Friday, February 26, 2021

শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা https://ift.tt/eA8V8J

শামীমা সুলতানা

একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জনগণের ও বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন।
এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেও সুপরিচিত। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি (৮ই
ফাল্গুন, ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত
ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে বেশ কয়েকজন তরুণ ছাত্র জনতা শহীদ হন। তাই এ দিনটি শহীদ
দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর
একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। ১৯৪৭ সালে
উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
কিন্তু পাকিস্তানের দু’টি অংশ-পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও
ভাষাগত দিক থেকে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিরাজ করছিল।

স্বাধীনতার পরপরই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয়
নেতৃবৃন্দ এবং উর্দুভাষী বুদ্ধিজীবীরা বলেন, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। অন্যদিকে পূর্ব
পাকিস্তানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দাবি ওঠে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার
বাংলা ভাষার এ দাবিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে। এতে ঢাকার ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী মহল ক্ষুব্ধ হন এবং
ভাষার ব্যাপারে তাঁরা একটি চূড়ান্ত দাবিনামা প্রস্ত্তত করেন। দাবিটি হলো: পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা ও
সরকারি কার্যাদি পরিচালনার মাধ্যম হবে বাংলা আর কেন্দ্রীয় সরকার পর্যায়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে
দুটি বাংলা ও উর্দু।

ভাষাসংক্রান্ত এই দাবিকে সামনে রেখে সর্বপ্রথম আন্দোলন সংগঠিত করে তমদ্দুন মজলিস। এর নেতৃত্বে
ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। ক্রমান্বয়ে অনেক অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল সংগঠন এই আন্দোলনে যোগ
দেয় এবং একসময় তা গণআন্দোলনের রূপ নেয়।

অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা
চালিয়ে যায়। এতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার
দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসভার আয়োজন করে। সভার পরও
মিছিল-প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। পরবর্তিতে তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান
গণপরিষদের অধিবেশনে সদস্যদের উর্দু বা ইংরেজিতে বক্তৃতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের
কংগ্রেস দলের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এ প্রস্তাবের সংশোধনী এনে বাংলাকেও পরিষদের অন্যতম ভাষা
করার দাবি জানান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং পূর্ববাংলার
মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন বিরোধিতা করার কারণে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। এ খবর ঢাকায় পৌঁছলে
ছাত্রসমাজ, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা বিক্ষুব্ধ হন। পরে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন পরিচালনার
জন্য একটি নতুন রাষ্ট্রভাষা পরিষদ গঠিত হয়, যার আহবায়ক ছিলেন শামসুল আলম।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ গণপরিষদের ভাষা-তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়া এবং পাকিস্তানের মুদ্রা ও
ডাকটিকেটে বাংলা ব্যবহার না করা ও নৌবাহিনীতে নিয়োগের পরীক্ষা থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাখার
প্রতিবাদস্বরূপ ঐদিন ঢাকা শহরে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটিদের দাবি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের
অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা। ধর্মঘটের পক্ষে ‘রাষ্ট্রভাষা
বাংলা চাই’ এই শ্লোগানসহ মিছিল করার সময় শেখ মজিবুর রহমান, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব,
শামসুল হক, অলি আহাদ প্রমুখ গ্রেপ্তার হন। এই কারনে ১২-১৫ মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। আন্দোলনের মুখে
সরকারের মনোভাব কিছুটা নমনীয় হয়। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ছাত্রনেতাদের সঙ্গে একটি চুক্তি
স্বাক্ষর করেন। তবে চুক্তিতে তিনি অনেকগুলি শর্তের সঙ্গে একমত হলেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি
তিনি মেনে নেননি।

১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে
ঢাকার দুটি সভায় উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন। জিন্নাহর বক্তব্য তীব্র প্রতিবাদ
মুখর হয় পূর্ব পাকিস্তানে।
১৯৫০ সালের ১১ মার্চ আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ
গঠিত হয়। ১৯৫২ সালের শুরু থেকে ভাষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিতে থাকে। এসময় পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দীন। রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হতে থাকে এবং পূর্ব পাকিস্তানের
অর্থনৈতিক অবস্থারও অবনতি ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মুসলিম লীগের প্রতি আস্থা হারাতে থাকে।
১৯৪৯ সালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় নব রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ।
এরপরে ১৯৫২ইং সালে ভাষা আন্দোলন একটি নতুন মাত্রা পায়।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বলেন যে,পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা
হবে কেবল উর্দু। সাথে সাথেই তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয় এবং ‘রাষ্টভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে ছাত্ররা
বিক্ষোভ শুরু করেন। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের
সভাপতি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধিদের এক
সভায় কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিল
আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়।
এসব কর্মসূচির বিপরীতে সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সমাবেশ-শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
পরদিন সকাল ১১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের একাংশে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রদের
সভা হয়। ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজের হাজার হাজার ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয়। ছাত্ররা পাঁচ-সাতজন
করে ছোট ছোট দলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসলে পুলিশ তাঁদের উপর
লাঠিচার্জ করে। ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়া শুরু করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে।
বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সামলাতে ব্যর্থ হয়ে গণপরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসররত মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালায়।
গুলিতে রফিক, জব্বার ও বরকত এবং অলিউল্লাহ (৮/৯ বছরের কিশোর) নিহত হয়। আহতদের হাসপাতালে
ভর্তি করার পরে আবদুস সালাম মারা যায়। এ সময় গণপরিষদের অধিবেশন বসার প্রস্ত্ততি চলছিল। পুলিশের
গুলি চালানোর খবর পেয়ে গণপরিষদ সদস্য মওলানা তর্কবাগীশ এবং বিরোধী দলের সদস্যসহ আরও কয়েকজন
সভাকক্ষ ত্যাগ করে বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান।

পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ছিল গণবিক্ষোভ ও পুলিশি নির্যাতনের দিন। জনতা নিহতদের গায়েবানা জানাজার নামাজ
আদায় করে শোক মিছিল বের করে। মিছিলের উপর পুলিশ ও মিলিটারি পুনরায় লাঠি, গুলি ও বেয়োনেট চালায়।
এতে শফিউর রহমানসহ কয়েকজন শহীদ হন এবং অনেকে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন।
ছাত্ররা যে স্থানে গুলির আঘাতে নিহত হয় সেখানে ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
১৯৬৩ সালে এই অস্থায়ী নির্মাণের জায়গায় একটি কংক্রিটের স্থাপনা নির্মিত হয়।
১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন অব্যাহত ছিল। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অনুমোদনের মাধ্যমে এই আন্দোলন তার লক্ষ্য অর্জন করে। জাতীয়
পরিষদে বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের এক পর্যায়ে বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ১৬
ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ তারিখে স্বীকৃতি লাভ করে।
১৯৫২ সালের পর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাঙালিদের সেই আত্মত্যাগকে স্মরণ করে দিনটি
উদযাপন করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
দিবস ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে একটি
মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। ২০১০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর
একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।

The post শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3kqyzhy

No comments:

Post a Comment