নেওয়া এবং তদানুযায়ী নেক আমল করা এবং ইসলামী তাহজীব, তমদ্দুন অনুযায়ী জীবন যাপন করা।

নতুবা বিপরীত পন্থা অবলম্বন করলে পরোকালে আল্লাহ ঐ সমস্থ লোককে কাফেরদের ন্যায় জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন এবং আগুনের পোশাক পরিধান করাবেন এবং তীব্র অনল প্রবাহে সিদ্ধ ও প্রচন্ড গরম পানি নিয়ে তাদের মাথার উপর ঢেলে দিবেন। হে আল্লাহ তোমার কাছে এই ফরিয়াদ করি যে, প্রতিটি মুমিন হৃদয়ে তোমার জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির ভয় বদ্ধমূল করেদিন এবং বেশি বেশি ভালো কাজ ও নেক আমল করার তাওফিক দান করুন, (আমিন)। চলবে….। লেখক: ইসলামী গবেষক, এম.ফিল গবেষণারত- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

The post কুরআন-সুন্নায় মুহাম্মদ (সা.) এর কর্মনীতি ও তাঁর দর্শন appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3uvBxpK

No comments:

Post a Comment