Friday, August 28, 2020

চাইনিজ বন্ধু ও কিছু সুন্দর মুহূর্ত https://ift.tt/2Eyy1G1

করোনার সময়ে সব মিলিয়ে প্রায় চার মাসের মত বাসায় ছিলাম এবং বলতে পারি সময়টা সু-সময়ই ছিল। এতটা সময় আগে কখনো পরিবারকে একসাথে দেওয়া সম্ভব হইনি। সেজন্য বাচ্চাটাও অনেক খুশি ছিল। পাহাড়ে ঘেরা সুনিবিড় একরকম গ্রাম্য পরিবেশে ফুজো শহরের শেষ প্রান্তেই আমাদের বসবাস। আমাদের বাসাটা বেশ বড় সড় আর খোলামেলা। দুই বেড রুম, ড্রয়িং রুম, আলাদা কিচেন সহ দুইপাশে অনেক বড় বড় দুই বারান্দা, তাই ওই চার মাসে একঘেয়েমি জিনিসটা বুঝতে পারিনি।

পরিবার নিয়ে আসার পর খুব আনন্দের সাথেই আমাদের সময় পার হয়েছে। নির্দিষ্ট সময় ল্যাবে পার করার পর ই-বাইক (ব্যাটারী চালিত স্কুটি, ফুজোতে খুব জনপ্রিয়) নিয়ে বের হতাম বিভিন্ন পার্ক, সুপার মল আর অচেনা জায়গায়। এটা ছিল আমাদের প্রতিদিনকার রুটিন। করোনার সতর্কতা জারি হওয়ার পর আমরা অনেক ভয়ে ছিলাম। শুধুই ভাবতাম আর হয়ত বেঁচে দেশে ফিরতে পারবনা। মা-বাবা সহ সব আত্মীয় স্বজনেরা বারবার ফোন করে দেশে ফিরতে বলেছিল। মা খুব কান্নাকাটি করত। দিনে কয়েক বার ভিডিও কলে কথা হত, সব বুঝিয়ে বলতাম। তারপরেও কাদের থেকে কি শুনে এসে আবার কল করে কান্না করত। দেশে ফেরার ব্যাপারে আমি কিছুটা সম্মতি দিলেও আমার স্ত্রী কখনো রাজি হইনি। সে অনড়, সে বলত মৃত্যু হলে এখানেই মরব কিন্তু বাচ্চা নিয়ে পথে বেরিয়ে এই দুঃসময়ে আরো ভোগান্তির স্বীকার হতে চাইনা। এখন ভাবি তার সিদ্ধান্ত হয়ত ঠিকই ছিল।

ছবিঃ অন্তু এবং জেসিকার সাইকেল চালানোর কিছু মুহূর্ত।

এখানে আসার পরে বেশ কয়েকটা চাইনিজ পরিবারের সাথে আমাদের খুব ঘনিষ্ঠতা হয়ে ওঠে। স্বভাবতই চাইনিজরা ইংরেজিতে খুব দুর্বল তাই অনেক চাইনিজ এগিয়ে আসলেও আমরা তাদের ভাষা না বুঝে পিছিয়ে যায়। আমরা যে কমিউনিটিতে থাকি সেখানকার প্রায় প্রতিটা মানুষই আমাদের দেখে অনেক খুশি হয়। তারা সবসময় তাদের ভাষায় আমাদের  প্রশংসা করে। বিশেষ করে বাচ্চাকে সবাই অনেক আদর করে। খুব অল্পস্বল্প চাইনিজ বলতে/বুঝতে পারাতে তাদের কথায় একটু-আধটু হাই হেল বলে বিদায় নিই।

ছবিঃ অন্তু এবং জেসিকার ঘুরে বেড়ানোর কিছু মুহূর্ত।

একদিন সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে হাঁটতে গিয়ে পরিচিত হয় এক পরিবারের সাথে। তাদেরও প্রায় অন্তুর (আমার মেয়ের নাম) বয়সী একটা মেয়ে আছে। জেসিকার (অন্তুর বান্ধুবির নাম) মা খুব ভাল ইংরেজি বলতে পারে। তাই জেসিকা ও ইংরেজিতে পটু। জেসিকা আর অন্তু এত ভাল বন্ধুতে পরিনত হয়েছে যে তারা একে অপরকে না দেখলে থাকতে পারেনা। প্রতিদিনই তারা একের অধিক বার সাক্ষাত করে, খেলা করে। তাদের দুজনের খেলার ভিতর শোভা পায় মান-অভিমান, আদর-ভালোবাসা, রাগ-বিদ্বেষ সবই। বৃষ্টির কারনে বের হতে না পারলে একে অপরের বাসায় যায়। অন্তু-জেসিকার যখন সাক্ষাত হয় তখন তাদের দুরন্তপনাকে কোন নিষেধ হার মানাতে পারেনা।

ছবিঃ অন্তু এবং জেসিকার খেলার কিছু মুহূর্ত।

ওরা আমাদের অনেক জায়গায় ঘুরতে নিয়ে গেছে। অনেক নতুন নতুন জায়গায় যাওয়ার জন্য আমাদের অফার করে। প্রায়ই বলে তারা এখানে পিকনিক করবে ওখানে বার-বি-কিউ করবে। কিন্তু প্রথম প্রথম আমরা অতটা রাজি হতাম না। কিসব রান্না-বান্না করবে এই ভয়ে কারন এরা তো সবকিছুই খায়। বারবার বলায় প্রথম দিন মনের বিরুদ্ধে তাদের নিমন্ত্রণে বাসায় গিয়ে দেখি জেসিকার মা ইন্টারনেট ঘেটে মসলা কিনেছে। সব মেনু স্পাইসি করেই রান্না করেছে। আমরা মাছ পছন্দ করি এটা একদিন কথার ছলে শুনে নিয়ে আমাদের মত করে মাছ কেটে রান্না করেছে। সেদিন ওদের বাসায় গিয়ে বেশ কয়েকজন বন্ধুদের সাথে আমাদের পরিচয় হয়। তারা এখানকার আশপাশের ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এবং তাদের ভিতর একজন ডাক্তার ও আছেন।

ছবিঃ অন্তু এবং জেসিকার সুইমিং করার আগের মুহূর্ত।

করোনার ভয়াবহ দিনগুলোতে তারা প্রায় প্রতিদিনই আমাদের খোঁজ নিয়েছে। তাদের কথা ছিল যেকোন সমস্যা যেন তাদের কে বলি, তারা আমাদের হেল্প করবে। একদিন আমার স্ত্রী সামান্য অসুস্থতা (গ্যাস্ট্রিকের জন্য হালকা বুকে ব্যথা) বোধ করছিল। আমি ডাক্তার বন্ধুটার উই-চ্যাটে (চাইনিজ দের যোগাযোগের জনপ্রিয় সামাজিক অ্যাপ) বলা মাত্রই আমাকে উদ্বিগ্নের কারন নেই জানিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় এসে দুই ধরনের ওষুধ দিয়ে গেছে। আমি কিছুতেই টাকা নেওয়ার জন্য রাজি করাতে পারিনি।

ছবিঃ প্রথম যেদিন আমরা জেসিকাদের বাসায় ডিনারে গিয়েছিলাম সেদিন সবার সাথে।

বর্তমানে ওরা আমাদের প্রায় প্রত্যেক ওইকয়েন্ডে কাছাকাছি কিছু সুন্দর জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যায়। করোনার কারনে আমাদের ঘোরাফেরায় ইন্টারন্যাশনাল কলেজের কিছুটা বাধ্যবাধকতা থাকায় আমরা দূরে যেতে চাইনা। পরিস্থিতি ভালো হলে তারা আমাদের তাদের হোম-টাউন বেইজিং, শিয়ামেন, সহ আরও কিছু প্রদেশে ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেছে।

ছবিঃ আমরা সবাই যেদিন পাহাড়ি ঢল থেকে নেমে আসা ঝর্ণায় সুইমিং এ গেছিলাম।

গত মাসে বাইরে ঘুরতে গিয়ে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অফার করেছিল। বন্ধুত্বের খাতিরে না করতে পারিনি। আমরা ভেবেছিলাম আজ আর রেহায় নেই। আজ হয়ত অক্টোপাস না হলে শামুকের সুপ খায়িয়েই ছাড়বে। কেননা আমাদের কাছে না শুনে তারা নিজেই সেদিন খাবারের অর্ডার করেছিল। ওয়েটার একে একে প্রায় ১৫-১৬ রকমের মেন্যু টেবিলে দিল। সত্যিই আমরা সেদিনের মেন্যুগুলো দেখে খুব অবাক হইয়েছিলাম। সবগুলো আইটেম ছিল মাছ, ডিম আর সবজির। অনেক মজার, আর স্পাইসি। ওনারা ঠিকমত খেতে পারিনি স্পাইসির জন্য কিন্তু আমরা সেদিন পেটপুরে খেয়েছিলাম।

ছবিঃ অন্তু তার অন্যান্য বন্ধুদের সাথে স্কেটিং করার মুহূর্ত।

এখানে আসার পরে বাচ্চাটাকে নিয়ে অনেক চিন্তা হত, না জানি কার সাথে মিশবে? একা একা থাকতে থাকতে সে আবার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত না হয়ে পড়ে। এখন মেয়ে আমার বলে সে চায়না ছেড়ে আর দেশে যাবেনা। সে নাকি জেসিকা কে সাথে নিয়ে দেশে কয়েকদিন ঘুরে আবার চায়না আসবে। ওর এসব কথা শুনে এখন অনেক হাসি পায়। জেসিকা ছাড়াও তার আরও কয়েকজন ভালো বন্ধু আছে, তারা ইংরেজি না জানলেও প্রতিদিন খেলতে গিয়ে অন্তুর সাথে সাক্ষাত না করলে তাদের খেলার পূর্ণতা পায়না।

ছবিঃ পরে একদিন আমাদের নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়ার দৃশ্য।

প্রায় এক মাস আগে ঘন্টা খানিকের জন্য পরিচিত হয় চাইনিজ এক আন্টির সাথে। এরপর উই-চ্যাটের প্রোফাইল পিকচারে বাচ্চার ছবি দেখে প্রায় আমাকে মেসেস পাঠায় মেয়েকে দেখবেন। বারবার ওনার বাসায় যাওয়ার জন্য বলেন। সেদিন উই-চ্যাটের মোমেন্টে বাচ্চার দুইটা ছবি শেয়ার করার পর থেকেই ওনার কয়েকবার কল। পরে আমি কল কেটে দিয়ে চাইনিজে ট্রান্সলেট করে লিখি “আন্টি আপনি টাইপ করেন তাহলে আমি বুঝে নেব, আমিতো চাইনিজে কথা বলতে পারিনা”। অন্তুকে দেখবেন এবং আমাদের ডিনার করাবেন আজ উনি কোন বিধিনিষেধই মানবেন না।

ছবিঃ চাইনিজ সেই আন্টির সাথে অন্তু।

গেলাম সন্ধ্যায়, অন্তুকে পেয়ে উনি ওনার নিজের নাতনির থেকেও বেশি খুশি, নিজ হাতে করে খাইয়ে দিয়েছে। আর অন্তুও ক্ষনিকের জন্য ঠাম্মি এবং দিদুনের অভাব পূরণ করে নিল। আমরা গিয়ে বলছিলাম কিছু খাবনা তাতে উনি খুবই মাইন্ড করেছিলেন। পরে নিজেদের পছন্দ মত সবজি, চিকেন, ব্রেড নিয়ে সেগুলো বার-বি-কিউ করেছিলাম। আমাদের খাওয়াতে পেরে আন্টি অনেক খুশি, আমরাও খুবই মজা করে সব খাবার গুলো খেয়েছিলাম।

ছবিঃ আন্টি আমাদের বার-বি-কিউ করিয়ে খাওয়ায়।

সীমাবদ্ধ মানব জীবনে চলার পথে ক্ষণিকের জন্য প্রতিদিন পরিচিত হচ্ছি নিত্যনতুন জায়গা, নিত্যনতুন কালচার, নিত্যনতুন মানুষের সাথে। একদিন এদের ছেড়ে চলে যেতে হবে নিজের কর্মক্ষেত্রে, আবার সবকিছুকে অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে। হয়ত চাপা পড়ে যাবে এখানকার সব স্মৃতি। সবকিছু চিন্তা করলে সত্যিই যেন মায়া লাগে এই ফুজো সিটি ছেড়ে যেতে।

লেখকঃ অজয় কান্তি মন্ডল, পিএইচডি ফেলো, ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজিয়ান, চীন

Email: ajoymondal325yahoo.com

The post চাইনিজ বন্ধু ও কিছু সুন্দর মুহূর্ত appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3hCQ38q

No comments:

Post a Comment