Friday, February 26, 2021

আল মাহমুদ:মানুষ সংলগ্ন কবি https://ift.tt/eA8V8J

সানোয়ার রাসেল

আর দশজন স্কুলগামী বঙ্গসন্তানের মতই কবি আল মাহমুদের কবিতার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো বাংলা পাঠ্যপুস্তকে গ্রন্থিত কবিতার মাধ্যমে। মফস্বল শহরে ছিল আমাদের বাস। হাফবিল্ডিং বাসার সামনে একটা উঠান, উঠানের দুই কোণে তিনটি নারিকেল গাছ। জোছনা রাতে নারকেল গাছের কালচে পাতা চাঁদের আলোয় চিকচিক করে। আমার কিশোর মন উদ্বেল হয়, কিন্তু সেই অনুভূতিকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না! একটা দমবন্ধ করা কষ্ট বুকে বাসা বাঁধে। সেই সময় আমার বাংলা পাঠ্যপুস্তকে আমি পেয়ে যাই সেই হীরকখনিতুল্য পংক্তিমালা—
নারকেলের ঐ/ লম্বা মাথায়/ হঠাৎ দেখি/
কাল ডাবের মতো/ চাঁদ উঠেছে/ ঠান্ডা ও গোল/ গাল
ছিটকিনিটা/ অস্তে খুলে/পেরিয়ে এলেম/
ঘর ঘুমন্ত এই/ মস্ত শহর/ করছিলো থর/
থর মিনারটাকে/দেখছি যেন/ দাঁড়িয়ে আছেন/
কেউ পাথরঘাটার/ গির্জেটা কি/ লাল পাথরের/ ঢেউ?
আমার অন্তরের অনুভূতিগুলো যেন মুহূর্তেই মুক্তির পথ পেলো। প্রকাশ্য হওয়ার ভাষা পেলো। পেয়ে গেলো গীতল ছন্দে গা ভাসিয়ে দেয়ার একটা মস্ত আনন্দ। সেই থেকে আল মাহমুদ নামটা মাথায় ঢুকে গেলো। আজও ভরা জোছনায় চাঁদের দিকে তাকালে ‘ডাবের মতো ঠান্ডা ও গোলগাল’ শব্দগুলো মনের মধ্যে আপনাআপনিই চলে আসে। লোকজ উপমার এমন অভিনব ব্যবহারে আল মাহমুদ বরাবরই স্বতঃস্ফূর্ত ও সিদ্ধহস্ত ছিলেন।
বাংলা কবিতার অঞ্চলে আল মাহমুদ আবির্ভূত হন পঞ্চাশের দশকে। তার সমকালে প্রায় সকল কবির কবিতায় টের পাওয়া যাচ্ছিলো নগরলগ্নতা, নাগরিক জীবনের হতাশা ও ভঙ্গুরতার সুর, নৈরাশ্যবাদীতা ও বিষাদ— যা কি না ক্ষেত্রবিশেষ কেবলই পাশ্চাত্যের অনুকরণ বলেই প্রতিভাত হচ্ছিলো। সেই সময়ে আল মাহমুদ লোকজ উপাদানকে অবলম্বন করে পূর্ব বাংলার নিজস্ব প্রাণটাকে অক্ষুন্ন রেখেই রচনা করলেন আধুনিকতম কবিতাসমূহ। লোকজ উপাদান ও দেশীয় ঐতিহ্যকে ব্যবহার করলেও বাংলার লোকায়ত জীবনকে প্রকাশ করা আল মাহমুদের কবিতার উদ্দেশ্য নয়। যেমনটি আমরা কবি জসীম উদ্দীনের কবিতায় দেখতে পাই। বরং এই ভূখন্ডের মানুষদের বার বার যেন নিজস্ব ভাষাশৈলী, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের শক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার একটা প্রচেষ্টা ছিল তার কবিতায়। তার প্রথম দুটো কাব্য—লোক লোকান্তর ও কালের কলসে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তার ‘তিতাস’ কবিতায় তিনি নৌকার পালকে কল্পনা করেছেন যৌবনের প্রতীকের হিসেবে। বলেছেন—
এ আমার শৈশবের নদী/ এই জলের প্রহার/ সারাদিন তীর ভাঙে/ পাক খায়/ ঘোলা ¯্রােত টানে
যৌবনের প্রতীকের মতো/ অসংখ্য নৌকার পালে/ গতির প্রবাহ আনে
কালের কলস কাব্যের ‘জলছবি’ কবিতায় আধুনিক কবিতার আঙ্গিকে আল মাহমুদ কী আশ্চর্যভাবে বলে যান গ্রামসংলগ্ন কথা! যেন মাঠ জুড়ে রোদ আর বৃক্ষশাখার ছায়া তাতে আঁকছে নকশা। সেই নকশার তথা কবিতার খাঁজে খাঁজে কবি এঁকে যাচ্ছেন—

কেমন শীতল লাগে/ নীলাম্বরী জলে ভিজে যায়!
যেন কার বউ তুমি/ পড়ন্ত বয়সী মাতা যেন
ধুলোর খেলায় লিপ্ত/ নগ্ন দু’টি অবোধ শিশুর
অথবা ফিরতে হবে/ ঘোড়া নিয়ে ভাদুগড় গাঁর
তারিক মীরের এক/ খড়ে ছাওয়া স্বপ্নের গহ্বরে।
যেমন ধবলী ফেরে/ পরিতৃপ্ত সন্ধ্যার গোয়ালে

এই যে উৎসের কাছে ফিরে যাওয়ার কথা, এই প্রবণতা আল মাহমুদের কবিতায় লক্ষণীয়। কবি ফিরে যেতে চান, অথচ ফিরে যাওয়ার সমূহ লজ্জা তাকে আড়ষ্ট করে রাখে। যেমনটি দেখতে পাওয়া যায় ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতায়—

কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো/
শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে/
চোখের পাতায় শীতের বিন্দু জমতে জমতে নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ লাল সূর্য উঠে আসবে/
পরাজিতের মতো আমার মুখের উপর রোদ নামলে/
সামনে দেখবো পরিচিত নদী/
ছড়ানো ছিটানো ঘরবাড়ি/
গ্রাম/
জলার দিকে বক উড়ে যাচ্ছে/
তারপর/
দারুণ ভয়ের মতো ভেসে উঠবে আমাদের আটচালা/
কলার ছোট বাগান/
দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে/
বৈঠকখানা থেকে আব্বা/
একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন/
ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান…/
বাসি বাসন হাতে আম্মা আমাকে দেখে হেসে ফেলবেন/
ভালোই হলো তোর ফিরে আসা/
তুই না থাকলে ঘরবাড়ি একেবারে কেমন শূন্য হয়ে যায়/
হাত মুখ ধুয়ে আয়/
নাস্তা পাঠাই/
আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে/
আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে/
ঘষে ঘষে/
তুলে ফেলবো
কী অপূর্ব! এই যে ট্রেন ফেল করে কাকভোরে গ্রামের দিকে, ঘরের দিকে ফিরে আসার লজ্জা— এ যেন কুয়াশায় কাছে হারতে থাকা রোদের গা বেয়ে বেয়ে পিতার কুরআন তেলাওয়াতের আওয়াজে সংকুচিত হয়ে আমার মধ্যেও সংক্রমিত হয়। আর কবিতার শেষে এসে আমিও মায়ের আঁচলে মুখ ঘষে ঘষে আমার যাবতীয় লজ্জা থেকে রেহাই পেয়ে যাই। এ ভাবেই আল মাহমুদের কবিতা আমার ভিতর ক্রিয়া করে চলে। এভাবেই পূর্ব-বাংলার প্রকৃতি ও ভাষা অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে থাকে তার কবিতায়। তিনি একবার নাসির আল মামুনকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন—
‘পূর্ব বাংলার ভাষা আসল বাংলা ভাষা। আমরা কোনো মৃত ভাষায় সাহিত্য করি না। যাঁরা করেন, কলকাতা তাঁদের লালন করে। আমাকে তারা প্রভাবিত করতে পারেনি, জসীমউদ্দীনকেও পারেনি।’ আবার অন্যত্র আল মাহমুদ বলেছেন, ‘… রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত আধুনিক বাংলা ভাষা বহু কবির বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গেছে। তিরিশ, চল্লিশ থেকে শুরু করে সত্তর দশক পর্যন্ত কবিরা যে শব্দরাজি তাদের কাব্যে ব্যবহার করে এসছেন তা মূলত: রবীন্দ্রনাথেরই। জীবনানন্দ দাশ সমস্যাটা উপলব্ধি করে কিছু আঞ্চলিক শব্দে তার কবিতার শরীর নির্মাণ করলেও এ ব্যাপারে তার খুব বেশি সচেতন প্রয়াস ছিল না।… আমি ভেবেছিলাম যদি আধুনিক বাংলা ভাষার স্ট্রাকচারের মধ্যে প্রচুর আঞ্চলিক শব্দ উপযুক্ত মর্যাদায় ব্যবহার করা যায় তাতে আমাদের সাহিত্যও গতিময় হয়ে উঠবে। আমি ঠকিনি।’ (সাজ্জাদ বিপ্লব সম্পাদিত ‘সাক্ষাতকার আল মাহমুদ’ গ্রন্থের প্রথম সাক্ষাতকার)
আল মাহমুদ কবিতায় অকপট ছিলেন। তার কবিতা তার বিশ্বাসকে ধারণ করতো, প্রকাশ করতো। আল মাহমুদের প্রথম দিকের কবিতা যেমন তার বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটেছে, তেমনি তার বিশ্বাসের বাঁক বদলের প্রতিচ্ছবিও তার কবিতায় বিম্বিত হয়েছে। তাই আমি সোনালী কাবিন গ্রন্থে তাকে বলতে দেখেছি—
এ মৃত্তিকা প্রিয়তমা কিষাণী আমার/
বিলের জমির মতো জলসিক্ত সুখদ লজ্জায়/
যে নারী উদাম করে তার সর্ব উর্বর আধার
কিংবা
দেহ দিলে দেহ পাবে
দেহের অধিক মূলধন
আমার তো নেই সখি
যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি
বিবসন হও যদি
দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইয়ের পাতাও থাকবে না
অথবা
শষ্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি/
তারো বেশি ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ/
সলজ সাহস নিয়ে ধরে আছি পট্টময় শাড়ি/
সুকণ্ঠি কবুল করি/
এ অধমই তোমার মরদ/
আবার সেই আল মাহমুদই বলেছেন, ‘… নারীর কাছে করুণা ভিক্ষাকে এতদিন প্রেম নামে চালোনো হয়েছে। এই ভিক্ষাবৃত্তি আর নয়।…’

লোক লোকান্তর (১৯৬৩) ও কালের কলস (১৯৬৬) এ দুটি কাব্য প্রকাশের পর পরই মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে কবি আল মাহমুদ ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। সোনালী কাবিন কবিকে এনে দেয় তুমুল জনপ্রিয়তা।
সোনার দিনার নেই
দেনমোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও
দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি…
এই সব পঙ্ক্তি আমাকে এখনও কী দারুণভাবে আলোড়িত করে! সত্যিই কবি আত্মপ্রবঞ্চনার স¦র্ণ খরিদ করেননি। যাকে সত্য বলে জেনেছেন, তাকে বিনা দ্বিধায় কবিতায় ঠাঁই দিয়েছেন। আইয়ুবের স্বৈরশাসন-পরবর্তী বিগত দশকগুলোয় কত স্বৈরতন্ত্র আর গণতন্ত্রের মুখোশে কতবার কত সিউডো-ডেমোক্রেটিক প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের শাসনামল পার করলাম ও করছি, তথাপি—
ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!
শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে/
দুয়োর বেঁধে রাখ/
কেন বাঁধবো দোর জানালা/
তুলবো কেন খিল?/
আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে/
ফিরবে সে মিছিল/
ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/
ট্রাকের মুখে আগুন দিতে/
মতিয়ুরকে ডাক..
এর মতো তীব্র সাহসী চরণ আর ক’টাই বা পেলাম? কবিতা শুধুই শান্ত-স্নিগ্ধ-কোমল প্রকৃতির রূপ বর্ণনা করবে আল মাহমুদ তা বিশ্বাস করতেন না। তিনি বলেছেন, ‘…শান্তির সপক্ষে এক ধরণের আন্তর্জাতিক ভ-ামি শুরু হয়েছে। অথচ মহাযুদ্ধেরও একান্ত দরকার…’। তাই তিনি কবিতায় যুদ্ধের প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেছেন। বখতিয়ারের ঘোড়া কবিতায় আমরা সেই প্রত্যাশা অবলোকন করি—

মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে/
মনে হয় রক্তই সমাধান/
বারুদই অন্তিম তৃপ্তি/
আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি।

যে চেতনা ও আদর্শ নিয়ে আল মাহমুদ যাত্রা শুরু করেন, বাংলা সাহিত্যের জগতে সুনাম ও প্রতিপত্তি অর্জন করেন, এক পর্যায়ে সে চেতনা ও আদর্শের জায়গা থেকে সরে এসেছিলেন। তার কবিতাতেও এই আদর্শিক পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে। বলা হয়ে থাকে ইসলামি আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে সেই ভাবধারার কবিতা রচনা করার জন্য আল মাহমুদ বাংলাদেশের সাহিত্যের তথাকথিত প্রগতিশীল অংশ, যারা এ দেশের সাহিত্য অঙ্গনের ইজারাদার হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছেন, তাদের কর্তৃক একঘরে হয়েছেন। আল মাহমুদ তার বিশ্বাসের বাক্ বদলের পর নানাভাবেই বঞ্চনার স্বীকার হয়েছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ব্যক্তিগতভাবে আল মাহমুদকে গালিগালাজ করা হয়েছে। বলা হয়েছে আল মাহমুদ মার্কসবাদী ছিলেন এবং তিনি বিশ্বাসঘাতক। তাকে মৌলবাদী হিসাবেও আখ্যা দেয়া হয়েছে। যদিও তিনি বিভিন্ন সময় নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন, কিন্তু সেই ইজারাদারগণ তাতে কর্ণপাত করেনি। আল মাহমুদ প্রথম জীবনে মার্কসবাদী ছিলেন না। তিনি রোমান্টিক ধারার কবি ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি যখন ঢাকায় আসেন তখন মার্কসবাদে বিশ্বাসী হন। মার্কসবাদে বিশ্বাসী হয়েও তার কবিতায় কখনই সেই অর্থে মার্কসবাদের প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়নি। তথাপি, সেই সময়ে তাকে কবি হিসাবে সম্মান না করার কোনো উপায় তৎকালীন সময়ের সাহিত্যসমালোচকদের কাছে ছিল না। স্বাধীনতার পর কবি যখন জেল খাটেন, সেই সময়টায় তার মধ্যে আদর্শিক পরিবর্তন ঘটে, তিনি মার্কসবাদ পরিত্যাগ করেন। মার্কসবাদ পরিত্যাগ করার ফলে আশ্চর্যজনকভাবে তার কবিতারও সমালোচনা করা হয়। তার সমসাময়িক সাহিত্যিকগণ, যারা তার কবিযশগুণে গোপন ঈর্ষায় ভুগছিলেন, তারাও এক মহাস্ত্র হাতে পেয়ে গেলেন। তাকে আদর্শচ্যুত, মৌলবাদী ইত্যাদি নানা অপবাদে ব্রাত্য করার চেষ্টা চললো। অথচ তার কবিতায় সেসবের চিহ্ন বা প্রমাণ তারা বের করতে পারবে না। কেননা, তার লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না, বখতিয়ারের ঘোড়া, এই বইগুলোর ধারাবাহিকতায় দেখতে পাওয়া যাবে যে, আল মাহমুদ যে মুসলিম পরিবার থেকে এসেছেন, সেই পরিবারে ব্যবহৃত ইডিয়মগুলোই তিনি তার প্রথম বই থেকেই ব্যবহার করেছেন। তার যে বইটিকে সবচেয়ে বেশি বামপন্থী বলা হয়ে থাকে, তাতে ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ নামক কবিতায় আল মাহমুদ পবিত্র কুরআনের আয়াত— ফাবি আইয়ি আলা ই রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান— ব্যবহার করেছেন। যে সমস্ত আরবী-ফারসী শব্দ সমাজে মিশে আছে বহু শতাব্দী ধরে, যা আসলে এখন প্রাচীন বাংলা ভাষারই বৃহত্তম অংশ, আল মাহমুদ তার বিশ্বাসের বাক্ বদলের আগে থেকেই কবিতায় সেসব ব্যবহার করে আসছেন। যেমন ‘কাবিন’— ডকুমেন্ট অব লাভ— যা আমাদের কবিতাতে হাজার বছরেও ব্যবহার করা হয়নি, আল মাহমুদ তা সোনালী কাবিনে ব্যবহার করলেন। তিনি আরও লিখলেন, ‘রেহেলের মত হাত তুলে আছি’র মতো পঙ্ক্তিসমূহ। তাই আল মাহমুদ ঐতিহ্যচ্যুত হয়ে কবিতা লিখেছেন, এটা নিছকই কবির প্রতি অন্যায় অপবাদ। তবে তার এই বিশ্বাসের বাক্ বদলকে আল মাহমুদ বিদ্বেষীরা ব্যাপকভাবে কাজে লাগানোর অপপ্রয়াস চালিয়েছেন। এমনকী তাকে সমালোচনা থেকেও বাদ দেয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু আল মাহমুদ ও তার কবিতা এতটাই প্রাসঙ্গিক ও শক্তিশালী ছিলো যে, তাদের সেই প্রচেষ্টা পুরোপুরি সফল হয়নি। আল মাহমুদ বাংলাদেশের মানুষের কাব্যবোধের উপর আস্থা রেিেখেছলেন শেষ পর্যন্ত। এ প্রসঙ্গে তার কিছু কথা উল্লেখ না করলেই নয়—
‘হাজার বছরের ইতিহাসের পরীক্ষায় বাঙালি জাতির মনুষ্যত্ববোধ তথা কাব্যবোধ উত্তীর্ণ হয়ে এসেছে। আবহমানকাল থেকে তারা তাদের কবিদের, শিল্পীদের যোগ্য সম্মান দিয়ে এসছেন, ভবিষ্যতেও দেবেন। এটা এখন নিশ্চিত জানি, দেশের মানুষের জন্য লিখছি, তাদের প্রেম, কাম, সাহস, সহনশীলতা, ধর্ম, স্বাধীনতাপ্রিয়তা ও অপরিসীম দারিদ্র্য নিয়ে লিখছিÑলিখছি বাঙালি জাতির সামগ্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে। একদিন সুন্দর ভবিষ্যৎ এসে আমাদের শ্রমের মূল্য দেবে, আমরা সুখে, সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকবো।’
লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন হয়ে মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো। তারপর বখতিয়ারের ঘোড়া— আল মাহমুদের এই জার্নি একজন অকপট কবির বিশ্বাসের জার্নি, তার প্রকৃতিবাদী থেকে সংশয়বাদ হয়ে সুনির্দিষ্ট বিশ্বাসে থিতু হওয়ার জার্নি। এই জার্নিতে কবি আল মাহমুদ সমিল, গীতিধর্মী, পয়ার, মাত্রাবৃত্ত থেকে শুরু করে গদ্যধর্মী এমনকী নিরাভরণ গদ্যে কেবল বক্তব্যকে প্রাধান্য দেয়া কবিতা নিয়েও নিরীক্ষা চালিয়েছেন। টুলস হিসাবে প্রকৃতি-প্রেম-নারী থেকে শুরু করে প্রতিবাদ ও যুদ্ধকে পর্যন্ত গ্রহণ করেছেন। উপমা-উৎপ্রেক্ষায় সর্বদাই প্রাধান্য দিয়েছেন পূর্ব-বাংলা তথা বাংলাদেশের নিজস্ব শব্দ ও রীতি। পাশাপাশি অনেক কাব্যে আল মাহমুদ প্রচুর ইসলামি পারিভাষিক শব্দের সফল ব্যবহার করেছেন। তবে সেই শব্দগুলোও ব্যবহারিক দিয়ে এই ভূখন্ডের জনমানুষের সংলগ্নই ছিলো। অর্থাৎ এই জার্নিতে আল মাহমুদকে আমি অনুভব করেছি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মানুষের সংলগ্ন একজন কবি হিসাবে।

১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ জুলাই জন্মগ্রহণ করে এই ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি কবি ইহলোক ত্যাগ করেন। মহান রাব্বুল আলামিন তার জীবনের সমস্ত ভুলত্রুটি মার্জনা করে পরওয়ারদিগারের রহমতের কুদরতি চাদরে কবিকে পরম মমতায় ঢেকে রাখুন এই কামনা করি। পরিশেষে কবি আল মাহমুদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভলোবাসার নিদর্শন হিসাবে কয়েকটি পঙ্ক্তি উচ্চারণ করে এই লেখাটি শেষ করছি—

এ কোন অবাস্তব এক কুয়াশার রাত!
অন্ধকারের ঘন ঘ্রাণের সাড়া
গহীন দীঘিতে শুনি কেমন ছলাৎ
মিনারের গায়ে চিনা মাটির তারা

হেঁটে হেঁটে চলে আসি মাঠেদের শেষে
গোলগাল ঠান্ডা চাঁদ হঠাৎ হলুদ
দৃশ্যেরা জন্ম নেয় স্মৃতিদের বেশে
নির্বাক হয়ে দেখে আল মাহমুদ!

অভিমান ব্যাগে ভরে আজও কত লোক
অপেক্ষা নিয়ে বাঁচে পালাবে বলে
কতজন লজ্জা নিয়ে ফিরে মুছে চোখ
শান্তি পায় মায়েদের আঁচল তলে

ফেরার লজ্জা ভুলে আমরা বাঁচি ফের
কিশোরি আয়েশা প্রেমে যেন হই বুঁদ
মক্তবে মায়া ঝরে খুব পাই টের
শুধু চুপ হয়ে যান আল মাহমুদ!

মায়েদের নোলকেরা কতই হারায়
আমরা গহীন জলে ডুবে ডুবে খুঁজি
কেউ কেউ খুঁজে পেয়ে ঘরে ফিরে যায়
কেউ নিজে— নিজেকেই হারালই বুঝি!

আর কি গো হবে খোঁজা নদীদের জলে
আর কি গো হবে লেখা উপমহাদেশ
নিথর হয়েছে কবি আল মাহমুদ
কবিতায় তার কথা বলে যাবে দেশ।

The post আল মাহমুদ:মানুষ সংলগ্ন কবি appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3rbaPAw

No comments:

Post a Comment