Thursday, February 18, 2021

কুরআন-সুন্নায় মুহাম্মদ (সা.) এর কর্মনীতি ও তাঁর দর্শন https://ift.tt/eA8V8J

মাওলানা মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ
(১৮ তম পর্ব)…
কুরআন-সুন্নায় বর্ণিত জান্নাতের হাক্বিকত: মানুষের চুড়ান্ত গন্তব্যস্থলের নাম হলো জান্নাত। তাওহীদ হলো ইসলামের মূল ভিত্তি। রিসালাত হলো সেই ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠিত করে যা মানুষের জীবনকে আলোকিত করে এবং সঠিক পথের সন্ধান দেয়। নাবী-রাসুলগণকে এই রিসালাতের ধারক-বাহক বলা হয়। রিসালাতের মুল দাবি হলো আম্বিয়া কেরাম আলাইহিমুস্্ সালামের ব্যক্তি সত্ত্বাকে এবং আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাঁদের উপর যে কিতাব নাজিল করা হয়েছে সেই কিতাবের প্রত্যেকটি আহকামকে ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবনে অনুসরণ পূর্বক মেনে নেওয়া। বিশ্ববাসির জন্য রাহমাত স্বরুপ সর্বশেষ প্রেরিত নাবী ও রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এবং তাঁর উপর প্রেরিত হিদায়াতের সর্বশেষ্ঠ গ্রন্থ আল কুরআনকে শুধুমাত্র অন্তরে বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি দিলেই রিসালাতের দাবি ও ঈমানের পূর্ণতা বিকশিত হবে না বরং বাস্তব জীবনে আমলের মাধ্যমে ইসলামের প্রত্যেকটি হুকুম আহকামকে অনুসরণ ও অনুকরণ করলেই শুধুমাত্র ঈমানের পূর্ণতা অর্জন হবে নতুবা নয়।

দুনিয়ার জীবনে তাওহীদ ও রিসালাতকে পূর্ণ অনুসরণ করতে পারলেই মানুষের চুড়ান্ত মানজিল আখিরাতে তাঁরা জান্নাতের মেহমান হতে পারবে। তাওহীদ ও রিসালাতের অনুসরণ ব্যতিরকে কোনো মানুষের পক্ষে পরকালে জান্নাতে পৌছানো সম্ভব হবে না। একইভবে মানুষ যদি শয়তান ও তাগুতের অনুসৃত পথকে গ্রহণ করে তাহলে এর পরিণাম স্বরুপ তারা পরকালে ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং জাহান্নামে যাবে। সংক্ষেপে বলা যায় যে, বর্তমান দুনিয়ায় মানুষের চলার পথ যদি মুহাম্মদ সাল্øাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্মনীতি ও তরীকা দর্শন মতো না হয় তাহলে পরকালে আল্লাহ তায়ালা কেবলমাত্র ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীনকে গ্রহণ করবেন না। এইকথাটি অত্যন্ত দ্বার্থহীন ভাষায় সুরাহ ইমরানের ৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করেছেন।

কোন ধরনের লোকেরা জান্নাতে প্রবেশ করবে: যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে আল কুরআনে তাদের যে ধরণের গুনাবলী বর্ণনা করা হয়েছে নি¤েœ সেগুলো স্ববিস্তারে আলোচনা করা হলো। উল্লেখ্য যে, আলোচ্য গবেষণা নিবন্ধে জান্নাতি মানুষের গুনাবলী বর্ণনা করা ক্ষেত্রে আমরা আল কুরআন ও রাসুলের হাদিস ব্যতিরকে অন্য কোনো গ্রন্থের আশ্রয় নেবো না। কেননা বিষয়টি অত্যন্ত অনুভূতিসাপেক্ষ একটি ব্যাপার। ফলশ্রুতিতে,বর্ণনার ক্ষেত্রে অন্যকোনো গ্রন্থের আশ্রয় নিলে অত্র নিবন্ধের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আল কুরআনের সুরাহ বাকারার ২৫ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-“যারা (আল কুরআনের উপর;আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এবং অন্যান্য অদৃশ্য বিষয়াবলীর উপর ) ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে তাঁদেরকে এমন এক জান্নাতের সুসংবাদ দাও যার নিচ দিয়ে ঝরণা প্রবাহিত হতে থাকবে”।

সুরাহ বাকারার অন্যত্রে ইরশাদ হয়েছে ঠিক এভাবে-“আর যারা আল্লাহ তায়ালা উপর ঈমান আনবে এবং নেক কাজ করবে, তারা জান্নাতবাসি হবে। তাঁরা সেখানে চিরস্থায়ী থাকবে।” সুত্র: প্রাগুক্ত, আয়াত নং-৮২। অত্র আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা জান্নাতের যাওয়ার জন্য ঈমান গ্রহণের সাথে সাথে নেক আমলকে শর্তারোপ করে দিয়েছেন।

নেক আমলের কতিপয় তালিকা: ১. নির্ধারিত সময়ে তাদিলে আরকানের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা। ২. নেসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর মালিকানায় থাকলে যাকাত দেওয়া। ৩. ফরজ, সুন্নাত ও নফল রোজা রাখা। ৪. সম্পদশালী হলে জীবনে অন্তত একবার ফরজ হজ্জ্ব করা। ৫. মাতা-পিতার খেদমত করা। ৬. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা। ৭. কুরআন তেলাওয়াত ও তদানুযায়ী আমল। ৮. সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। ৯. শ্রমিকের হক্ব যথাযথভাবে আদায় করা। ১০. মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে যেটা দিয়েছেন (অর্থাৎ কুরআন-সুন্নাহ) সেটি গ্রহণ করা এবং যা করতে নিষেধ করেছেন (অর্থাৎ হারাম কার্যাবলী) তা বর্জন করা। ১১. যিনা-ব্যবিচার, সুদ, ঘুষ, জুয়া ইত্যাদি কুকর্মকান্ড থেকে নিজেকে হেফাজাত করা এবং তাকওয়া অবলম্বন করা। ১২. সুন্নাত তরিকায় আল্লাহর যিকির-আযকার করা। ১৩. আমানাতের খেয়ানাত না করা এবং গিবত ও বুহতান থেকে দুরে থাকা।

হাদিসে রাসুলে নেক আমলের ফযিলাৎ: নেক আমল কারীর মর্যদার বিষয়ে সহীহ মুসলিম শরীফে ঠিক এভাবে বর্ণিত হয়েছে-“বিশিষ্ট হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত: তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: তোমাদের মধ্যে কেউ যখন উত্তমরুপে ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে তখন সে যে আমলে সালেহ বা নেক আমল করে তার প্রত্যেকটি বিনিময়ে সাতশ গুন পর্যন্ত (পূণ্য) লেখা হয়। (সুত্র: সহীহ বুখারি, হা: নং-৪২, সহীহ মুসলিম, হা: নং-১/৫৯, মুসনাদে আহমাদ, হা: নং-৮২২৪)। উপরিউল্লিখিত কুরআন-হাদিসের বর্ণনার আলোকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে,আল্লাহর উপর ঈমান আনার সাথে সাথে নেক আমল করা বান্দার অপরিহার্য কর্তব্য। আর ঈমান ও নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার প্রতিশ্রুতি কুরআনের শত শত জায়গায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা দিয়েছেন।

জান্নাতীরা দুনিয়াতে কঠিন বিপদ; দু:খ-কষ্ট ও অর্থসংকটে পতিত হবে: সুরাহ বাকারার ২১৪ নং আয়াতে এ বিষয়ে এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি ফুঁটে উঠেছে। ইরশাদ হচ্ছে-“তোমরা কি মনে করেছো যে, তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমরা এখনও তাদের অবস্থার সম্মুখীন হওনী যারা তোমাদের পূর্বে বিগত হয়ে গেছে। তাদেরকে অর্থসংকট ও দু:খ কষ্ট স্পর্শ করেছিল; এবং (এসব কারণে) তাঁরা প্রচন্ড ভয়ে প্রকম্পিত হয়েছিল।এমনকি অবশেষে রাসুল ও তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তাঁরা একযোগে বলেছিল, আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? সতর্ক হও, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে।” এই আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, পরীক্ষার পূর্বে বেহেশতের আশা করা ঠিক নয়।কেননা পূর্ববর্তী সমস্থ উম্মতেরই পরীক্ষা নেয়া হয়েছিল। দুনিয়ার জীবনে তাদেরকেও রোগ, বিপদাপদ, অর্থসংকট ও দু:খ-কষ্ট গ্রাস করেছিল। তাদেরকে শত্রুর ভয় এমন অতংকিত করে তুলেছিল যে, তারা ভয়ে প্রকম্পিত হয়েছিল। ঐ সমুদয় পরীক্ষায় তাঁরা সফলতা লাভ করেছিল। ফলশ্রুতিতে, তাঁরা বেহেশতের উত্তরাধিকারী হয়েছিল।

আয়াতটির শানে নূযুল: সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, একদা হযরত খাব্বাব বিন আরাত (রা:) বলেন, “হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি আমাদের সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করবেন না? তিনি (মুহাম্মদ সা.) বললেন এখনই ভীত হয়ে পড়লে? জেনে রাখো যে, পূর্ববর্তী একত্ববাদীদেরকে তাঁদের মাথার উপর করাত রেখে পা পর্যন্ত ফেড়ে দ্বিখন্ডিত করে দেওয়া হতো, কিন্তু তথাপি তারা তাওহীদ ও সুন্নাত থেকে সরে পড়তো না। লোহার চিরুনী দিয়ে তাদের দেহের গোশত আঁচড়ানো হতো, তথাপি তারা আল্লাহর দ্বীন পরিত্যাগ করতো না। আল্লাহর শপথ! (হে খাব্বাব) আমার এই দ্বীনকে আল্লাহ এমন পরিপূর্ণ করবেন যে, একজন অশ্বারোহী ‘সিনআ’ হতে হাযারো মাউত পর্যন্ত নির্ভয়ে ভ্রমণ করবে এবং একমাত্র আল্লাহর ভয় ছাড়া তাঁর আর কোনো ভয় থাকবে না। তবে তাঁর অন্তরে এই ধারণা হওয়া অন্য কথা যে, হয়তো তাঁর ককরীর উপরে বাঘ এসে পড়বে। কিন্তু আফসোস! তোমরা বড়ই তাড়াতাড়ি করছো। সুত্র: সহীহ আল বুখারি; অনু: মানাকিব; হা: নং-৩৬১২। মুমিনগণকে আল্লাহ তায়ালা পরীক্ষা নেওয়ার জন্যই কেবলমাত্র দুনিয়াতেই প্রেরণ করেছেন। একই বিষয়ে আল কুরআনের অন্যত্রে ইরশাদ হয়েছে ঠিক এভাবে-“মানুষেরা কি মনে করেছে যে, তারা ‘আমরা ঈমান এনেছি একথা বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে এবং তাদেরকে কি পরীক্ষা করা হবে না? আর অবশ্যই আমি তাদের পূর্ববর্তীদেরকে পরীক্ষা করেছিলাম,সুতরাং অবশ্যই আল্লাহ সত্যবাদীদেরকে জেনে নেবেন এবং নিশ্চয়ই যারা মিথ্যাবাদী তাদেরকেও আল্লাহ জানবেন।” সুত্র: সুরাহ আনকাবুত, আয়াত নং: ১-৩। এভাবে পরিখার যুদ্ধে/খন্দকের/আহযাবের যুদ্ধে সাহাবা-ই-কিরামেরও কঠিন পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। সুত্রঃ তাফসিরে ইবনে কাসির (আরবী খন্ড); পৃষ্ঠা: ১/৩১২-৩১৩।

যাদেরকে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের দিকে ছুঁটে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করবেন: এই ব্যাপারে আল কুরআনের সুরাহ ইমরানের (১৩৩-১৩৬) নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে ঠিক এভাবে-“(১৩৩) তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুঁটে যাও।

যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও জমিন; যা তৈরী করা হয়েছে মুত্তাকী তথা পরহেযগারদের জন্য। (১৩৪) যারা স্বচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুত আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে ভালোবাসেন। (১৩৫) তারা (জান্নাতীরা) কখনও কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোনো মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের উপর জুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবেন? তারা (জান্নাতীরা) নিজের কৃতকর্মের জন্য হঠকারিতা প্রদর্শন করে না এবং জেনে শুনে কোনো অন্যায় করে না। (১৩৬) ঐসমস্থ লোকের প্রতিদান হলো তাঁদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাত; যার তলদেশে প্রবাহিত হচ্ছে ঝরণা যেখানে তারা চিরস্থায়ী থাকবে। যারা (আল্লাহর নির্দেশ মতো) কাজ করে তাদের জন্য কতইনা চমৎকার প্রতিদান (জান্নাত)। চলবে….। লেখক: ইসলামী গবেষক, খতিব: লাবসা দপ্তারিপাড়া বায়তুন নূর জামে মাসজিদ, সাতক্ষীরা

The post কুরআন-সুন্নায় মুহাম্মদ (সা.) এর কর্মনীতি ও তাঁর দর্শন appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/2Zt5Jn7

No comments:

Post a Comment