Saturday, February 20, 2021

ভাষা আন্দোলনে সাতক্ষীরা https://ift.tt/eA8V8J

আবুল কালাম আজাদ

ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এই আন্দোলন ছিল তৎকালীন পূর্ববাংলার প্রথম স্বাধীকার আন্দোলন। এরই সিড়ি বেয়ে ৫৪ সালের নির্বাচন, ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৮ সালের গণআন্দোলন, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, সর্বোপরি ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়।
সারাদেশের মতো সাতক্ষীরার মানুষও ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়। ঢাকায় পড়াশুনার কারণে কেউ ঢাকাতে, যশোরে পড়াশুনার কারণে কেউ যশোরে, আবার খুলনায় পড়াশুনার কারণে কেউ খুলনায় ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, সাতক্ষীরার সেসব ভাষা সংগ্রামীদের অবদান কমবেশী বিভিন্ন বইপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তৎকালীন সাতক্ষীরা মহাকুমা শহর বা অন্যান্য থানাগুলোতে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কী ধরণের আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত কোন তথ্য সংরক্ষিত হয়নি। যে কারণে সাতক্ষীরার ভাষা আন্দোলনের ঘটনা প্রবাহ আজও অনেকটা অন্ধকারেই থেকে গেছে। তারপরও বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ‘ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস’ গ্রন্থে সাতক্ষীরার বিশিষ্ট সাংবাদিক কল্যাণ ব্যানার্জি ও পল্টু বাসারের একটি লেখা প্রকাশিত হয়। যে লেখায় সাতক্ষীরার ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। ড. শেখ গাউস মিয়ার বাগেরহাটের ইতিহাস বইটিতেও খুলনায় ভাষা আন্দোলনে সাতক্ষীরার আনোয়ার হোসেনের ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আনোয়ার হোসেন ১৯৪৯ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তৎকালীন পাকিস্তানে এটিই ছিল প্রথম কোন রাজনৈতিক হত্যাকা-ের ঘটনা। খাপড়া ওয়ার্ডে আরো সাতজন নিহত হন। তবে তারা খাপড়া ওয়ার্ডের শহীদ হিসেবেই পরবর্তীকালে পরিচিতি পেয়েছেন।
বাগেরহাটের ইতিহাসে ড. শেখ গাউস মিয়া আনোয়ার হোসেনের গ্রেপ্তারের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন। তার ঐ বইতে বলা হয়েছে, ‘ঐ সময় খুলনায় গ্রেপ্তার হন বিশিষ্ট ছাত্রনেতা আনোয়ার হোসেন। যিনি পরে ১৯৫০ (১৯৪৯) সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এ আনোয়ার হোসেনের মৃত্যু ছিল একটা অতি শোকাবহ ঘটনা। তার পিতৃনিবাস ছিল বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি থানার বুধহাটা গ্রামে। প্রাথমিক পর্যায়ের পড়াশুনা শেষ করে তিনি খুলনা জিলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকেই তিনি মেট্রিক পাশ করেন এবং ১৯৪৮ সালে তৎকালীন দৌলতপুর কলেজে (বর্তমান বিএল কলেজ) ভর্তি হন। খুলনায় পড়াশুনার সময় তিনি মরহুম অধ্যক্ষ মালিক আতাহারের বাড়িতে থাকতেন। ছাত্র ফেডারেশনের একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য ১৯৪৯ সালে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। প্রথমে তাকে কোতয়ালী থানায় রাখা হয়। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজশাহী জেলে। ১৯৫০ (১৯৪৯) সালের ২৪ এপ্রিল তিনি খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তিনি এই পর্বের বৃহত্তর খুলনার রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রথম শহীদ।’
ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাসের সাতক্ষীরা পর্বে পল্টু বাসার ও কল্যাণ ব্যানার্জীর যৌথ লেখায় উল্লে¬খ রয়েছে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র জনতা হত্যার প্রতিবাদে সাতক্ষীরায়ও প্রতিবাদ মিছিল হয়। সাতক্ষীরা কলেজের ছাত্ররা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মিছিলে পুলিশ ও মুসলিম লীগের গু-ারা হামলা চালায়। কিন্তু কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সাতক্ষীরায় শামছুল হক (২) (জেলা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি) গ্রেপ্তার হন। পরবর্তীকালে ছাত্র ও যুবকদের সংগঠিত করার অভিযোগে ১৯৫৩ সালের মার্চে গ্রেপ্তার হন সুশোভন আনোয়ার আলী ও সাতক্ষীরার কালী কিংকর।
লেখকদ্বয় সাতক্ষীরা এবং সাতক্ষীরার বাইরে ভাষা আন্দোলনে যারা ভূমিকা রেখেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে কেউ জীবিত নেই। যাদের ভূমিকার কথা এ লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের নেতৃত্বে ছিলেন সুশোভন আনোয়ার আলী। তিনি ছিলেন সাহিত্যিক ওয়াজেদ আলীর পুত্র। বাড়ি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাশদহা গ্রামে। এছাড়া শামছুল হক (২) তার সহপাঠী তারাপদ রায় চৌধুরী, শিক্ষক রাখাল দাস হালদার, সৈয়দ কামাল বখ্ত সাকী, এমএলএ আব্দুল গফুর, গোলেরা বেগম, সুলতানা চৌধুরী, কালী কিংকর, ঢাকায় পড়তে যেয়ে মীর মঞ্জুর আলী, যশোরে শেখ আমানুল¬াহ, বাগেরহাটে এডভোকেট মুনসুর আহমেদ ও এডভোকেট মুনসুর আলী, সাতক্ষীরার আমীর খান, আশাশুনির নুরুল হোসেন, কালিগঞ্জের এমএলএ ওকালত আলী, দেবহাটায় গণপরিষদ সদস্য এএফএম এন্তাজ আলীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সাতক্ষীরায় ভাষা আন্দোলন এবং তৎপরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য দিয়েছিলেন তৎকালীন সাতক্ষীরা কলেজের ছাত্র এডভোকেট আব্দুর রহিম। তিনি ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত সাতক্ষীরা কলেজের ছাত্র ছিলেন। ইন্টারমিডিয়েট এবং ডিগ্রি পাশ করেছেন এ কলেজ থেকেই। ২০১২ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আরও দু’বছর পূর্বে দীর্ঘ ৫৯ বছর পর ধূসর হয়ে যাওয়া স্মৃতি ঘেঁটে তিনি জানান, বর্তমান পিএন হাইস্কুলের দোতলায় ছিল তখন সাতক্ষীরা কলেজ। সে সময়ের অধ্যক্ষ ছিলেন উমাপদ দত্ত। সুশোভন আনোয়ার আলী তখন সাতক্ষীরা কলেজের তুখোড় ছাত্রনেতা।
তার ভাই বিনীত অজিহার, জামাল উদ্দীন, (এড. আলাউদ্দীনের ভাই) আনোয়ার চৌধুরী (আলফাজ চৌধুরীর ভাই) শ্যামনগরের খোরশেদ, ধ্রুব চৌধুরী, কাঞ্চন ঘোষাল, গোবরদাড়ি জোড়দিয়ার ছুরমান আলী, এড. একেএম শহীদ উল্লাহ, আব্দুল কাদের (অবসরপ্রাপ্ত নায়েব) আব্দুল লতিফ (অবসরপ্রাপ্ত পেশকার) শেখ রেজওয়ান (অবসরপ্রাপ্ত পেশকার) প্রমুখ এসময় (৫১ সাল থেকে ৫৬ সালের মধ্যে) সাতক্ষীরা কলেজের ছাত্র ছিলেন। এড. আব্দুর রহিম সে সময় দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাশ রিপ্রেজেনটেটিভ নির্বাচিত হয়েছিলেন। এসময় কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচিত হতো ক্লাশ রিপ্রেজেনটেটিভদের ভোটে। তারা মাঝে মধ্যে বসতেন কেষ্ট ময়রার দোকানে।
ঢাকায় গুলির ঘটনার পর তৎকালীন সাতক্ষীরা মহুকুমার সকল থানায় প্রচার কার্যক্রম চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় বিভিন্ন এলাকার ছাত্রদের। এড. আব্দুর রহিম জানান, তার উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় দেবহাটা, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর থানার। সুশোভন আনোয়ার এবং জামাল উদ্দীন দায়িত্ব নেয় সাতক্ষীরা সদর ও কলারোয়া থানায়। এছাড়া আশাশুনি ও তালা থানার প্রচার কার্যক্রম চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় আরও দু’জনকে। তবে তিনি তাদের নাম বলতে পারেননি।
এড. আব্দুর রহিম জানান, প্রচার কার্যক্রম চালানোর দায়িত্ব পেয়ে তিনি তার নিজ বাড়ি দেবহাটার শুশীলগাতি গ্রামে চলে যান। সেখান থেকে টাউনশ্রীপুর হাইস্কুলের ছাত্র গয়েশপুর গ্রামের ওলিউর রহমানকে (এ্যাড. আব্দুর রহিমের চাচা টাউনশ্রীপুরে পৌরসভার চেয়ারম্যান গোলাম হোসেনের বাড়িতে লজিং থাকতেন, পরে সিরাজগঞ্জে চলে যান এবং সেখানেই স্থায়ী বাসিন্দা হন) সাথে নিয়ে বাইসাইকেলে টিনের চোঙ্গা নিয়ে প্রচারে বের হন। এক সপ্তাহের অধিক সময় ধরে তারা দু’জন পারুলিয়া হাট, দেবহাটার ঈদগাহ বাজার, দেবহাটা স্কুল, টাউন শ্রীপুর স্কুল, নাজিমগঞ্জ বাসারসহ শ্যামনগর এলাকায় প্রচার চালান। তিনি জানান, প্রচারের ভাষা ছিল, ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, নূরুল আমিনের ফাঁসি চাই, জালিম সরকার গদি ছাড়, ঢাকায় ছাত্র হত্যার বিচার চাই’ ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ হাট-বাজারে তারা সংক্ষিপ্ত বক্তব্যও দেন।
এড. আব্দুর রহিম জানান, ঢাকায় গুলির ঘটনার পর সুশোভন আনোয়ারের নেতৃত্বে সাতক্ষীরায় মিছিল হয়। কলেজের ছাত্ররা এ মিছিলে অংশ নেয়। পলাশপোল বটতলায় তারা মিটিংও করেছেন। পরবর্তীতে একটি মিছিল থেকে সুশোভন আনোয়ার আলীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। যেকোন একটি মিছিল থেকে এড. আব্দুর রহিমসহ আরও ৩/৪ জনকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তাদেরকে থানার বারান্দায় বসিয়ে রাখা হয় এবং বিকালের দিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
মৃত্যুর পূর্বে এড. আব্দুর রহিম জানিয়েছিলেন, ভাষা আন্দোলনের সময় সাতক্ষীরার মুসলীম লীগের নেতা ছিলেন আব্দুল বারী খান, জব্বার খান প্রমুখরা। এসময় প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন রসুলপুরের মাহবুবর রহমান খান, আতাউর রহমান খান, আরিফ খান প্রমুখ ব্যক্তিরা। এড. আব্দুর রহিম আরও জানান, ভাষা আন্দোলনের পরের বছর ১৯৫৩ সালে সাতক্ষীরা কলেজে প্রগ্রেসিভ ফ্রন্ট ও পাইনিয়র ফ্রন্ট গঠন করা হয়। এ সময় সাতক্ষীরা কলেজে ভর্তি হন সৈয়দ কামাল বখত ছাকি। প্রগ্রেসিড ফ্রন্টে তিনিসহ সুশোভন আনোয়ার আলী, সৈয়দ কামাল বখত, ধ্রুব চৌধুরী, কাঞ্চন ঘোষাল প্রমুখ নেতৃত্ব দিতেন। পাইওনিয়ার ফ্রন্টের নেতৃত্ব দিতেন শ্যামনগরের খোরশেদ। তিনি বলেন, ৫৯ বছর আগের ঘটনাবহুল বিভিন্ন কর্মকা-ের অনেক কিছুই আজ স্মৃতির পাতা থেকে হারিয়ে গেছে। ঘটনা মনে থাকলেও তার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকের নাম আজ আর মনে নেই। স্থান কাল অনেক কিছু হারিয়ে গেছে স্মৃতির পাতা থেকে।
ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক পটভূমিতে সারাদেশে সে আন্দোলনের যে ঢেউ পড়েছিল তা থেকে সাতক্ষীরা পিছিয়ে ছিল না। তবে সে ইতিহাস সংরক্ষণে সাতক্ষীরার লেখকদের আরও বলিষ্ঠ ভূমিকার প্রয়োজন ছিল। তথ্যরই যাচাই বাছাই করার সুযোগ কমে এসেছে। অনেক অজানা তথ্য একসময় হয়তো নীরবেই হারিয়ে যাবে। (পুন:প্রকাশ)

The post ভাষা আন্দোলনে সাতক্ষীরা appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3qL1Jus

No comments:

Post a Comment